মাবিয়ার স্বপ্নজুড়ে শুধুই অলিম্পিক, তবে…
১২ এপ্রিল ২০২০ ২৩:৫২
জাহিদ-ই-হাসান, স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: মরণব্যাধী করোনাভাইরাসের কারণে পুরো বিশ্বই স্থবির হয়ে আছে। বাংলাদেশেও এর ছোবলের দরুণ প্রিমিয়ার লিগ থেকে শুরু করে সকল ঘরোয়া ক্রীড়া টুর্নামেন্ট বন্ধ। এমন থমথমে অবস্থায় দেশের ক্রীড়াবিদদের ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে সারাবাংলাডটনেটের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার আয়োজনে আজকে থাকছেন ভারোত্তলন জগতের তারকা ক্রীড়াবিদ মাবিয়া আক্তার সীমান্ত।
২০১৬ সাল তখন। গুয়াহাটির ভোগেশ্বরী ফুকনানি ইনডোরে ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে ভারতের প্রতিযোগীকে হারিয়ে সোনা জিতে নিয়েছিলেন মাবিয়া। পদক নেয়ার সময় পতাকার দিকে তাকিয়ে মাবিয়ার সেই অশ্রু কাঁদিয়েছিল পুরো দেশকে। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি তাকে। গেল বছরে নেপালেও বাংলাদেশকে টানা স্বর্ণ এনে দিয়েছেন মাদারিপুরের এই কীর্তিমান অ্যাথলেট। এখন স্বপ্নের আকাশটা অনেক বড় তার। অলিম্পিকের মঞ্চে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চান। মাবিয়া কিভাবে সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তার ক্যারিয়ার ভাবনা, বাংলাদেশের ভারোত্তলন ভবিষ্যত, স্বপ্নকথা জানালেন সারাবাংলার কাছে।
সারাবাংলাঃ কিভাবে সময় কাটছে?
মাবিয়া আক্তার সীমান্তঃ ঘুমিয়ে বসে, টিভি দেখে, সবাইকে সময় দিয়ে, হালকা রান্না-বান্না করছি। একটু চেষ্টা করি।
সারাবাংলাঃ এমন সময়ে ফিটনেস ধরে রাখছেন কিভাবে?
মাবিয়াঃ ফজরের নামাজ শেষ করে ফ্লোরে ফিটনেস ট্রেনিং করছি। বাসাটা এতো বড় না। ইয়োগা, মেডিটেশন করছি।
সারাবাংলাঃ প্রস্তুতি নিতে পারছেন না খারাপ লাগছে কি?
মাবিয়াঃ স্বাভাবিক না? মাঠের মানুষ ঘরে বসে থাকলে যা হয় । ১০ বছর ক্যারিয়ারে এমন সময় কাটায়নি। এমনও হয়েছে ঈদের দিন বিকেলেও ট্রেনিং করেছি। এটাই খারাপ লাগছে যে ফিটনেসের কাজ কাজ করতে পারছি না।
সারাবাংলাঃ ফিটনেস ঠিক না থাকলে কি কোন ক্ষতি আছে?
মাবিয়াঃ অবশ্যই। সবচেয়ে বড় সমস্যা হবে আমার ক্যারিয়ারে। কামব্যাক করাটা কঠিন হবে। এক বছর বা ছয়মাস লাগবে অন্তত। লোকডাউনের পর বা করোনা পরিস্থিতি ঠিক হলে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। এসময় খাবার মেন্যু মেনে চলা কঠিন। বাসায় থাকছি ওয়েলি খাবার খাচ্ছি। ক্যারিয়ারে কামব্যাক করাটাই চ্যালেঞ্জ হবে।
সারাবাংলাঃ তাহলেতো একটা বড় চ্যালেঞ্জের সামনেই পড়ছেন…
মাবিয়াঃ চার বছর অপেক্ষা করছি অলিম্পিকের জন্য। ২০১৬ তে হয়নি। ফেডারেশনের একটা ভুলে কারণে হয়নি। এবার পরিশ্রম করছি অনেক আগে থেকেই। বাছাইপর্বগুলোতে অংশ নিয়েছি। কোয়ালিফাই করেছি কিনা বা ওয়াইল্ড কার্ড পাচ্ছি কিনা এমন পরিস্থিতির মধ্যে আছি। আর হঠাৎ করে এমন একটা বিরতি যাবে ভাবিনি। এটা খারাপ লাগে।
সারাবাংলাঃ ফেডারেশন থেকে কোন যোগাযোগ বা নির্দেশনা পাচ্ছেন কি না?
