‘ছাইভস্ম’র লড়াইয়ে আগুনে উত্তাপ
৩০ জুলাই ২০১৯ ১৬:০৪
১৮৮২ সালের ২৯ আগস্ট লন্ডনে প্রথম জন্ম হয় ‘অ্যাশেজ’ শব্দটির। নিতান্ত নিরীহ শব্দ ‘অ্যাশেজ’ বা ‘ছাইভস্ম’ ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়েছে লড়াইয়ের আগুনে উত্তাপ নিয়ে। অ্যাশ বা ছাইয়ের সঙ্গে ক্রিকেটের সম্পর্কটা অনেকেই জানেন। একটা ছাইভস্ম থেকে যে ক্রিকেট যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, সেটাই বজায় আছে উত্তরসূরীদের মধ্যে, সেই যুদ্ধের নাম অ্যাশেজ। যুদ্ধটা দুই দলের, যারা ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে আর টেস্ট ম্যাচ খেলেছিল। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া এই দুই দলের টেস্ট ম্যাচের লড়াই পরিচিতি পেয়েছে অ্যাশেজ নামে।
এক শিশি ছাই। অথচ এনিয়ে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে ধুন্দুমার ক্রিকেট যুদ্ধ। কালের বিবর্তনে ছাই নিয়ে সেই যুদ্ধই এখন ক্রিকেটের ইতিহাসে একটি ঐতিহ্য। এই ‘ছাই’ যেন একটি সম্মান, একটি মর্যাদা। অ্যাশেজ জন্ম দিয়েছে কত ধ্রুপদী লড়াইয়ের, কত রূপকথার, কত ক্রিকেটীয় উপাখ্যান আর রোমাঞ্চের! অ্যাশেজ মানে সিংহের এলাকায় ক্যাঙারুর হানা কিংবা দ্রুতগতিতে লাফিয়ে চলা ক্যাঙ্গারুর এলাকায় সিংহের অসহায় চাহনি!
ক্রিকেটের জন্ম হয় ইংল্যান্ডে। তবে, সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে সর্বকালের সবচেয়ে সফলতম দলটার নাম অস্ট্রেলিয়া। ১৮৭৭ এই দুই দলই খেলেছিল ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচ, ১৯৭১ সালে প্রথম স্বীকৃত ওয়ানডে ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই দুই দলের মধ্যেই। ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বর্তমানে ‘টেস্ট’ নামে পরিচিত বড় ফরম্যাটে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। যা ছিল ইতিহাসের প্রথম টেস্ট। ঐ সময় ধরাবাধা কোনো নিয়ম না থাকায় ‘যতক্ষণ বা যত সময় বা যতদিন’ খেলা যায় এমন চুক্তিতে টেস্টটি খেলতে নামতো দু’দল। তবে, ১৮৮২ সালে টেস্ট নিয়ে নতুন নিয়ম চালু করে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট। অনির্ধারিত সময়ের টেস্ট নীতি বাদ দিয়ে তিন দিনের ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সেই সুবাধে ওভালে ১৮৮২ সালের ২৮ আগস্ট তিন দিনের এক ম্যাচের সিরিজ খেলতে নামে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু দুই দিনে নিষ্পত্তি হয়ে যায় ম্যাচটি। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক টেস্টটি মাত্র ৭ রানে জিতে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে সফরকারী অস্ট্রেলিয়া। ২৯ আগস্ট শেষ হয়ে যায় দুই দলের লড়াই।
