অপেক্ষা ঘুচল ১৫ বছরের, উইন্ডিজে টেস্ট জিতল ‘নতুন বাংলাদেশ’
৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৪:০৩ | আপডেট: ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:১৭
নেই সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমের মতো সিনিয়র ক্যাম্পেইনার। নিয়মিত অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও ওয়েস্ট ইন্ডিজে যাননি চোটে পড়ে। দলের নতুন অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রথম টেস্টেই ২০১ রানে বিধ্বস্ত। তবে দ্বিতীয় টেস্টে অনবদ্য এক কামব্যাক করল বাংলাদেশ। মাত্র এক টেস্ট বয়সী অধিনায়ক মিরাজের অধীনেই জ্যামাইকায় দ্বিতীয় টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১০১ রানে হারিয়ে সিরিজ শেষ করল সমতায়। চতুর্থ দিন ২৮৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে তাইজুল ইসলামের ঘূর্ণি জাদুর সাথে তাসকিন আহমেদ-হাসান মাহমুদদের বোলিং তোপে ক্যারিবিয়ানরা অল আউট ১৮৫ রানে।
উইন্ডিজের মাটিতে ১৫ বছরের জয়খরা কাটানোর এই ম্যাচ এলো তাদের বিপক্ষে পঞ্চম জয় হয়ে। প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে এক বছরে বাংলাদেশ জিতল তিন টেস্ট।
জ্যামাইকার স্যাবাইনা পার্কে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করা কতটা কঠিন? একটা পরিসংখ্যান জানিয়ে রাখি। এই মাঠে চতুর্থ ইনিংসে ২৩ ম্যাচে ২০০ বা ততোধিক রান তাড়া করে জেতা ম্যাচের সংখ্যা মাত্র দুই। আজ উইন্ডিজের সামনে জয়ের জন্য বাংলাদেশ যে লক্ষ্য সেট করে দিয়েছিল, সেটাও রয়ে গেল স্যাবাইনা পার্কের ‘অজেয়’ খাতায়।
রান তাড়ায় নেমে লাঞ্চ ব্রেকের ঠিক আগের ওভারেই তাইজুলের স্পিন জাদুর সামনে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাইজুলের ফুল লেংথ বলে লেগ সাইডে খেলতে গেলেন মিকাইল লুই। ব্যাটের ভেতরের অংশ আর জুতায় লেগে ক্যাচ উঠল শর্ট লেগে।দৌড়ে এসে ধরলেন শাহাদত দীপুর। খালি চোখে দেখে মনে হচ্ছিল পিচে লেগে ক্যাচ উঠল বুঝি। টিভি রিপ্লেতে বেশ কয়েকবার দেখার পর নিশ্চিত হয়ে লুইকে আউট দেন আম্পায়ার।
লাঞ্চ ব্রেক থেকে ফেরার পর রান তোলার তাড়া দেখা যাচ্ছিল উইন্ডিজ ব্যাটারদের মধ্যে। জমে ওঠে ব্রাথওয়েট-কার্টি জুটি। সেটা ভাঙতে বেশি সময় নেননি তাসকিন। তার অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা মেরে লিটনের হাতে ক্যাচ দেন কার্টি। দুই উইকেট হারিয়ে অবশ্য তখন সাবধানী ব্যাটিং করতে থাকে ক্যারিবিয়ানরা। তবে সেই প্রতিরোধে চিড় ধরাতে দৃশ্যপটে আবার আবির্ভূত হন তাইজুল। যিনি নিজ হাতে লিখেছেন এরপরের গল্পটা।
ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক ব্রাথওয়েটকে ফিরিয়েছন দারুণ এক টার্নিং ডেলিভারিতে। তাইজুলের ফুল লেংথ বলে ডিফেন্ড করতে চেয়েছিলেন এই ডানহাতি। গ্লাভস ছুঁয়ে বল উড়ে যায় ফার্স্ট স্লিপের ওপর দিয়ে। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন মাহমুদুল হাসান জয়। এক ওভার পর বোলিংয়ে ফিরে আবারও তাইজুল হাজির হলেন নিজের স্পিন জাদুর ঝুলি নিয়ে। আলিক অ্যাথানজকে যেভাবে বোল্ড করেছেন, তাতে তার জন্য আপনি হাততালি দিতে বাধ্যই হবেন। অফস্টাম্পের বাইরে পড়া বল দেখে ড্রাইভ খেলার লোভ সামলাতে পারেননি অ্যাথানজে। তাইজুলের টার্নে পরাস্ত হয়ে সেটার খেসারতও দিয়েছেন বোল্ড হয়ে। সেই উইকেটটা পাওয়ার পর তাইজুলের উদযাপন ছিল দেখার মতো।