মাবিয়াঃ ফেডারেশন থেকে যোগাযোগ অব্যাহত আছে।
সারাবাংলাঃ বাংলাদেশ ভারোত্তলন ফেডারেশনের বিপক্ষে নারী অ্যাথলেট লাঞ্ছনার অভিযোগ উঠেছিল একবার…
মাবিয়াঃ সেই লাঞ্ছনার কাহিনী আদালতে গিয়ে সমাধান হয়েছে। আদালতের রায়েই প্রমাণ হয়েছে এতে ফেডারেশনের কোন হাত নেই। কিন্তু যা দুর্নাম যাওয়ার গিয়েছে।
সারাবাংলাঃ খেলাধুলায় মাঝেমধ্যেই এমন খবর আসতেছে। নারী অ্যাথলেটরা কি নিরাপদ সেভাবে? কি করা উচিত বলে মনে হয় আপনার?
মাবিয়াঃ প্রকাশ পাওয়া উচিৎ। বেশিরভাগ নারী অ্যাথলেটরাই নিম্নমধ্যবিত্তের। দরিদ্রতা দূর করবার জন্য অ্যাথলেটরা খেলায় আসে। তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এমন করাটা কখনও সমুচিত নয়। নিরাপত্তা কই? আমার কাছে মনে হয় অ্যাথলেটদের নিজেরাই দাঁড়িয়ে প্রকাশ করা উচিৎ। আর যারা এটা করছে তাদের মনুষত্ব নেই।
সারাবাংলাঃ ভারোত্তলনে নারী অ্যাথলেটদের মূল্যায়ন করা হয় কিভাবে?
মাবিয়াঃ যারা ভাল করছে তারাই জায়গা করে নিচ্ছে। ছেলে না মেয়ে দেখা হয় না।
সারাবাংলাঃ তরুণদের মাঝে ভারোত্তলন নিয়ে কেমন সাড়া দেখেন?
মাবিয়াঃ গত যুব গেমসেও প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে। তাদের সুযোগ সুবিধা দেয়া হলে ভাল পাইপলাইন তৈরি হবে। তবে এখানে যদি আছে…
সারাবাংলাঃ যদি টা কি?
মাবিয়াঃ আমার আজকে এখানে আসার পেছনে যাদের অবদান আছে তাদের একজন হলো ফারুক আহমেদ সরকার, শাহরিয়ার সুলতানা সূচী আর উইং কমান্ডার মহিউদ্দীন আহমেদ। আর আমার মামা বক্সিং কোচ মামা শাহাদাৎ কাজী। তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমি এখানে বড় হয়েছি। তখন ফেডারেশন বা সরকারের ফ্যাসিলিটিগুলো আমি পাইনি। কিন্তু যুব গেমসের এই খেলোয়াড়দের ফেডারেশন থেকেই সুযোগ করে দিতে হবে। ব্যক্তি ফ্যাসিলিটিস দিয়ে উপরে ওঠা খুব কঠিন। পাইপলাইনদের পরিচর্যা করতে হবে।
সারাবাংলাঃ সেই সুযোগ সুবিধাগুলো কি এখনও যথেষ্ট আছে মনে হয়?
মাবিয়াঃ যে ডিসিপ্লিনগুলো এখনও পর্যন্ত এসএ গেমসে অন্তর্ভূক্ত নয় বা পদক এনে দিতে পারে না তাদের ইনডোর স্টেডিয়াম হয়। গ্যালারি হয়। আর আমরা গত তিন এসএ গেমসে স্বর্ণ পদক এনেও ফেডারেশনে একটা উন্নত জিমনেসিয়ামের ব্যবস্থা করা যায়নি। কোচ ফ্যাসিলিটিস দেয়া হয়নি। আমাকে বলছে বিদেশি কোচ দিবে। কেন? আমি যদি দুইজন দেশি কোচ দিয়ে এখানে দাঁড়াতে পারি তাহলে বিদেশি কোচ কেন? দেশের কোচরা যোগ্য। তাদের সুযোগ দিতে হবে।
সারাবাংলাঃ আপনি কি বলতে চাচ্ছেন খেলোয়াড়-কোচ মূল্যায়ন পায় না?
মাবিয়াঃ হুম। মূল্যায়ন পায় না। একটা ব্যাপার দেখুন ২০১০ থেকে কোন ডিসিপ্লিনে টাকা স্বর্ণ এসেছে এসএ গেমসে? ভারোত্তলন। সেখানে কোচ বা খেলোয়াড়রা মূল্যায়ন পায়নি। প্রধানমন্ত্রী মহৎ ছিলেন বিধায় আমাকে ফ্ল্যাট দিয়েছেন। কিন্তু এদের কারিগর বা অন্যান্য খেলোয়াড়রা সঠিক মূল্যায়ন পায় না।
সারাবাংলাঃ কি ধরনের ফ্যাসিলিটিসের কথা বলছেন?
মাবিয়াঃ খেলোয়াড় উঠে আসবে কোচের কাছ থেকে। একটা খেলোয়াড়ের সঙ্গে একজন যোগ্য কোচ থাকবেন। তিনি লক্ষ্য ঠিক রেখে খেলোয়াড়কে তৈরি করবেন। ওই খেলোয়াড়কে পরে প্রমাণ করতে হবে। যদি না পারে তাহলে ওই খেলোয়াড় রিপ্লেস হবে নতুন খেলোয়াড়। শুধু তাই নয় ডিজিটাল ইকুপম্যান্টও দিতে হবে।
সারাবাংলাঃ আপনার নিজের ক্যারিয়ার বা স্বপ্নের কথা বলেন…
মাবিয়াঃ অলিম্পিকের মঞ্চে পারফর্ম করবো এটাই স্বপ্ন। এবার সে সুযোগটা আসছে। ওয়াইল্ড কার্ড পেতে পারি। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কাছে নাম পাঠিয়েছে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন। আর অলিম্পিকের দেয়া সাতটি বাছাইপর্বের মধ্যে ছয়টিতেই অংশ নিয়েছি। এবং ধারাবাহিক উন্নতি করেছি। করোনার কারণে একটা স্থগিত হয়েছে। পরিস্থিতি ঠিক হলে দিবো। আশা করছি সুসংবাদ আসছে।
সারাবাংলাঃ অলিম্পিক পিছিয়েছে। সময় পাচ্ছেন। প্রস্তুতি নিবেন কিভাবে?
মাবিয়াঃ দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশ গেমসের জন্য প্রস্তুতি নিবো। এরপর কঠিন পরিশ্রম করবো অলিম্পিকের জন্য। এটা সবসময় স্বপ্ন আমার। যত কঠিন পরিশ্রমই হোক না কেন করবো।
সারাবাংলাঃ মাঝেমধ্যে টিকটকে পারফর্ম করেন? অভিনয়ের কোন ইচ্ছা অবসরের পর বা এখন?
মাবিয়াঃ এমনিতে কোন অভিনয় করার ইচ্ছে নেই তারপরও কখনও কোন অফার পেলেও যদি মনে হয় বা ইচ্ছা হয় তাহলে হয়তো করব। এছাড়া এমন তেমন কিছু করার ইচ্ছে নেই। ইনস্টাগ্রামে জাস্ট টাইম পাস এর জন্য একটু টিকটক ভিডিও গুলো পোস্ট করি।
সারাবাংলাঃ আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
মাবিয়াঃ আপনাকেও।
সারাবাংলা/জেএইচ