টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং শেখাল ইংল্যান্ড-পাকিস্তান
৩ নভেম্বর ২০২১ ১৪:১৩
টি-টোয়েন্টি মানেই চার-ছক্কার ফুলঝুড়ি— বেশিরভাগ দর্শকদের প্রত্যাশাটি ঠিক এমনই। তবে দিনশেষে খেলাটা যখন ক্রিকেট, তখন ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং না করে বলে বলে চার-ছক্কার জন্য ব্যাট হাঁকানোটা কোনো কাজের কথা নয়। তার প্রমাণ আগেও ছিল, চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তেমন উদাহরণ অপ্রতুল নয়। এর বিপরীতে ম্যাচ টেম্পারমেন্ট অনুযায়ী ব্যাট চালিয়ে কীভাবে ম্যাচে নিজেদের ধরে রাখা যায়, তারই নজির দেখাল সুপার টুয়েলভের দুই গ্রুপের ফেভারিট দুই দল ইংল্যান্ড আর পাকিস্তান। দুই ম্যাচের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। কিন্তু এরকম ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কীভাবে ব্যাট চালিয়ে ম্যাচ বের করে নিয়ে আসা যায়, সেটিরই প্রমাণ মিলল। বলা বাহুল্য, দুইটি ম্যাচেই জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছে দল দুইটি।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ইংল্যান্ড ছিল টপ ফেভারিট দলের একটি। সে তুলনায় পাকিস্তানের পক্ষে বাজির ঘোড়া খুব বেশি মানুষ ধরেননি বিশ্বকাপ শুরুর আগে। তবে সুপার টুয়েলভের শুরু থেকেই ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে নিজেদের প্রমাণ করেই টুর্নামেন্ট ফেভারিট হিসেবে পাকাপোক্ত আসন করে নিয়েছে পাকিস্তান। সে হিসাবে সোমবারের (১ নভেম্বর) ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে স্পষ্ট ফেভারিট ছিল ইংল্যান্ড। টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্সের বাইরেও সহযোগী দেশ নামিবিয়ার বিপক্ষে মঙ্গলবারের (২ নভেম্বর) ম্যাচে পাকিস্তানকে ফেভারিট না মনে করার কোনো বিকল্প ছিল না। দুই ম্যাচের রেজাল্ট সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী হলেও প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ড আর পরের ম্যাচে পাকিস্তানের ব্যাটিং ছিল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য অনুসরণযোগ্য উদাহরণ।
ইংল্যান্ড-শ্রীলংকা ম্যাচে প্রথম ওভারেই ১২ রান তুলে নিয়ে ইংল্যান্ড বড় সংগ্রহেরই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ওভারেই জেসন রয়কে বোল্ড করে দেন হাসারাঙ্গা। এরপর পঞ্চম ওভারে চামিরার বলে দাভিদ মালান বোল্ড হয়ে গেলে ওই ওভার শেষে ইংল্যান্ডের রান দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৩৪। পরের ওভারেই হাসারাঙ্গার বলে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে পড়েন জনি বেয়ারেস্টো। ৩৫ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে তখন বেশ চাপে পড়ে যায় ইংল্যান্ড।
ওই সময় ক্রিজে ছিলেন ওপেনার জস বাটলারের সঙ্গে ইংলিশ ক্যাপ্টেন ইয়ন মরগান। তারা দু’জনেই টি-টোয়েন্টির বিধ্বংসী ব্যাটার হিসেবে সুপরিচিত। কিন্তু শ্রীলংকার বোলাররা সে সময় দারুণ লাইন-লেন্থ ধরে রেখে বল করছিলেন। সে কারণেই বাটলার-মরগানের মতো দুই ব্যাটার ক্রিজে থেকেও রান বের করতে পারছিলেন না। বেয়ারেস্টো আউট হওয়ার পর ষষ্ঠ ওভারের তৃতীয় বল থেকে দশম ওভার পর্যন্ত চার ওভার চার বল, অর্থাৎ ২৮ বলে বাটলার-মরগান রান করেছেন মাত্র ১২টি! আর ১০ ওভারে ইংলিশদের সংগ্রহ ছিল সাকুল্যে ৩ উইকেটে ৪৭।
এই পাঁচটি ওভার দেখেশুনে খেলে বোলারদের রিড করার পর একাদশ ওভার থেকে রান তোলার গতি বাড়াতে শুরু করেন বাটলার-মরগান। আর সেই কাজটি তারা এতটাই সাফল্যের সঙ্গে করেন যে শেষ ১০ ওভারে গিয়ে রান ওঠে ১১৬! ১০ ওভারের মধ্যে প্রথম ৫ ওভারে যেমন রান এসেছে ৫৮, শেষ ৫ ওভারেও রান এসেছে সমানসংখ্যক! এর মধ্যে ১৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে মরগান আউট হলেও বাটলারের ব্যাটে তাতে কোনো প্রভাবই পড়েনি।
এই ম্যাচে বিশেষ করে বাটলারের ইনিংসটা ছিল দেখার মতো। ম্যাচের ১০ ওভার পর্যন্ত সময়ে বাটলারের সংগ্রহ ছিল ৩০ বলে ২৪ রান। সেখান থেকে চতুর্দশ ওভারে গিয়ে ৪৫ বলে নিজের অর্ধশতক পূরণ করেন। এই সময়ে ১৫ বলে তিনি করেছেন ২৬ রান। মজার বিষয় হলো, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এটিই কোনো ইংলিশ ক্রিকেটারের সবচেয়ে ধীরগতির অর্ধশতক! তখনো অবশ্য বেশিরভাগ দর্শকই হয়তো ভাবেননি, এই ইনিংসেই শতকেও পৌঁছে যাবেন বাটলার।
বাস্তবতায় হলো সেটিই। ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ইনিংস যখন প্রায় শেষ, ২০তম ওভারের শেষ বলের আগে বাটলারের নামের পাশে ৬৬ বলে ৯৫ রান। চামিরার শেষ বলটিকে স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে সীমানার বাইরে আছড়ে ফেলে ৬৭ বলে ১০১ রানে গিয়ে ইনিংস শেষ করলেন বাটলার। অর্থাৎ ইনিংসের শেষ ২২ বলেই বাকি অর্ধশত রান বাটলার যোগ করেছেন নিজের নামের পাশে! ইংল্যান্ডের ইনিংস ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ১৬৩ রানের মোটামুটি নিরাপদ বন্দরেই।
উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যাওয়া পরিস্থিতিতে খানিকটা রয়েসয়ে ব্যাট করেও কীভাবে বোলারদের কচুকাটা করা যায়, তারই এক অনন্য নজির বাটলার-মরগানের এই ম্যাচের ব্যাটিং। ৩ উইকেট পড়ার পরের ৫ ওভারে তারা রয়েসয়ে না খেলে চালিয়ে খেলার চেষ্টা করলে এমন সাফল্য পাওয়া সম্ভব হতো না— সহজ ক্রিকেটীয় জ্ঞান বলে সেটিই।
ভারতকে উড়িয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করা পাকিস্তানের জন্য নামিবিয়া তুলনামূলকভাবে সহজ প্রতিপক্ষই ছিল। আফগানিস্তানের সঙ্গে চাপে পড়েও ম্যাচ বের করে নিয়ে আসা পাকিস্তানের বিপক্ষে নামিবিয়ার জয়ের ‘আপসেট’ তাই আশা করেনি কেউই। পাকিস্তান টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়ার পরও তাই রানের পাহাড়ই ছিল প্রত্যাশিত। হয়েছেও সেটি, তবে তার জন্যও একটা সময় পর্যন্ত লড়াই করতে হয়েছে পাকিস্তানি ব্যাটারদের।
মোহাম্মদ রিজওয়ানকে স্ট্রাইকে রেখে মেডেন ওভারে শুরু হয় নামিবিয়ার বোলিং ইনিংস। ফর্মে থাকা রিজওয়ান আর বাবর আজম এর মধ্যে ব্যাট চালানোর চেষ্টা করলেও খুব একটা সাফল্য পাচ্ছিলেন না। সব মিলিয়ে পাওয়ার প্লে’র ৬ ওভারে দু’জনে মিলে রান তোলেন মাত্র ২৯! হাত খুলে খেলতে পারছিলেন না কেউই। তবে ধৈর্যহারা হননি রিজওয়ান-বাবর। সপ্তম, অষ্টম ও নবম ওভারও তাদের কেটেছে বাউন্ডারি ছাড়াই। তবে স্ট্রাইক রোটেট করে খেলেছেন।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে কোনো উইকেট না হারিয়ে পাওয়ার প্লে’তে এটি চতুর্থ সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহ। পাওয়ার প্লে’তে কোনো উইকেট না হারিয়ে সর্বনিম্ন রান গিব্রাল্টার। ২০১৯ সালে স্পেনের বিপক্ষে এই রান করেছিল তারা। ২০১৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতের বিপক্ষে করেছিলেন ২৩। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ওমানের বিপক্ষে বাংলাদেশ কোনো উইকেট না হারিয়ে তুলেছিল ২৯। আর এদিন নামিবিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তান পাওয়ার প্লে থেকে কোনো উইকেট না হারিয়ে তোলে ২৯ রান।
ইনিংসের অর্ধেক, অর্থাৎ ১০ ওভারে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের রান দাঁড়ায় বিনা উইকেটে ৫৯। সেখান থেকে ইনিংস শেষে পাকিস্তানের রান গিয়ে পৌঁছে ১৮৯ রানে! অর্থাৎ শেষ ১০ ওভারে পাকিস্তানি ব্যাটাররা রান তুলেছেন ১৩০টি! এর মধ্যে একাদশ থেকে পঞ্চদশ— এই ৫ ওভারে রান এসেছে ৫৯। আর বাবর আজম আউট হওয়ার পর ফখর জামানও মাত্র ৫ রানে আউট হলেও পাকিস্তান ক্রিকেট দলের প্রফেসরখ্যাত মোহাম্মদ হাফিজ গিয়ে তাণ্ডবলীলা অব্যাহত রাখেন। ততক্ষণে রিজওয়ানের ব্যাটও অনেকটাই চওড়া হয়ে গেছে। তাতে শেষ ৫ ওভারে পাকিস্তান রান তুলেছে ৭১! এর মধ্যে অবশ্য রিজওয়ান একাই শেষ ওভারে স্মিটকে তুলোধুনো করে তুলে নেন ২৪ রান।
ইনিংস শেষের স্কোরকার্ড বলছে, রিজওয়ান ৫০ বলে ৭৯ রানে অপরাজিত। আর মোহাম্মদ হাফিজের নামের পাশে ১৬ বলে ৩২, অর্থাৎ ঠিক ঠিক ২০০ স্ট্রাইক রেটের একটি ইনিংস। রিজওয়ানের ব্যাটিং ইনিংসটা যদি একটু কাটাছেড়া করা যায় তাহলে বেরিয়ে আসবে দেখার মতো আরও কিছু তথ্য। ব্যাট হাতে প্রথম দিকে ধীরে শুরু করা রিজওয়ান ২৫টি বল খেলে করেছিলেন মাত্র ১৬ রান। আর পরের ২৫ বলে রিজওয়ান সংগ্রহ করেন ৬৩ রান। প্রথম ২৫টি বলের মধ্যে রিজওয়ানের বাউন্ডারির সংখ্যা ছিল মাত্র একটি। আর পরের ২৫ বলে ৪টি ছয়ের সঙ্গে তিনি চার মারেন আরও ৭টি। অর্থাৎ গোটা ইনিংস তিনি সাজান ৮টি চার ও ৪টি ছক্কায়।
সুপার টুয়েলভে একটার পর একটা ম্যাচে আগের চেয়েও বাজে পারফরম্যান্স ‘উপহার’ দিয়ে আসা টাইগার ব্যাটাররাও নিশ্চয় এই দুই ইনিংস দেখেছেন। তারা নিশ্চয় দেখতে পেয়েছেন, বল ঠিকঠাকমতো ব্যাটে না এলে বাউন্ডারির জন্য ছটফট না করে কিছু ডট বল খেলেও উইকেটে থিতু হওয়া যায়। তারা নিশ্চয় দেখেছেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ডট বল কমিয়ে স্ট্রাইক রোটেট করে খেলে উইকেটে সেট হয়ে গেলে বোলারদের কচুকাটা করার সুযোগও মেলে। টাইগার ব্যাটাররাও নিশ্চয় দেখেছেন, প্রথম ১০ ওভারে টি-টোয়েন্টির জন্য একেবারেই ‘বিলো অ্যাভারেজ’ ৪৭ রান তুলেও শেষ দশ ওভারে রানের বন্যা বইয়ে দেওয়া যায়! তারা দেখেছেন নিশ্চয়, কিছু শিখেছেন কি?
ভারতের আয়োজনে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। এবারের বিশ্বকাপের সবকটি ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচার করবে দেশের জনপ্রিয় স্যাটেলাইট চ্যানেল জিটিভি। এছাড়াও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম র্যাবিটহোলের ওয়েবসাইটে দেখা যাবে বিশ্বকাপের খেলা। অনলাইনে র্যাবিটহোলে খেলা দেখতে ব্রাউজ করুন — https://www.rabbitholebd.com/
সারাবাংলা/টিআর/এসএস
ইংল্যান্ড দল জস বাটলার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পাকিস্তান দল মোহাম্মদ রিজওয়ান