একপ্রান্তে টানা কয়েক উইকেট পড়লেও উইন্ডিজের জয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন কাভেম হজ। ফিফটি করে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন আশার সলতে। মিটিমিটি জ্বলা সেই সলতে নিভিয়েছেন তাইজুলই। উইকেটে থিতু হওয়া হজকে বল করেছেন ফুল লেংথে। পেছনের পায়ে খেলতে গিয়ে ব্যাটে-বলে হয়নি। প্যাডে লাগার পর জোর আবেদন বাংলাদেশের। আউট দিলেন আম্পায়ার। রিভিউ নিয়েও ব্যর্থ হজ। ক্যারিয়ারের ১৫-তম ও দেশের বাইরে সাকিব আল হাসানের সমান পাঁচবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেছেন জশুয়া ডি সিলভাকে একই স্টাইলে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে। এর আগে তাসকিন বোলিংয়ে ফিরে দুর্দান্ত এক ইনসুইংগারে উড়িয়েছেন প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি করা জাস্টিন গ্রিভসের স্টাম্প। শেষ তিন উইকেটের দুটো নিয়েছেন হাসান মাহমুদ, একটা নাহিদ রানা।
২১১ রানের লিড নিয়ে চতুর্থ দিনের খেলা শুরু করে বাংলাদেশ। এর আগেরদিন আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন সাদমান ইসলাম, শাহাদাত দীপু, মিরাজরা। সেই অ্যাপ্রোচের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছেন জাকের আলী। চতুর্থ দিন ষষ্ঠ উইকেটে তাইজুলের সাথে জাকেরের জুটি শেষ হয় ৩৪ রানে। আলজারির বাউন্সারে স্লিপে ক্যাচ দেন ৫০ বল খেলা তাইজুল। তবে অন্য প্রান্তে টেইলএন্ডারদের নিয়ে লড়াই করে গেছেন জাকের। টানা তৃতীয় ম্যাচে পেয়েছেন ফিফটি।
ক্যারিবিয়ান পেসারদের সুইং-মুভমেন্টের সুযোগই দেননি তেমন। গুড লেংথে পিচ করা বলগুলো খেলেছেন উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে। একের পর এক বাউন্সারে পুল-হুকে মেরেছেন ছক্কা। সেই ধারাবাহিকতায় দুর্দান্ত এক পুলে ছুঁয়েছেন ফিফটি। ৯১ রানে আউট হওয়ার আগে ১০৬ বলে আট চার ও পাঁচ ছক্কা মারেন জাকের। আগের দিন অসুস্থতায় শুরুর দিকে ব্যাটিং করতে না পারলেও আজ মাঠে নামেন মুমিনুল হক। তবে রানের খাতা খোলার আগেই স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন এই বাঁহাতি ব্যাটার।
প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৬৪ রানে গুটিয়ে গিয়েও নাহিদ রানার কল্যাণে ১৮ রানের লিড পায় বাংলাদেশ। তরুণ এই গতিময় পেসারের অগ্নিঝরা বোলিংয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নাহিদের দেড়শো ছুঁইছুঁই গতির একেকটা ডেলিভারিতে নাভিশ্বাস উঠেছিল তাদের। ক্রেইগ ব্রাথওয়েট, মিকাইল লুই, কাভেম হজ, আলজারি জোসেফের পর কেমার রোচকে ফিরিয়ে প্রথমবারের মতো নেন টেস্টে পাঁচ উইকেট।
সিরিজের প্রথম টেস্টে ২০১ রানে হারের পর দ্বিতীয় টেস্টে এভাবে ফেরা বাংলাদেশের জন্য অনেক পাওয়ার। টানা পাঁচ ম্যাচ হারের পর জয়ের দেখা পাওয়াটা স্বস্তির। প্রাপ্তির খাতায় এই টেস্টে আছে অনেক কিছু। বিপদের মুখে জাকের আলীর পাওয়ার হিটিং, সাহস নিয়ে ব্যাটিং, মাথা খাটিয়ে খেলা। নাহিদ রানা দেশের বাইরে আরো একবার প্রমাণ করলেন কেন তাকে নিয়ে এত আশা বাংলাদেশের। তাসকিন-হাসানরা দেখালেন বাংলাদেশের বোলিং ইউনিটকে বিশ্বমানের কেন বলা হচ্ছে। আরো প্রাপ্তি অধিনায়ক মিরাজ। দেশের বাইরে পঞ্চম অধিনায়ক হিসেবে জিতলেন টেস্ট। তার বোলিং চেঞ্জ, বোলারদের ব্যবহার করার পদ্ধতি, ফিল্ড প্লেসিং কিংবা দলকে চাঙ্গা করা; সবকিছুতেই পাশ মার্কের দাবি তিনি জানাতেই পারেন। লেটার মার্কও চাইতে পারেন হয়তো! কেন না এবারই প্রথম ‘পঞ্চপাণ্ডব’ ছাড়া কোনো টেস্ট জিতল বাংলাদেশ, তাও বিদেশ বিভূঁইয়ে।
সারাবাংলা/জেটি