পূণ্যভূমিতে রবীন্দ্রনাথ ও শ্রুতি সিলেটের শ্রদ্ধা
১০ নভেম্বর ২০১৯ ১৭:৪৯
সময়কাল নভেম্বর ১৯১৯— আজি হতে শতবর্ষ পূর্বে, বাংলা ১৩২৬ সালের কার্তিক মাসের মাঝামাঝি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বেড়াতে এসেছিলেন শিলং শহরে। ওই সময় ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক পরলোকগত গোবিন্দনারায়ণ সিংহ ছিলেন গুরুদেবের একান্ত অনুরাগী। কবি শিলংয়ে এসেছেন— এ কথা শোনামাত্র তাকে সিলেটে আনার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন গোবিন্দনারায়ণ সিংহ। চটপট করে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষ থেকে কবিকে শ্রীভূমি সিলেটে আসার সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে টেলিগ্রাম করলেন। কবি জবাবে জানালেন, দীর্ঘ পথ ভ্রমণের ঝক্কি নিয়ে সিলেটে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
কবিগুরুর এ উত্তর আশাহত হওয়ার মতো হলেও অযৌক্তিক নয়। কেননা, ভৌগলিক দিক দিয়ে সিলেট শিলংয়ের কাছাকাছি হলেও ওই সময় সিলেট পর্যন্ত সরাসরি রাস্তা ছিল না। শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি পর্যন্ত সড়ক ছিল। চেরাপুঞ্জি থেকে খাসিয়ারা ব্যক্তিকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার একটি পদ্ধতির প্রচলন করেছিল। কিন্তু সে ব্যবস্থা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে কবি সরাসরি নাকচ করেন এবং সিলেট থেকে পাঠানো নিমন্ত্রণ বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন।
তবে দমে গেলেন না গোবিন্দনারায়ণ। আঞ্জুমান ইসলাম, মহিলা সমিতিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও টেলিগ্রাম করানোর ব্যবস্থা করলেন কবিগুরু বরাবর। একের পর এক আবেগঘন টেলিগ্রাম যখন হাজির হতে লাগলো, কবিগুরু সে আবেগকে আর প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। শেষমেষ সম্মতি জানালেন, শিলং সফর শেষে পা রাখবেন সিলেটে। আর এর জন্য তিনি দীর্ঘ হলেও বিকল্প পথটি বেছে নিলেন— গৌহাটি থেকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের লামডিং-বদরপুর সেকশন হয়ে করিমগঞ্জ-কুলাউড়া হয়ে সিলেট।
৩১ অক্টোবর ১৯১৯। কবিগুরু শিলং থেকে গৌহাটি অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিশাল আয়োজন করা হয়। দিন তিনেক সেখানে অবস্থান করে কবি ৩ নভেম্বর গৌহাটী থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেন। সিলেট থেকে একটি প্রতিনিধিদল কবিগুরুকে এগিয়ে আনতে বদরপুর পর্যন্ত যায়। ট্রেন কুলাউড়া জংশনে পৌঁছালে তাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানো হয়। কবি ও তার সহযাত্রীরা কুলাউড়াতে রাত্রিযাপন করেন। কবিকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য অভ্যর্থনা পরিষদ গঠন করা হয়। সভাপতি নিযুক্ত হন খানবাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ।
৫ নভেম্বর সকালে ট্রেন সিলেট স্টেশনে পৌঁছালে কবিগুরুকে রাজকীয় সম্মাননা জানানো হয়। সুরমা নদীর ওপর ঐতিহ্যবাহী কিন ব্রিজ তখনো হয়নি। কবিগুরু ও তার সঙ্গীরা বজরায় সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে মূল সিলেট শহরে প্রবেশ করেন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চাঁদনীঘাটকে পত্র-পুষ্প পতাকা, মঙ্গলঘট আর লালসালু দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি মৌলভী আব্দুল করিমকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি সুসজ্জিত ফিটন গাড়িতে করে শহরের উত্তর-পূর্বাংশে ছোট টিলার উপর পাদ্রি টমাস সাহেবের বাংলোর পাশে একটি বাড়িতে যান। সেখানেই কবির থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে পৌঁছালে কবিকে সংগীত ও চন্দন তিলকের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানানো হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় ব্রাহ্ম সমাজের আমন্ত্রণে কবি উপাসনায় যোগ দেন। সেদিন কবিগুরু তার নিজের রচিত ব্রাহ্ম সংগীত গেয়ে শোনান— ‘বীণা বাজাও যে অন্তরে’।
কবিগুরুর এই সফরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল মনিপুরী নৃত্য। সিলেটের মণিপুরীপল্লী-মাছিমপুরে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবারের মতো মণিপুরি নৃত্য ও রাসনৃত্য দেখেছিলেন। সে নৃত্য দেখে তিনি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে মনিপুরী নৃত্যের কোর্স প্রবর্তন করেন তিনি। তার কালজয়ী রচনা চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, মায়ার খেলা, নটীর পূজা, শাপমোচন নৃত্যনাট্যে মণিপুরি নৃত্যের স্থান দেন। বলা হয়ে থাকে— মণিপুরি নৃত্যকে মণ্ডপ প্রাঙ্গণ থেকে বের করে বিশ্বমণ্ডলে স্থান দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
সিলেট তখন ছিল বাংলার রাষ্ট্র সীমা থেকে দূরে, আসামের সঙ্গে। এই বিষয়টিও আহত করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। তাই তিনি সিলেটে বসেই লিখেছিলেন, ‘মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাংলার রাষ্ট্র সীমা হোতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি…।’
সিলেটে কবিগুরুর আগমনের এই শতবর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে পূণ্যভূমি সিলেটের সাস্কৃতিক সংগঠন ‘শ্রুতি’ আয়োজন করছে রবীন্দ্র উৎসব। আগামী ২২ নভেম্বর (শুক্রবার) রিকাবীবাজার কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে ‘শ্রুতি রবীন্দ্র উৎসব’ শিরোনামে দিনব্যাপী এই আয়োজনে থাকবে আবৃত্তি, সঙ্গীত, নৃত্য, নৃত্যনাট্য, রং তুলিতে রবীন্দ্রনাথ, একক ও সম্মেলক পরিবেশনা।
শ্রুতি সিলেটের প্রতিষ্ঠাতা ও সিলেটের সংস্কৃতি অঙ্গনের দুই সংগঠক সুকান্ত ও সুমন্ত গুপ্ত এই আয়োজন প্রসঙ্গে বলেন, মানুষ তার নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করে। কল্যাণময় বিষয়গুলোকে আহরণ করে যে চেতনার উন্মেষ ঘটায়, তাই তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতি অর্থ শালীন জীবনবোধ। শিক্ষা, সভ্যতা থেকে এ জীবনবোধ জন্ম নেয়। কোনো জাতি তার দীর্ঘ দিনের জীবনযাপনের ভেতর দিয়ে যে মানবিক মূল্যবোধ সুন্দরের পথে, কল্যাণের পথে এগিয়ে চলে, তাকে সংস্কৃতি বলা হয়। অর্থাৎ কোনো জাতির পরিচয় তার সংস্কৃতির মাধ্যমে। গতিময়তাই সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। আর এই গতিকেই ধারাবাহিকভাবে ধারণ ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষেই আমাদের এই আয়োজন।