‘স্যালুট ক্যাপ্টেন’
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২৩:৪০
যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের আক্রমণে যখন নিজ শিবির ছিন্নভিন্ন, তখন সবার সামনে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে লড়াই করেন যিনি, প্রকৃত নেতা তো তিনিই। সেই নেতা যখন নিজ শিবিরের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে অটল পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে যান, শতচ্ছিন্ন দলও ঘুরে দাঁড়ায়, ছিনিয়ে আনে বিজয়। ঠিক তেমনই আরেক নেতার দেখা পেল বিশ্ব। জুনিয়র টাইগারদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন, বুক চিতিয়ে লড়াই করলেন ভারতীয় বোলার-ফিল্ডারদের পেতে রাখা মাইনফিল্ডের সামনে। সারথীদের সঙ্গী করে ছিনিয়ে আনলেন বিজয়। তিনি আকবর আলী, অনূর্ধ্ব-১৯ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, যার নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো কোনো বিশ্ব শিরোপা এখন বাংলাদেশের ঘরে।
আকবর আলী যেভাবে নেতৃত্ব দিলেন, তার স্বীকৃতিও পেলেন তাৎক্ষণিকভাবেই। ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটিও জিতে নিলেন তিনি। বিশ্বমঞ্চের শিরোপার পর আকবর আলীর ম্যান অব ম্যাচ পুরস্কার জয় যেন ঠিক ‘চেরি অন দ্য কেক’। যুবাদের বিশ্বমঞ্চের শিরোপাটিও যেন তার হাতেই সবচেয়ে বেশি মানানসই।
আরও পড়ুন- অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, ভারত বধ
ম্যাচের পঞ্চদশ ওভারে ক্রিজে এসেছিলেন। তখন রবি বিষ্ণয়ের স্পিন ঘূর্ণিতে রীতিমতো ধুঁকছেন টাইগার যুবারা। এর মধ্যে বেশ ছন্দে থাকা ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমনকেও আহত হয়ে মাঠ ছাড়তে হলে তা যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ওই যে অধিনায়কের যে গুণ, সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন ক্রিজে। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচাগ্র মেদিনি’ কাকে বলে, সেটাই— যেন দেখালেন আকবর আলী। সব ঝড়-ঝঞ্ঝাকে অতিক্রম করে এনে দিলেন সেই স্বপ্নের মুহূর্ত।
এদিন দেশের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে বোলিংয়ের মতো যুবা টাইগারদের ব্যাটিং ইনিংসের শুরুটাও হয়েছিল দারুণ। স্বল্প রান তাড়া করতে নেমে আস্কিং রান রেট সাড়ে তিনের সামান্য কিছুটা বেশি থাকলেও ৯ ওভারের মধ্যেই অর্ধ শতকের জুটি গড়েন উদ্বোধনী দুই ব্যাটসম্যান। এরপর বিষ্ণয় ঝড়ে এলোমেলো বাংলাদেশের ইনিংস। নবম ওভারে প্যাভিলিয়নে ফেরেন তানজিদ হাসান, ১৩তম ওভারে আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান মাহমুদুল হাসান জয়। ওই সময়ই আহত হয়ে ফেরেন আরেক ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমন। ১৫তম ওভারে তৌহিদ হৃদয় আউট হয়ে গেলে ক্রিজে আসেন অধিনায়ক আকবর আলী। এক ওভার পরে তাকে ছেড়ে চলে যান শাহাদত হোসেনও। সবাই শিকার বিষ্ণয়ের ঘূর্ণির। এখান থেকেই শুরু আকবর আলীর নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প।
আরও পড়ুন- অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল: বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বল বাই বল
ছোট হলেও দু’টো জুটি গড়েন শামীম হোসেন আর অভিষেক দাসের সঙ্গে, প্রথমটি ২০ রানের, পরেরটি ১৭ রানের। এরপর আহত হয়ে ড্রেসিং রুমে ফেরত যাওয়া পারভেজ ফিরে আসেন দলের বিপদে অধিনায়ককে সঙ্গ দিতে। ঠান্ডা মাথায় খেলতে থাকেন তারা। ৯ ওভারে ৪১ রানের জুটিতে দলকে অনেকটাই জয়ের বন্দরের দিকে নিয়ে যান তারা। তবে পার্টটাইমার জয়সওয়ালের ব্যক্তিগত দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে মনোসংযোগ ধরে রাখতে পারেননি ইমন। আকাশ সিংয়ের হাতে ক্যাচ তুলে দেন। তখনো দল জয় থেকে ৩৫ রান দূরে।
পারভেজ ইমনের বিদায়ের পর আর কোনো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান না থাকায় ফের শঙ্কার কালো মেঘ জমতে শুরু করে টাইগার শিবিরে। তবে ওই যে আকবর আলী আছেন ক্রিজে। তিনি যেন এদিন চীনের গ্রেট ওয়াল। বোলার রাকিবুল ক্রিজে নামলে তার কানে মন্ত্র পড়ে দেন— ১৮ ওভারে ৩৫ রানের লক্ষ্য অর্জনে আহামরি কিছু করতে হবে না, ক্রিজে টিকে থাকলেই হবে।
আরও পড়ুন- জুনিয়র টাইগারদের বিশ্বজয়ে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন
অধিনায়ক যখন পথ দেখান, সে পথে হাঁটতে দ্বিধাহীন হন তার সারথীরাও। রাকিবুল যেন সেটিই দেখালেন। টানা ২০ বল কোনো রান এলো না। কিন্তু ক্রিজে থাকলেই জয় নিশ্চিত— জুনিয়র টাইগার অধিনায়ক আকবরের সে সূত্রটি প্রমাণ করে দিলেন ভারতীয় বোলাররাই। আকাশ সিং এক ওভারে দিলেন তিন ওয়াইড। ওই ওভারেই ১ রান নিয়ে রানের খাতাও খুললেন রাকিবুল। লক্ষ্যটা আকবরের কৌশল মেনেই ছোট হয়ে আসছিল।
এর মধ্যে বৃষ্টির বাগড়া। ৪১ ওভার শেষে প্রথম বিশ্বজয়ের ইতিহাস থেকে থেকে টাইগার যুবারা যখন মাত্র ১৫ রান দূরে, বৃষ্টি বাধায় খেলোয়াড়দের মাঠ ছাড়তে হয়। ওই সময় ডাকওয়ার্থ-লুইস নিয়মে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশই। ফলে খানিকটা নির্ভার ছিল টাইগার শিবির।
আরও পড়ুন- বিশ্ব জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা জুনিয়র টাইগাররা
মিনিট দশেক পরে খেলা গড়ায় মাঠে। নতুন লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ৪৬ ওভারে ১৭০ রান। অর্থাৎ ৫৪ বলে ১৫ রানের রানের লক্ষ্য মাঠে নামার পর হয়ে যায় ৩০ বলে ৭। প্রথম বলেই আকবর আলী নেন সিংগেল। দুই বল দেখে চতুর্থ বলেই মিশরাকে বাউন্ডারি ছাড়া করে সে লক্ষ্যকে নাগালে নিয়ে আসেন রাকিবুল। শেষ বলে একরান নিয়ে সমতা নিয়ে আসেন স্কোরে। আর দেরি করেননি, পরের ওভারের প্রথম বলেই আনকোলেকারকে মিড অনে ঠেলে দিয়ে রাকিবুল উপহার দেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় মুহূর্তটি।
এভাবেই দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে লেখা হলো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গৌরবময় মুহূর্তটি। আর তাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং অধিনায়ক। আর তাই শরীফুলের অমন তেড়েফুড়ে করা বোলিং কিংবা অভিষেকের তিন তিনটি উইকেট, কিংবা প্রতিপক্ষের জসওয়ালের ব্যাটে টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা ইনিংস বা বিষ্ণয়ের ম্যাজিক্যাল ঘূর্ণি স্পেল— সবকিছু ছাপিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটিও জিতে নিলেন অধিনায়ক আকবরই।
উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান আকবর আলীর ক্রিকেট মস্তিষ্কের প্রশংসা করে থাকেন অনেকেই। বর্তমান জাতীয় ক্রিকেট দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ, একসময়ের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের উত্তরসূরী হিসেবেও তার নাম ঘুরেফিরে আলোচনায় উঠে আসে। সেসব প্রশংসা যে কেবলই স্তূতির স্তূপ নয়, গোটা টুর্নামেন্টে সেটা দেখিয়ে এসেছেন আকবর আলী। আর টানটান উত্তেজনার ফাইনাল ম্যাচে যখন দলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নির্ভরতার, ঠিক সেটিই নিংড়ে দিলেন ২২ গজের আঙিনায়। আকবর আলীকে তাই আজকের দিনে আমরা ক্রিকেটপ্রেমীরা বলতেই পারি, ‘স্যালুট ক্যাপ্টেন।’
ছবি: বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের টুইটার থেকে
অধিনায়ক অধিনায়ক আকবর অনূর্ধ্ব-১৯ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট আকবর আলী জুনিয়র টাইগার বিশ্বকাপ ক্রিকেট