Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ব্রাজিল ফুটবলে দুর্নীতি

মো. সাইফুল আলম তালুকদার
৮ জুলাই ২০২৩ ০৯:৫৮

ব্রাজিলে দুর্নীতির এতই প্রসার যে তাদের দেশের দুর্নীতিকে রাস্তার পাশে ছেলেদের ফুটবল খেলার মতই সাধারণ ব্যাপার হিসেবে গণ্য করা হয়। রোমিও আরও প্রায় পাঁচ-সাত বছর আগেই বলেছিলেন, ব্রাজিলের ফুটবল প্রায় পুরোটাই পচে গেছে, কারণ তাদের দেশের ফুটবল ফেডারেশন বহু বছর ধরে দুর্নীতির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।

হঠাৎ করেই ব্রাজিল ফুটবলের দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ এলো ফার্নান্দো দিনিজকে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ মনোনীত করার পরেই।

বিজ্ঞাপন

ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের খামখেয়ালির একটি ধারণা পেতে পারেন ২০০৬ সাল থেকে। জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার আগে ব্রাজিল দল সুইজারল্যান্ডে দুই সপ্তাহের ক্যাম্প করেছিল। বিশ্বকাপের আগে সাধারণত দলগুলো ক্লোজড ডোর ব্যবস্থায় প্রশিক্ষণ করে থাকে। কিন্তু সেবার সুইজারল্যান্ডে ব্রাজিল দলের প্রশিক্ষণ প্রত্যক্ষ করেছিল প্রায় ৪৮ হাজার দর্শক যা থেকে তাদের আয় হয়েছিল প্রায় ৭.২ মিলিয়ন ডলার। আয় করা খারাপ কিছু নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা কি ঘটেছিল, খেলোয়াড়রা দর্শকদের উপস্থিতিতে নিজেদের কারিকুরি দেখানো, অটোগ্রাফ দেওয়া, ছবি তোলা এসব সাধারণ ব্যাপারে ব্যস্ত সময় পার করেছে। এই ব্যাপারটা নিয়েও হয়তোবা খুব একটা মাথা ব্যথা হবার কথা নয় যেহেতু ব্রাজিল ছিল সেবার বিশ্বসেরা দল। পয়সা কামানোই যেহেতু মূল লক্ষ্য, তার উদাহরণ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে তাকালে আর বুঝতে সময় লাগবে না।

২০০৬ সালে তারা বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে, যাতে ব্রাজিল দল ইউরোপে প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলতে পারে, যার ধারাবাহিকতায় ২০১২ সাল থেকে ২০২২ সালের বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত ব্রাজিল ৬০টি ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলে যার মধ্যে মাত্র ১১টি অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রাজিলে। সেটাও হয়তোবা দোষের কিছু না। দোষটা হচ্ছে ইউরোপে প্রস্তুতি ম্যাচ খেললেও বেশিরভাগ দলগুলো ছিল দুর্বল দল (বিশ্বকাপ জেতার পর আর্জেন্টিনাও এই ধারা অব্যাহত রেখেছে), ফলে আগে যেরকম বড় বড় দলগুলোর সাথে প্রস্তুতি খেলতো সেই ধারাবাহিকতা থেকে ব্রাজিল অনেকটাই সরে এসেছে। সবচেয়ে দূষণীয় বিষয়টি হচ্ছে, টিকিট বিক্রি বা স্পন্সরশিপের দিকে নজর দেওয়ার কারণে এই সমস্ত ম্যাচগুলোতে সবসময়ই মূল একাদশের খেলোয়াড়দের সুযোগ দেয়া হতো যার কারণে তরুণ বা প্রতিশ্রুতিশীল খেলোয়াড়রা সুযোগ কম পেত। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, মূল একাদশের কোনো খেলোয়াড় যদি আঘাত সাসপেনশনজনিত কারণে খেলতে না পারতেন, তাহলে তার জায়গায় বদলি খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম খেলোয়াড়ের সমান মার্কেট ভ্যালু আছে এমন খেলোয়াড়ই সুযোগ পেতেন চুক্তির শর্তানুযায়ী, যেখানে বদলি খেলোয়াড়ের ট্যাকটিকাল বা টেকনিক্যাল স্কিল প্রাধান্য পেত না।

বিজ্ঞাপন

এবার আসা যাক ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনে যাকে দুর্নীতির গডফাদার বলে ডাকা হতো, সেই ব্রাজিলিয়ান জোয়াও হ্যাভেলাঞ্জ প্রসঙ্গে। তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ফিফার প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে ৫০ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।‌‌ তার মেয়ে জামাই রিকার্ডো টেক্সেইরা ছিলেন আরও ভয়ংকর, তিনি ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান ছিলেন ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। তাকে ফিফা প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ নেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। এত কিছুর পরেও তারা সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতেন। হ্যাভেলাঞ্জ পরাপারে পাড়ি জমিয়ে সবাইকে ফাঁকি দিয়েছেন আর টেক্সেইরা পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ১০-২০ মিলিয়ন মূল্যের ভিলায় থাকতেন। কিছু বছর পালিয়ে থেকে পরবর্তীতে তিনি আবার ব্রাজিলে ফিরে আসেন। যদিও তিনি পরে ২০১৯ সালে ফিফা তাকে ফুটবল থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

