ঈদে পরিবারের সঙ্গে থাকব, কিন্তু সবাইকে পাব না: মোস্তাফিজ
২৪ মে ২০২০ ১৩:২৬
ঢাকা: মোস্তাফিজুর রহমান মানুষটাই বিস্ময়ের। একেবারে আপাদ মস্তক! এমন অনেক বড় বড় ঘটনা আছে যা তাকে বিন্দুমাত্র নাড়া দেয় না। আবার অনেক ছোট খাটো ব্যাপারও তার মর্মের একেবারে গভীরে ঢুকে পড়ে, তৈরি করে বিস্তর জিজ্ঞাসা। তার ছোট ক্যারিয়ারের এত এত অর্জন নিয়ে যখনই প্রশ্ন করেছি, স্রেফ হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন…‘খেললে তো হবেই।’ ভাবখানা এমন যে জলবৎ তরলং। কিন্তু লটকন ভুল করেও মিষ্টি হলে সেটা নিয়ে তার বিস্তর জিজ্ঞাসা! কেন টক নয়? কোন এলাকার? গাছটা সম্ভবত রোদ পায়নি ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঈদও তার কাছে তেমনই একটি বিষয়। ঈদ নিয়ে যেমন তার বিশেষ কোনো অনুভূতি বা আনন্দের অতিশয্যা নেই, তেমনি ঈদের নামাজ নিয়েও অতটা বাড়াবাড়ি নেই। ঈদের নামাজ তার কাছে জুম্মার নামাজের মতোই। আর ঈদের দিন অন্য আট দশ দিনের মতোই মনে হয়। তবে পার্থক্যটা বুঝতে শুরু করেন যখন ভাই, বোনেরা বাড়িতে আসেন। তখন আবার তার চাইতে খুশি কেউ নন। মানে তারা এলেই কেবল তার কাছে ঈদ অর্থবহ হয়ে উঠে, পরিণত হয় উৎসবে।
এবারও তেমনই কথা ছিল। ভাই-বোনেরা আসবেন, আনন্দঘন এক ঈদ উদযাপন হবে, বাড়িতে বসবে চাঁদের হাট। কিন্তু তা আর হলো কই? করোনা নামক ঘাতক ভাইরাস তাদের সব আনন্দ আয়োজনে পানি ঢেলে দিয়েছে। দেশব্যাপী অব্যাহত লক ডাউনে প্রতিবারের মতো এবার আর ভাই, বোন, স্বজনরা বাড়িতে আসবেন না। তাই মোস্তাফিজ ও তার পরিবারের ঈদও কাটবে সাদাকালো।
অবশ্য শুধু মোস্তাফিজের পরিবারেরই নয়, এবারের ঈদে অন্যান্য টাইগার সদস্য ও দেশের মানুষের এটাই অভিন্ন চিত্র। এই ঈদে অনেক কিছু নেই, প্রিয় মুখগুলো নেই, তাদের সঙ্গে দেখা নেই, কোথাও যাওয়া নেই, কোথাও গিয়ে খাওয়া নেই, কোলাকুলি করা নেই, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা নেই। অনেকগুলো ‘নেই’।
সেই ‘নেই’র মধ্যে আবার শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়েরর তাণ্ডব! যা দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেছে মোস্তাফিজের প্রিয় জন্মস্থান। একথা হলফ করে বলা যায়, দুর্যোগ বা দুঃসময় কাকে বলে তা এই মুহুর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্য সদস্যের চাইতে সহস্রগুণ বেশি অনুভব করছেন লাল সবুজের এই বোলিং বিস্ময়। করোনায় দেশের ক্রিকেট বন্ধ ঘোষণার পরই সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার তেঁতুলিয়া গ্রামে নিজবাড়িতে চলে গিয়েছেন মোস্তাফিজ। সেখানে বন্ধু, প্রতিবেশী ও পরিবারের সঙ্গে কাটছিল দুর্দান্ত সময়। করোনাকালেও সবকিছু ঠিকঠিক চলছিল।
কিন্তু আৎকাই যেন তার ছন্দপতন হলো। বুধবার (২০ মে) দেশের উপকূল অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানায় বড় ধরনের বিভীষীকার মধ্য দিয়ে গেছে মোস্তাফিজ ও তার পরিবার। তাদের বড় রকমের কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি বটে তবে প্রতিবেশীদের কাঁচা ও টিনের ঘর, বাড়ি, লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। দু’দিন আগেও যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল প্রিয় বন্ধু, চাচাদের ঘর আজ সেখানে ধ্বংসস্তুপ। যা দেখে তিনি স্তম্ভিত।
এমন ঝড়ও যেমন তিনি আগে দেখেননি তেমনি এমন ধ্বংসলীলাও নয়। এদিকে বড়ির বাইরে পানি উঠে থৈ থৈ করছে। এই সময়ে যা কিনা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। করোনাকালের দমবন্ধ ঈদে যাও ঘরের বাইরে যেয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতেন পানি ওঠায় সেপথও অবরুদ্ধ। অর্থাৎ করোনার ছোবলের পর ‘আম্পান’ ছোবলে ঈদ বলে তাদের কাছে আর কিছুই নেই।
এমন পরিস্থিতিতে তার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি। পাছে তিনি বিব্রত হন। মোস্তাফিজের বিশেষত্ব এখানেই শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেকে স্থির রাখতে পারেন। তাই প্রতিবেদকের ভরা প্রস্তাবে তিনি না করেননি। হবে হ্যাঁ, ঢালাওভাবে না বলে এই মুহুর্তে তার ক্যারিয়ারের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে সাতক্ষীরা থেকে মুঠোফোনে বলেছেন। পাঠকদের উদ্দেশ্যে সেগুলো তুলে ধরা হলো-
সারাবাংলা: এত শক্তিশালী একটি ঝড় বয়ে গেল। আপনি সাতক্ষীরায়। আপনি ও আপনার পরিবার কেমন আছেন?
মোস্তাফিজ: ঝড়ে দুই দিন বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। ক্ষয়ক্ষতি বলতে আমাদের সমস্যা হয়নি তবে যাদের কাঁচা ঘর, টিনের ঘর ছিল সব পড়ে গেছে। আমাদের শ্যামনগর থানায় বেশ ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। ঝড়ে তো ক্ষতি হয়েছেই পানিও উঠেছে। এইসব নিয়েই আছি। দোয়া করবেন।
সারাবাংলা: এবারের ঈদটা কেমন যাবে?
মোস্তাফিজ: ঈদ নিয়ে বরাবরই আমার অনুভুতি কম (হাসি)। শুক্রবারের (জুম্মার) নামাজ যেমন ঈদের নামাজও তেমনি। তবে এবারের ঈদটা অন্যান্যবারের মতো হবে না। পরিবারের সঙ্গে থাকব ঠিকই কিন্তু সবাইকে এক সঙ্গে পাব না। আমার ভাই খুলনা থেকে আসবে না, বোন থাকবে না। এর উপর আবার এই ঝড় গেল। এবার ঈদটাই হবে না।
সারাবাংলা: লকডাউনের সময় কি করে কাটাচ্ছেন?
মোস্তাফিজ: আমরা তো সবসময়ই খেলার মধ্যে থাকি। আমাদের ছুটি খুব কম হয়, সীমিত ছুটি। খেলাটাই আমাদের কাছে প্রধান। কিন্তু এখন কোনো খেলাধুলার মধ্যে নেই। এটা আমাদের জন্য কষ্ট। শুধু আমাদের জন্যই নয়, সারাবিশ্বের সবার জন্যই কষ্টের।
সারাবাংলা: করোনার সময় ফিটনেস ঠিক রাখতে বিসিবি থেকে হোয়াটসঅ্যাপে যে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল তা মেনে চলতে পারছেন?
মোস্তাফিজ: ট্রেনার ও ফিজিও আমাদের কিছু ফ্রি হ্যান্ড (ব্যায়াম) হোয়াটসঅ্যাপে করতে দিয়েছে। সেগুলো করতে হচ্ছে। শুধু আমিই না সব প্লেয়াররাই করছে।
সারাবাংলা: জনশ্রুতি আছে, আপনি টেস্ট ক্রিকেট খেলতে চান না। কেন?
মোস্তাফিজ: যারা বলেছে, ভুল বলেছে। আমি সব ক্রিকেটই খেলতে পছন্দ করি। হোক ওয়ানডে কিংবা টেস্ট। খেলার সময় দলের বাইরে থাকলেই আমার কষ্ট লাগে। আমি খেলে অভ্যস্ত। খেলার বাইরে থাকা আমার জন্য শাস্তি। দেখি চেষ্টা করছি যেন টেস্টটা ভালো খেলতে পারি।
সারাবাংলা: আপনার কী মনে হয় ইনজুরি কিছুটা হলেও আপনার ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে?
মোস্তাফিজ: প্রতিটি প্লেয়ারেরই কম বেশি ইনজুরি হয় এবং আসবেও। বিশেষ করে পেস বোলারদের বেশি আসে। এটা নিয়েই চলতে হবে।
সারাবাংলা: আপনার ঘাঁড়ের ওই ব্যথা কি এখনো আছে?
মোস্তাফিজ: না!
সারাবাংলা: লম্বা সময় যাবৎ আপনি নতুন বলের ভেরিয়েশন নিয়ে কাজ করছিলেন। কতদূর এগুতে পেরেছেন বলে মনে হয়?
মোস্তাফিজ: গিবসন (ওটিস গিবসন) আসার আগে আমি চেষ্টা করছিলাম কি করে নতুন বলে বল করতে পারব, কি করে সফল হতে পারব। গিবসন আসার পরে কিছুদিন কাজ করেছিও। আমার মনে হয় বেশ এগিয়েছিলামও। করোনার কারণে পিছিয়ে গেছি। আবার অনুশীলন করে আনতে হবে।
সারাবাংলা: আপনার কি মনে হয় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এখন ক্রিকেট শুরু করা সম্ভব?
মোস্তাফিজ: আমার মনে হয় না। কারণ আগে জীবন। এখন খেলতে গেলে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে।
সারাবাংলা: করোনা শেষে ক্রিকেট শুরু করা কতটা কঠিন হবে?
মোস্তাফিজ: একটু কঠিন তো হবেই। লম্বা সময় ঘরে বসা। এই সময়ে শুধুই ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছি। স্কিল ট্রেনিং (ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং) তো আর করতে পারিনি। ফিটনেস ট্রেনিং যাও করেছি ঘরে বসে। সেটাও আন্তর্জাতিক ম্যাচের জন্য পর্যাপ্ত না।
সারাবাংলা: তাহলে আপনি চাচ্ছেন যে করোনা শেষ হলে আগে ফিটনেস এবং স্কিল ক্যাম্প হোক।
মোস্তাফিজ: অবশ্যই! মাস খানেকের একটা ক্যাম্প হলে খুবই ভালো হয়। তাছাড়া যদি প্রিমিয়ার লিগেও খেলতে পারি তাহলেও হয়।
সারাবাংলা: আপনাকে ধন্যবাদ।
মোস্তাফিজ: আপনাকও।