ওভাল টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে অজিদের দেয়া ৮৫ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে গিয়ে ফ্রেড স্পফোর্থের বোলিং তোপের সামনে নাকাল হয় ইংলিশরা। ইংল্যান্ড অলআউট হয়ে যায় ৭৭ রানে। ম্যাচ শেষ হয় দুইদিনে। অথচ অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬৩ রানে অলআউট করে দিয়ে ৩৮ রানের লিড নিয়েছিল ইংল্যান্ড।
ইংল্যান্ডের দলটা তখন ছিল দুর্ধর্ষ, তাদের মাঠে তাদেরকে হারানোটা তখন প্রায় অসম্ভব। কিন্তু, স্বাগতিক ইংলিশদের বিপক্ষে দুর্দান্ত সেই জয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের হারে স্বাগতিকদের ক্রিকেট মৃত্যুর দেখে ফেলেছিল সে দেশের ক্রিকেটবোদ্ধা ও গণমাধ্যমগুলো। এই পরাজয়ে অহমে আঘাত লাগে ইংল্যান্ডের। কারণ তখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া তাদের একটি উপনিবেশ মাত্র। অধীনস্ত একটি অঞ্চল লন্ডনে এসে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দেওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যম। সেখানে বিদ্রুপাত্মকভাবে সে সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা দ্য স্পোর্টিং টাইমস বেশ বড়সড়ভাবে একটি রিপোর্টে প্রকাশ করে। সাংবাদিক রেজিন্যাল্ড শার্লি ব্রুকসের একটা ব্যাঙ্গধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকায়, তিনি লিখেছিলেন, ‘মর্মাহত হৃদয়ে জানানো হচ্ছে, ১৮৮২ সালের ২৯ আগস্ট ওভালে ইংলিশ ক্রিকেটের মৃত্যু হয়েছে। গভীর দুঃখের সঙ্গে বন্ধুরা তা মেনে নিয়েছে। ইংলিশ ক্রিকেটকে ভস্মীভূত করা হয়েছে এবং ছাইগুলো অস্ট্রেলিয়াকে প্রদান করেছে। ইংল্যান্ড ক্রিকেটের মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে গেল। এখন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের অস্তিত্ব বলতে শুধু ‘ছাই’ আছে। আর সেই ‘ছাই’ সঙ্গে নিয়ে আনন্দ করতে করতে দেশে ফিরে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া।’
ওই হারের পর প্রতিশোধের নেশা প্রবল হয়ে ওঠে ইংল্যান্ডের। আগের সিরিজে নাস্তানাবুদ হওয়াটা তখনও মেনে নিতে পারেনি নাক উঁচু বৃটিশরা। সুযোগটি আসে ১৮৮৪ সালে। ‘অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারের মিশন’ নিয়ে ইংল্যান্ড দল অস্ট্রেলিয়ায় রওনা হয়। ইভো ব্লাইয়ের নেতৃত্বাধীন ইংলিশ দলটি সেবার অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ ব্যবধানে হারায়। সিরিজ শেষ হবার পরে মেলবোর্নে এক পানশালায় উৎসব করছিল ইংল্যান্ড দল, সেখানে ব্লাইকে একটা ছাইভর্তি ভেলভেটের বাক্স উপহার দেন ফ্লোরেন্স মার্ফি নামের এক নারী আর তার কয়েকজন বান্ধবী। কথিত আছে মার্ফি ও তার বান্ধবীরা একটি স্টাম্প কিংবা স্টাম্পের বেল পুড়িয়ে সেটির ছাই ইংল্যান্ড অধিনায়কের হাতে তুলে দেন। সেটিকেই কল্পিত ছাইভস্মের পুনরুদ্ধারের স্বীকৃতি বলে ধরে নেয় ব্রিটিশরা। ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারের পরের বছর মার্ফির সঙ্গে ব্লাইয়ের বিয়ে হয়। ১৯২৭ সালে মারা যাওয়ার আগে ব্লাই তার স্ত্রীকে অনুরোধ করে যান, উপহার দেওয়া সেই ‘ছাইদানি’ বা অ্যাশেজটি যেন ক্রিকেটের ঘর নামে পরিচিত এমসিসিকে (মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব) দেওয়া হয়। তখন থেকে লর্ডসের এমসিসি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে ঐতিহাসিক সেই ‘অ্যাশেজ’।
এখন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজজয়ী দলকে যে ছাইদানিটা দেওয়া হয়, সেটি আসলে মূল অ্যাশেজের রেপ্লিকা। তবে বেল কিংবা স্টাম্প পোড়ানোর ছাই থাকে কি না, সেটা নিয়ে সংশয় আছে। ১৯৯৮ সালে ব্লাইয়ের ৮২ বছর বয়স্কা নাতনি দাবি করেছিলেন, ওই ছাইগুলো বানানো হয়েছিল তার শাশুড়ির নেকাব পুড়িয়ে। অনেকের দাবি, আসলে পোড়ানো হয়েছিল ক্রিকেট বল। ছাই যেটিরই হোক, তা থেকেই জন্ম অ্যাশেজের।
তখন থেকেই ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট সিরিজের নামকরণ হয় ‘অ্যাশেজ‘। যদিও উইজডেন ‘অ্যাশেজ সিরিজ’কে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯০৫ সালে। অ্যাশেজ দেখেছে ডন ব্রাডম্যানকে, অ্যাশেজ দেখেছে শেন ওয়ার্ন নামের এক ঘূর্ণি জাদুকরকে, অ্যাশেজ দেখেছে রিকি পন্টিং, ইয়ান বোথাম, জিম লেকারদের মতো ক্রিকেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের। যুগে যুগে কিংবদন্তিরা অ্যাশেজে খেলেছেন, মাঠ মাতিয়ে রেকর্ডবুক সমৃদ্ধ করেছেন, একটা সময় বিদায়ও নিয়েছেন। তাদের জায়গা দখল করেছে তাদের উত্তরসূরিরা। কিন্ত অ্যাশেজ তার নিজস্ব যুদ্ধ এখনও বিদ্যমান রেখেছে। যেমনটা ছিল শতবর্ষ আগে। এখণ পর্যন্ত মোট ৭০টি ‘অ্যাশেজ’ সিরিজে মুখোমুখি হয়েছে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। ‘অ্যাশেজ’ লড়াইয়ে ৩৩টি সিরিজ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া আর ৩২টি সিরিজ জিতেছে ইংল্যান্ড। বাকি ৫টি সিরিজে জয় বা হারের স্বাদ পায়নি কোনো দলই।
পরিসংখ্যানে অবশ্য অস্ট্রেলিয়ারই জয়জয়কার, অ্যাশেজে সর্বোচ্চ রানের মালিক অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান ডন ব্রাডম্যান (৫ হাজার ২৮ রান), সবচেয়ে বেশি উইকেটশিকারী অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি স্পিনার শেন ওয়ার্ন (১৯৫টি)। দুই দল এখন পর্যন্ত ৩৩০টি টেস্ট খেলেছে, যেখানে অজিদের জয় ১৩৪ ম্যাচে আর ইংল্যান্ডের জয় ১০৬ ম্যাচে। বাকি ৯০টি টেস্ট ড্র হয়েছে। গত অ্যাশেজের ৫ ম্যাচের চারটিতেই জিতেছিল স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া, বাকি ম্যাচটি ড্র হয়। এবার ইংল্যান্ডের মাটিতে বসতে যাচ্ছে ৭১তম অ্যাশেজ। ক্রিকেটের ধ্রুপদী এই লড়াইয়ের আগে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছে আধুনিক ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ড।
২০১৯ অ্যাশেজের সূচি:
১-৫ আগস্ট: প্রথম টেস্ট, এজবাস্টন
১৪-১৮ আগস্ট: দ্বিতীয় টেস্ট, লর্ডস
২২-২৬ আগস্ট: তৃতীয় টেস্ট, হেডিংলি
৪-৮ সেপ্টেম্বর: চতুর্থ টেস্ট, ওল্ড ট্রাফোর্ড
১২-১৬ সেপ্টেম্বর: পঞ্চম টেস্ট, ওভাল