এই দুজনের পরবর্তীতে যারা ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান হয়েছেন তারা সবাই ছিলেন এদেরই গ্যাং। ২০১৫ সালে, ফিফা-গেট কেলেঙ্কারিতে ব্রাজিলের তৎকালীন ফুটবল প্রধান মারিয়া মারিনকে (২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান) গ্রেপ্তার করা হয় এবং শেষপর্যন্ত মার্কিন আদালতে চাঁদাবাজি, জালিয়াতি এবং অর্থপাচারের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এখানেই শেষ নয়। মারিনের উত্তরসূরি মার্কো পোলো দেল নেরোর (যিনি তখন ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন) উপর টেক্সেইরার মতো আজীবন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় এবং ঘুষ নেওয়ার দায়ে মিলিয়ন ডলার জরিমানা করা হয়।

দেল নেরোর পরবর্তী উত্তরসূরি, রোজেরিও ক্যাবোক্লো একসময় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেডারেশনের প্রধান পদ জিতেছিলেন। সমালোচনার কারণে পরে ভোটের মাধ্যমে জিতে আসলেও সেখানে টাকার খেলা দেখিয়েছিলেন। ব্রাজিলের প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগে খেলার তত্ত্বাবধানকারী ২৭টি রাজ্যের ফুটবল সংস্থাকে প্রতিমাসে ২০,৬০০ এবং ব্যক্তিগত খরচের জন্য প্রতিটি রাজ্য সংস্থার সভাপতিকে প্রতিমাসে ৫,৫০০ করে ঘুষ হিসেবে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল। যে অ্যাসেম্বলিটি নতুন ভোটিং সিস্টেমকে অনুমোদন করেছিল সেটি বেআইনি ছিল, কারণ সেখানে শুধুমাত্র ফেডারেশনের সভাপতিরা উপস্থিত ছিলেন।

ঘটনা প্রবাহে দেখা গেছে দিনে দিনে ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলেও দর্শক সংখ্যা কমে গেছে এবং বড় বড় ম্যাচেও মাঠগুলো প্রায়ই ফাঁকা থাকতো। তাই ২০১৮ সালে বিশ্বকাপ শুরুর আগে এক জরিপে দেখা গেছে ৫৩ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান বিশ্বকাপ নিয়ে কোন উন্মাদনা অনুভব করছেন না, অথচ ১৯৯৪ বিশ্বকাপের সময় এই হার ছিল মাত্র ২৪ শতাংশ।

গত বছরের ডিসেম্বরে ব্রাজিল ফুটবলে কেন কোচদের দুর্দশা যাচ্ছে তা নিয়ে একটা লেখাতে উল্লেখ করেছিলাম, তাদের দেশে সাধারণত কোন কোচই দুই-তিন বছর তো দূরের কথা এক বছরের মেয়াদও সম্পন্ন করতে পারেন না। তিন-চারটি ম্যাচ যেতে না যেতেই কোচেরা বহিষ্কারের আশঙ্কায় থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত পনের-ষোলটি ম্যাচ শেষ হতে ক্লাব থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। ফলে ব্রাজিলের সেই আগেরকার দৃষ্টিনন্দন খেলা ক্লাব ফুটবল থেকে বিদায় নিচ্ছে, কারণ কোচেরা চাকরি বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে দলকে দীর্ঘমেয়াদে কিভাবে গড়ে তুলবেন তার পরিবর্তে পয়েন্ট পেতে গায়ের জোরের ফুটবল খেলিয়ে যাচ্ছেন।

তার সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে ম্যাচ পাতানোর প্রতিযোগিতা। গত বছর ব্রাজিলিয়ান লিগে বেশ কয়েকটি ম্যাচে গড়পেটা করার অভিযোগ উঠে এবং এই নিয়ে বর্তমানে তদন্ত চলছে। শোনা গেছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য ম্যাচ প্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার ডলার দেওয়া হচ্ছে, যার কারণে খেলোয়াড়রা প্রতিপক্ষকে জিতিয়ে দিতে ইচ্ছাকৃত হলুদ কার্ড খাচ্ছেন বা কর্নার দিয়ে দিচ্ছেন। ব্রাজিলের ৬টি রাজ্য এবং ১৬টি শহরে তদন্ত চালানোর সময় এই কথাগুলো বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় স্বীকার করেন।

এই যদি হয় ব্রাজিল ফুটবলের হালচাল তবে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের সময় স্টেডিয়াম সংক্রান্ত আর্থিক ঘটনাবলীতে নয়-ছয় থাকার ঘটনা তো বেশ স্বাভাবিক হওয়ারই কথা। ১২টি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ হওয়া ম্যাচগুলোর ৬টিতে নানা রকম অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। একটি স্টেডিয়ামে এ সি লাগানোর খরচ প্রায় ১২০০ শতাংশের বেশি দেখানো হয়েছে। আর ঐতিহ্যবাহী মারাকানা স্টেডিয়ামর সংস্কার কাজে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি।

শেষ করব, আমাদের অতি প্রিয় কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে। যিনি কিনা ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের দুর্নীতি এবং খেলার মান ধীরে ধীরে কমে যাওয়ার ঐতিহ্য অনুসরণ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর