Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অপেক্ষায় থাকলেও আজ তাদের ক্লান্তি নেই, পথে পথে মিষ্টি বিতরণ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:৫৫

ঢাকা: ‘আজ কোনো কষ্টই হচ্ছে না রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে। রোদের তাপকেও তেমনভাবে অনুভূত হচ্ছে না। মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য আজ আনলিমিটেড বাজেট। কিন্তু এদিকটায় তেমন কোনো দোকানে বেশি মিষ্টি নাই। যা ছিল তা কিনে বিলিয়ে দিয়েছি। আজ কোনো কথা হবে না। খালি একটাই নাম আর তা হলো, বাংলাদেশ। হ্যাঁ আমরা আজকে শিরোপা জিতেছি, আমাদের মেয়েরা মাঠে খেলে জয়ী হয় আমাদের জন্য সেই শিরোপা আনছে।’ না কথাগুলো প্রতিবেদক নিজে বলেননি। বিমানবন্দর সংলগ্ন আশকোনা হাজী ক্যাম্পের রাস্তার শুরুতে থাকা একটা মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিবেদককে নিজের অনুভূতি এভাবেই বলছিলেন মদনপুর থেকে আসা মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম।

পেশায় নিজেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন ৬৯ বছর বয়সী নুরুল ইসলাম।

নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সকালবেলা এসে মন খারাপ হয়েছিল। কেউ দেখি নাই এমন একটা অবস্থা। ভাবছিলাম আমাদের সময়ের কথা। বিকালে ম্যাচ শুরু হলে সেদিন অফিসে দুপুরের পরেই আমাদের অস্থিরতা শুরু হয়ে যেতো। এখন তো আর আগের সেই দিন নাই। কিন্তু তাও মেয়েরা দেশের সম্মান বাড়িয়েছে অনেক। সেজন্যেই বাসা থেকে সকাল সকাল চলে এসেছিলাম। কিন্তু এখন দেখি আবার মানুষজন আসছে। এটা দেখেই ভালো লাগছে। তবে কতটা ভালো লাগছে?— সেটা বলে বোঝানো সম্ভব না।’

একটু সামনেই দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। শিরোপাজয়ী দলের সদস্যদের বরণ করতে এসে মিষ্টি বিতরণ করছেন কামরুজ্জামান খান, গুলশাহানা ঊর্মিসহ আরও বেশ কয়েকজন।

দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নেপালকে হারানোর পর থেকেই শিরোপা জয়ী দলের খেলোয়াড়দের বরণের অপেক্ষায় ছিলেন তারা। আর তাই শিরোপাজয়ী সাবিনা খাতুন-সানজিদা-কৃষ্ণা-রুপনাদের আগমনে সবার মাঝে মিষ্টি বিতরণ করছেন তারা।

যারা মিষ্টি গ্রহণ করছিলেন তারাও কিন্তু একদম চুপ করে ছিল না। জয় বাংলা স্লোগানের পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেনো আরও অনেক উপলক্ষ বাংলাদেশের সন্তানেরা নিয়ে আসতে পারে সেই দোয়াই করছিলেন।

বিমানবন্দরের ঠিক উল্টোদিকে পুলিশ ফাঁড়ির পাশেই ছোট কিছু দোকান আর সেখানে জট বেধে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েকজন। সবার নজর বিমানবন্দর থেকে বের হওয়া রাস্তার দিকে। কিছু একটা খুঁজছিলেন— এমন অবস্থায় প্রতিবেদক কথা বলেন তাদের সঙ্গে।

শোভন ইসলাম নামে একজন যুবক জানালেন তারা ময়মনসিংহ থেকে মহাখালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন বাসে। কিন্তু বিমানবন্দর বাস স্টপেজ আসার অনেক আগেই জসীমউদ্দিন থেকে জ্যাম শুরু হয়। কথা বলে জানতে পারেন, সাফের শিরোপা নিয়ে আজ দেশে ফিরছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। তাই সিগন্যালের জ্যামে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

শোভন ইসলাম বলেন, ‘অন্য সময় আমাদের এই ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটে গাজীপুরের পর থেকেই বিরক্ত লাগা শুরু হয়। কিন্তু আজ এত কাছে এসেও সিগন্যালে আটকে থাকলেও মন খারাপ লাগছে না। গাড়ির অন্যান্য যাত্রীদের নিয়েই সামনে এগিয়ে আসলাম। বাসচালককে বলেছি সিগন্যাল ক্লিয়ার হলে আমাদের এখান থেকে তুলে নিয়ে যেতে।’

পাশে থাকা রাব্বী হাসান নামে আরেকজন এসময় বলে উঠেন, ‘মাঠে খেলে যারা দেশের জন্য শিরোপা জিতেছে তাদের জন্য অপেক্ষা করাতে কষ্ট কেনো হবে? বরং আরও আফসোস বাড়ছে আশেপাশে কোনো ফুলের দোকান না পাওয়ায়। তাদেরকে ফুল ছিটিয়ে বরণ করা দরকার ছিল আমাদের সবার।’

একটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা গেলো বিমানবন্দর থেকে কাউলামুখী রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি গাড়ি।

সিগন্যালের কারণে ট্রাফিক জ্যামে অপেক্ষায় থাকলেও আজ বিন্দুমাত্র ক্লান্তবোধ করছেন না বলে জানালেন রাগীব চৌধুরী।

নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সোনালী ব্যাংকে চাকরি থেকে অবসর নিলাম গতমাসে। দীর্ঘ একটা সময় ছিল যখন আমরা প্রতিটা ম্যাচ দেখার জন্য যেতাম স্টেডিয়ামে। এখন তো আর সেই জোয়ার দেখা যায় না। আগে খেলা দেখতে যখন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যেতাম তখন এমনও দিন গেছে যে আমাদের ৩ থেকে ৪ মাইলও হাঁটতে হয়েছে জ্যাম পাড়ি দিতে। কিন্তু কখনো নিজেদের ক্লান্ত লাগে নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেই সময়গুলো এখন আর নেই। তাই কিছুটা আক্ষেপ হয়। তবে আজ বিশ্বাস করেন এখানে মেয়েগুলোকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে তা দেখে বুকটা চওড়া হয়ে গেছে। দেশের জন্য শিরোপা জেতাটা আমাদের কাছে স্বপ্নের মতো হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এই মেয়েরা সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে।’

‘এক সময় সালাউদ্দিন-মোনেম মুন্না-আসলাম-সাব্বিরদের কাছে আমরা শিরোপা আশা করতাম। এখন থেকে আমরা এই মেয়েদের কাছ থেকেও শিরোপার আশা করতে পারি যা তারা করে দেখিয়েছে। এমন সোনার টুকরোদের জন্য অপেক্ষায় কোনো ক্লান্তি নাই। আফসোস হচ্ছে আগে না জানার কারণে আমার নাতনিটাকে নিয়ে বের হতে না পারায়। ওকে তখন দেখাতাম ট্রফি হাতে মাথা উঁচু করে রাজধানীর বুকে সবার সামনে যাওয়াটা দেশের সবার জন্য কতটা আনন্দের, কতটা গর্বের।’—আরও বলেন রাগীব চৌধুরী।

এর আগে সর্বশেষ ১৯৯৯ সালেও সাফজয়ী পুরুষ দলের সদস্যদের বরণ করে নিতে বিমানবন্দরে ছিলেন বলে জানান রাগীব চৌধুরী।

বিমানবন্দরের বাইরের সড়কে তখন কেউ সেলফি তুলে, কেউবা পতাকা উঁচু করে ধরে আকাশের উড়িয়ে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করছিলেন। পিছিয়ে ছিলেন না ক্রিকেট ভক্তরাও। বিভিন্ন এলাকার ক্লাবের ব্যানারে, এলাকার নাম লেখা ব্যানারও নিয়ে আসেন। জয় বাংলা, বাংলাদেশ-বাংলাদেশ বলে মুখরিত পুরো এলাকা।

দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ফুটবল দলের খেলোয়াড়, কোচ ও কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে পৌঁছেছেন— এমন সংবাদ শুনেই উল্লাসের মাত্রা যেনো আরও বেড়ে যায় সবার মাঝে। আর সেই উল্লাস ও স্লোগানের টানে গাড়িতে বসে থাকা মানুষরাও সামনে এগিয়ে এসে শামসুন্নাহার-রুপনাদের একনজর দেখার আশায় অপেক্ষায় থাকা শুরু করে।

ঘড়ির কাটায় যখন ৩ টা ৩২ মিনিট ঠিক তখনই চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে ছাদখোলা বাসের শোভাযাত্রাটি শুরু হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ঘিরে রাখলেও আজ তারাও যেনো গর্বিত চ্যাম্পিয়ন দলের ট্রফির সঙ্গে নিজেদের জড়াতে পেরে। পেশাগত কারণে নাম পরিচয় দিয়ে কথা না বললেও তাদের মাঝে অনেকেই জানান সেই উল্লাসের কথা।

গাড়ি বহর যতই এগুতে থাকে ততই বাড়ে রাস্তার দুই পাশের ভিড়। সাফজয়ীরাও হাত নেড়ে উচ্ছাস প্রকাশ করেন ও হাসিমুখে হাত নেড়ে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখান।

খোলা ছাদের বাসে সামনে ট্রফি হাতে রয়েছেন অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। তার পাশে সানজিদা, মাশুরা পারভীনরা রয়েছেন।

বাস এগিয়ে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে। গন্তব্যস্থল আজ মতিঝিলের বাফুফে ভবন যেখানে তাদের বরণ করে নিবেন কাজী সালাউদ্দিন।

তবে তার আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন দলের সবাইকে ফুল ছিটিয়ে বরণ করে নিচ্ছে সাধারণ জনগণ। আজ তাদের কারো মাঝেই নেই কোনো ক্লান্তি। অপেক্ষার কোনো আক্ষেপও আজ তাদের নেই। কারণ তারা মাঠে খেলে জয় ছিনিয়ে এনেছে বলেই আজ দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন দেশের নাম বাংলাদেশ।

সারাবাংলা/এসবি/এসএস

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন রাজকীয় সংবর্ধনা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর