এ দেশ আমাদের মা, তাকে শ্রদ্ধা করতে হবে : শাহীন সামাদ
১৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:১৬
পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির আনন্দের পাশাপাশি স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর জাতি উদযাপন করবে বিজয়ের ৪৭তম বার্ষিকী। বিজয়ের উল্লাসে মেতে উঠবে পুরো দেশ। নানা আয়োজনে স্বাধীনতার বীর যোদ্ধাদের স্মরণ করার পাশাপাশি জাতি ধিক্কার জানাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিও।
মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে সারাবাংলা ডট নেট এর পাঠকদের কাছে নিজের বিজয় ভাবনা তুলে ধরেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম কণ্ঠযোদ্ধা শাহীন সামাদ। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিসেনারা যেমন অস্ত্র দিয়ে দুর্নিবার গতিতে পাক সেনাদের পরাজিত করেছিলেন ঠিক তেমনি শাহীন সামাদ যুদ্ধ করেছেন কণ্ঠ দিয়ে। কণ্ঠকে হাতিয়ার বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছিলেন গানে গানে। বাঙালি জাতির গৌরবময় ৪৭তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে এই কণ্ঠযোদ্ধারমুখোমুখি হয়েছিলেন সালেহীন বাবু।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সাহসী যোদ্ধা এবং প্রত্যক্ষদর্শী আপনি। সেই সদ্য স্বাধীন দেশ থেকে আজ ৪৭তম বিজয় দিবসের দোড়গোড়ায়। আপনার অনুভূতি কী?
শাহীন সামাদ : আমি সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ছিলাম। যুদ্ধের শুরুতে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির আত্মপ্রকাশ ঘটে যারা তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জ্বীবিত করত। সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠে বাংলাদেশি মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা। আমাদের সেই দলে আরও ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তফা মনোয়ারসহ অনেকেই। এভাবেই শুরু। দেশের প্রয়োজনে, স্বাধীনতার লক্ষ্যে কন্ঠ দিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। আজ সেই স্বাধীনতার ৪৭ বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে আমরা। এই অনুভূতি কি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব!
আরও পড়ুন : দেশপ্রেমের গল্পে ‘একটি কৃতজ্ঞতাপত্র’
দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে যেয়ে গানে গানে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জ্বীবিত করতেন। সেই দিনগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন।
শাহীন সামাদ : সে সময় আমি অনেক শরণার্থী শিবির, যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রাম, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। মুক্তিসেনাদের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গান গেয়েছি, স্টেজ পারফর্ম করেও যে অর্থ পেয়েছি তা তাদের পেছনে ব্যয় করেছি। তাদের ক্যাম্পে গিয়ে স্বাধীনতার উদ্যমী, জাগ্রত, শ্বাশত, গতিময় গানগুলো গেয়ে তাদের ক্লান্তি, ব্যথা ভুলিয়ে দিয়েছি যা তাদের নতুনভাবে প্রেরণা যুগিয়ে আরও অপ্রতিরোধ্য, অসীম সাহসি হয়ে পাক-হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করার প্রত্যয়ে অগ্রগামী করেছিল। এভাবেই আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম দিনের পর দিন। হাল ছাড়িনি।
নারী হয়েও আপনি থেমে থাকেননি, যুদ্ধে ঠিকই অংশ নিয়েছিলেন। এতটা শক্ত-মানসিকতা কোথা থেকে পেয়েছিলেন?
শাহীন সামাদ : একাত্তরের ২৫ মার্চ কাল রাতের কথা আমি এখনও ভুলতে পারি না। কখনও ভুলতে পারবোও না। যতদিন বেঁচে থাকবো এই দিনটার কথা মনে থাকবে। ওই দিনের গুলি-বোমার বিদীর্ণ শব্দ এখনও আমার কানে বাজে। চারদিকে আগুন, ধোঁয়া, থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে। তারপরেও মনোবল হারাইনি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশের জন্য কিছু একটা করব। অস্ত্র দিয়ে না পারি, কণ্ঠ তো আছে। এই কণ্ঠ দিয়েই যুদ্ধ করব। সেটাই করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে। প্রেরণাদায়ী গান গেয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ভাইদের সাহস যুগিয়েছি। এটা রণক্ষেত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
বর্তমান প্রজন্মদের মধ্যে বিজয়ের চেতনা, চিন্তা-বোধ কতটুকু কাজ করছে বা দেখছেন?
শাহীন সামাদ : আমি তো মনে করি নতুন প্রজন্মদের মধ্যে একাত্তরের চিন্তা-চেতনা পুরোপুরিই কাজ করে। ওরা এখন সবকিছুই বুঝতে পারে, অনেকটাই প্রগ্রেসিভ। ওরা যা করছে ভাল বুঝেই করছে। আমরা যদি ৪৭ বছর আগে এত কম লোকজন নিয়ে দেশ স্বাধীন করে আনতে পারি, এখন তো প্রায় ১৮-১৯ কোটির মত লোক। তাহলে নতুন প্রজন্ম কেন পারবে না? বুঝবে না? তাছাড়া ইন্টারনেটের যুগে তারা এখন সবকিছুই দেখছে, সচেতন হচ্ছে। আমি পুরোপুরি আশাবাদী।
আরও পড়ুন : বিজয় স্মরণে ‘বিজয়ফুল’
বিজয়ের ৪৭ বছর পর এসে কাঙ্খিত বাংলাদেশ কি আমরা পেয়েছি?
শাহীন সামাদ : অবশ্যই পেয়েছি। আমরা আমাদের দেশকে পেয়েছি। আমাদের দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। আমাদের নিজস্ব পাসপোর্ট আছে, আগে আমরা কয়টাইবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেতাম। আর এখন বিদেশে সরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক অনুষ্ঠান হচ্ছে। ৭১-এর পরবর্তী সেই বাংলাদেশ আর বর্তমান বাংলাদেশ অনেক পার্থক্য। আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি সব ভুলে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বর্তমান এ দেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে কি কি করণীয় বলে আপনি মনে করেন?
শাহীন সামাদ : সে সময় আমরা ছিলাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ তার সেই এক ভাষণে আমরা সব বাঙালি এক মন, এক আত্মা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম মুক্তিযুদ্ধে। সেই সময়ে পারলে এখন কেন পারবো না? এখন আমরা ভাল কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা না করে খারাপ বিষয় নিয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনা করি। খারাপ বিষয়টাই বা কেন বেশি বেশি চিন্তা করি আমি বুঝি না। যাই ইচ্ছে হয়, তাই করতে মন চায়, যেভাবেই হোক পেতে চেষ্টা করি। আমাদের সবার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি কে? নিশ্চয় মা। মাকেই কিন্তু আমরা দেখব সবার আগে, জগতে মাকে ভক্তি না করলে কি কিছু পাওয়া যায়? আমার সোনার বাংলা, আমার মা। আমার মাকে তো আমারই শ্রদ্ধা করতে হবে, মায়ের জন্য সবকিছু করতে হবে। সবার একসঙ্গে থাকতে হবে। আমরা পারলে তোমরা পারবো না কেন?
স্বাধীনতা, দেশপ্রেম বিশেষ দিনগুলোতে মনে না করে ভবিষ্যত প্রজন্মদের অন্তরে কিভাবে প্রতিদিনের চর্চায় পরিণত করা যায় ?
শাহীন সামাদ : মা-বাবা একটি সংসারের অভিভাবক। মা-বাবাকে সন্তানকে শিখাতে হবে মুক্তিযুদ্ধ কি? বঙ্গবন্ধু কি? বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে যেগুলো দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত সে অনুষ্ঠানগুলোতে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ঘুরে দেখানো, তাহলে কিন্তু সন্তান জানতে পারবে অনেক কিছু। মোট কথা মা-বাবার এখানে ভূমিকা নিতে হবে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, নিজে মানুষের মত মানুষ না হলে দেশ-দশের সেবা করা যায় না।’
সব মিলিয়ে আপনি কি আশাবাদী?
শাহীন সামাদ : হ্যাঁ, আমি অবশ্যই আশাবাদী। তবে সাধনা দরকার। নতুন প্রজন্মই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে আরও উচ্চাসনে নিয়ে যাবে। সেদিন আর দূরে নয় যেদিন এ দেশ হবে তেমার আর আমার সোনার বাংলাদেশ।
সারাবাংলা/পিএম
আরও পড়ুন : টিভি পর্দায় ‘হাসিনা-এ ডটার্স টেল’