Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চার গিনেজ রেকর্ড ও একজন সুদর্শন দাশ


১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৩:৫৬

লাল সবুজের অ্যাম্বেসেডর সুদর্শন দাশের ঝুলিতে একটি, দুইটি নয়, চার চারটি গিনেজ রেকর্ড! টানা ২৫ দিন ৫৫৭ ঘণ্টা ১১ মিনিট তবলা বাজিয়ে বিরল বিশ্ব রেকর্ড করেছিলেন এই লন্ডন প্রবাসী পণ্ডিত তবলা বাদক। একে একে রেকর্ড গড়েছেন ঢোল, ড্রাম রোল ও ড্রাম সেট বাজিয়ে। তার পুরস্কার হিসেবে গিনেজ কর্তপক্ষের আয়োজনে ওয়ার্ল্ড ট্যুরের অংশ হিসেবে সুদর্শন ঘুরে গেছেন জন্মভিটে বাংলাদেশেও। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সন্তান সুদর্শন তার স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প বলেছেন, পার্থ সনজয়ের সঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

২৪ বছর বয়সে তবলা বিশারদ!

আমার প্রথম গুরুজি শ্যামল দত্ত। তারপর বিজন চৌধুরী। পরিবারের সিদ্ধান্তে শান্তিনিকেতন যাই ১৯৯২ সালে। ১৯৯৮ সালে তবলা বিশারদ উপাধি পাই। ছয় বছরের ফুল গ্রেড শেষ করে আমাকে পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে, আমি তবলা বিষয়ে সব জানি। এটা তবলা বিষয়ে পান্ডিত্যের সনদ। আমার বয়স তখন ২৪। পণ্ডিত উপাধি পেতে সাধারনত ৩০ বছর লাগে। তখনও তা হয়নি বলেই ওরা আমাকে তবলা বিশারদ উপাধি দিল।
একই সময়ে আমি চট্টগ্রামে আইন বিষয়ে পড়েছি। ১৯৯৯ এ স্নাতক পাশ করি। এরপর পরিবারের ইচ্ছায় লন্ডনে চলে যাই, ব্যারিস্টারি পড়তে। সেখানে গিয়ে আমি দেখলাম, মিউজিকে তবলার খুব চাহিদা। লন্ডনের নেহেরু সেন্টারে শিক্ষকতা দিয়ে আমার যাত্রা শুরু।

২০০৪ এ আমেরিকান ভদ্রলোক টম ওয়াটসের সন্তানকে তবলা শেখানোর প্রস্তাব পাই। ওই ভদ্রলোকের আগ্রহেই তার সন্তানকে একমাত্র শিক্ষার্থী করে লন্ডন শহরে প্রতিষ্ঠিত করি ঢোল একাডেমি। আর ২০০৬ এ তবলার একটি ঘরানা, টেমস ঘরানা তৈরি করি আমি। পৃথিবীতে তবলার ছয়টি ঘরানা আছে। আমি শান্তিনিকেতনে দিল্লী ও লকনৌ ঘরানা শিখেছি। পাশাপাশি শিখেছি বেনারস ঘরানা।টেমস নদীর নামে এই ঘরানায় দশ হাজার বিট রয়েছে। সেসময়কার বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এই ঘরানার জন্য আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছে। বর্তমানে ইংল্যান্ডে তবলায় যে সিলেবাস রয়েছে, তা এই ঘরানাকে ঘিরেই। ইংল্যান্ডের ওয়েজবোর্ড কর্তৃক এই ঘরানা স্বীকৃত। ট্রিনিটি মিউজিক এবং এভিআরএসএম রয়েল কলেজ অব মিউজিকের তত্ত্বাবধানে এই সিলেবাস চালু রয়েছে শিক্ষা কার্যক্রমে।

আরও পড়ুন :  বিচার করেই কাটছে সময়

এর মধ্যেই মাস্টার্স পাশ করি আইন বিষয়ে। ২০০৮ সালে সুযোগ পাই ব্যারিস্টারি করার।

বিজ্ঞাপন

স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল চেন্নাইতে

 ২০০৯ সালে চেন্নাই আসি। সেখানে গিয়ে পেলাম কুঝালামানাম রামকৃষ্ণানকে। যিনি ৫০১ ঘন্টা মৃদঙ্গ বাজিয়ে বিশ্বরেকর্ড করেছেন। তখন আমার মনে হলো, কিভাবে আমি এটা করতে পারি? তাকে আমি আমার আগ্রহের কথা জানালাম। তিনি আমাকে গিনেজ রেকর্ডসের রুলস এন্ড রেগুলেশন ফলো করতে বললেন। আমি ফিরলাম লন্ডনে। ২০১০ সালে পাশ করলাম ব্যারিস্টারি।

স্বপ্ন অনুবাদের পথে

২০১২ সালে আমি চারটি আবেদন করি গিনেজ বরাবর। তবলা, ঢোল, ড্রাম রোল ও ড্রাম সেট। তারা আমাকে ডেমো পাঠাতে বলে। হ্যান্ড ম্যারাথন তবলা বাজানোর ডেমো। সাথে একটা লিখিত সম্মতিপত্র। যেখানে এই মর্মে প্রত্যয়ন করলাম, রেকর্ড করতে গিয়ে আমার শারীরিক কোন ক্ষতি হলে তার জন্য আমি দায়ী থাকবো। একটু ভয় অনুভূত হলো। তবু সাহস করে ১৫ দিনের বাজানোর একটা ডেমো পাঠালাম। এটা দেখেই গিনেজ কর্তৃপক্ষ আমাকে বাছাই করে। সারা পৃথিবী থেকে ১১ জন আবেদন করেছিল ওই ডেমো কনটেস্টে। তার মধ্যে আমি নির্বাচিত হলাম।

২০১৫ সালে যখন আমি সুযোগ পেলাম, তখন আর পিছু ফিরলাম না। পুরো বিষয়টি সম্পন্ন  করতে আমার চল্লিশ হাজার পাউন্ড লেগেছে। গিনেজ কর্তৃপক্ষ কোন খরচ দেয়নি। পৃষ্ঠপোষকতা করতেও প্রথমে কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে কয়েকজন বাঙালি এগিয়ে এলো। ১৫,০০০ পাউণ্ড পৃষ্ঠপোষকতা মিললো। বাকী ২৫,০০০ পাউণ্ড নিজ থেকেই খরচ করলাম। টানা ২৫ দিন শিফটিং এ লোক রাখতে হয়েছে। রাখতে হয়েছে সিকিউরিটি, অ্যাম্বুলেন্স। আমি অবিচল ছিলাম, আমি করবই। যদি মরেও যাই, তবু কোন সমস্যা নেই। রেকর্ড না হলেও সমস্যা নেই।

২৭ নভেম্বর’ ২০১৬ আমি তবলা নিয়ে বসে পরলাম। প্রচুর গণমাধ্যম ছিল। ওরা নানা বিষয়ে প্রশ্ন করলো। গিনেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নজর রাখলো সিসিটিভি। আমাদের তিন খানা ক্যামেরায় ২৪ ঘন্টাই রেকর্ড হতো। ক্যামেরা বন্ধ করলেই ডিসকোয়ালিফাইড। বিরতিতে গেলেও ক্যামেরাগুলো চলতে থাকতো। ২২ ডিসেম্বর ২০১৬ তে আমি ৫৫৭ ঘন্টা ১১ মিনিট বাজিয়ে আমি শেষ করি। প্রথম দশ থেকে ১৫ দিন তেমন কেউ আমাকে দেখতে আসেনি। যখন ১৫ দিন পার করলাম, দেখলাম সব গণমাধ্যম হাজির। তখন আমি খুব ক্লান্ত। আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেয়া হলো। পরের ১৫ দিন আমি হাসপাতালের বিছানায় থাকলাম। খুব কঠিন সময় আমি পার করেছি।

গিনেজ রেকর্ডসের রুলস এন্ড রেগুলেশনে ঘন্টায় ৫ মিনিট করে ব্রেক রয়েছে। পাবলিক প্লেসে মঞ্চ বানিয়ে আমি বাজিয়েছি। এটাও গিনেজের নিয়ম মেনে। আমার মঞ্চ থেকে ওযাশরুমটা বেশ দূরে। আমি ব্রেক নিয়েছি ৮ ঘন্টা, ১০ ঘন্টা কিংবা ১৫ ঘন্টা পরপর। ৫ মিনিটগুলো যোগ করে কখনো ৪০ মিনিট, কখনো ৬০ মিনিট বিশ্রামে যেতাম। তখন কেউ আমাকে খাইয়ে দিত, কেউ আমাকে ম্যাসেজ করে দিত। এগুলোও ক্যামেরায় রেকর্ড হতো।
ভাত খাওয়ার সুযোগ ছিল না। বাদাম, কিসমিস, জুস খেতাম। ঘুম নিয়ে সমস্যা ছিল। আমি ঘুমের কারণেই ক্লান্ত হয়েছি।

তিন মাস পর আমি গিনেজের স্বীকৃতি পাই। এজন্য আমার লগ ফাইলটা কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠাতে হয়েছে। ডিসেম্বরে ক্রিসমাসের কারণে এটা পাঠাতে আমার দেরী হয়েছে। এই লগ ফাইল পাঠাতেও এক হাজার পাউণ্ড লেগেছে। যা ফেরতযোগ্য নয়।

দ্বিতীয় রেকর্ড ঢোল বাজিয়ে

এক মাস পর ঢোলের জন্য গিনেজ আমাকে মনোনয়ন দেয়। টানা ২৭ ঘন্টা ঢোল বাজাতে পারলেই রেকর্ড হবে। সুযোগটা আমি নিয়ে নিলাম। একই রকম ভাবে ঘন্টায় ৫ মিনিট বিরতি দিয়ে আমি ঢোল বাজালাম। এটা ২০১৭ এর আগষ্টে। ২৭ ঘন্টায় আমি ২৫ টি তালে বাজিয়েছি। নিয়ম ছিল, প্রতি দুই মিনিটে তাল পরিবর্তন করতে হবে। না হলে, আপনি অযোগ্য বিবেচিত হবেন। তবলার ক্ষেত্রে নিয়মটা ছিল, এক ঘন্টায় একটা তাল।

ঢোলের পর ড্রাম রোল। তারপর ড্রাম সেট

২০১৮ তে গিনেজ কর্তৃপক্ষ মেইল করলো ড্রাম রোলে নমিনেশন দিয়ে। এটাতে কোন ব্রেক ছিল না। টানা ১৪ ঘন্টা বাজাতে পারলেই রেকর্ড। প্রাকৃতিক ডাকেও সাড়া দেয়া যাবে না। আমি একটু চিন্তিত হলাম। তবু হাল ছাড়লাম না। ১৪ ঘন্টা ননস্টপ বাজিয়ে দিয়েছি।

আর চলতি বছর নমিনেশন পেলাম, ড্রাম সেট বাজানোর। এটার আগের রেকর্ড ১৩৪ ঘন্টার। বিরতি প্রতি ঘন্টায় ৫ মিনিট। আমি বাজালাম ১৪০ ঘন্টা ৫ মিনিট।

আর কোন রেকর্ড নয়

নতুন আর কোন রেকর্ড করতে চাই না। আমার যদি মনে হয় কখনো নিজের রেকর্ডই ভাঙ্গবো। এটা অনেক ব্যয়বহুল। আমার ইচ্ছে ছিল, দেশের মানচিত্র বিশ্বের কাছে তুলে ধরার। তা আমি করেছি। গিনেজ রেকর্ডটা চ্যারিটি। তারা কোন অর্থ দেয় না। তারা রেকর্ডধারীকে সারা বিশ্ব ঘোরায়। সেই ওয়ার্ল্ড ট্যুরের অংশ হিসেবেই আমি এখন ঢাকায়!

আরও পড়ুন :  শুরু হচ্ছে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’, আসতে পারেন মানুষী চিল্লার

গিনেজ রেকর্ড তবলা বিশারদ সুদর্শন দাশ

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর