Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘জয় বাংলা’র গাজী মাজহারুল আনোয়ার

এন্টারটেইনমেন্ট ডেস্ক
৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৩:০৭

‘জয় বাংলা বাংলার জয়
জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়
কোটি প্রাণ এক সাথে জেগেছে অন্ধ রাতে
নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময়…’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই রণসংগীতের ভূমিকা বলে শেষ করার নয়। স্বাধীন বাংলা বেতারের সূচনাসংগীত থেকে শুরু করে একেবারে নবীন-প্রবীণ মুক্তিসেনার মুখে মুখে, রনাঙ্গন থেকে সারাদেশের আপামর মুক্তিকামী মানুষের মনোবল চাঙ্গা করতে এই গানের অবদান অনস্বীকার্য। এই গানকে অনেকে বলেন, অনুপ্রেরণা যোগানো মুক্তির গান। অনেকে আরেকধাপ এগিয়ে একে আখ্যা দেন মুক্তিযুদ্ধের রণসংগীত হিসেবেও। যদিও এ গানের আবেদন মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই— সত্তরে মুক্তি পাওয়া ‘জয় বাংলা’ ছবির গান এটি। তখন থেকেই বাঙালি মন উদ্বেলিত করে চলেছে এ গান।

বিজ্ঞাপন

এ গানটি শোনেনি এমন মানুষ খুবই কম আছে। গানটি এমন এক সুরের গাঁথুনি, যা বাংলার মুক্তিপিপাসু মানুষের চেতনায় আগুন ধরায়। এই গানের মধ্য দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে হানাদার বধে এগিয়ে যায় বাংলার ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণির জনতা। এ গানটির সঙ্গে মিশে গেছে সকল শ্রেণিপেশার মানুষের আবেগ। এটি শুধু গান নয়, এমন কিছু কথা সম্মিলন, যার মধ্য দিয়ে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে হানাদারবধে এগিয়ে যান বাংলার ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকসহ সব শ্রেণির জনতা।

মহান মুক্তিযুদ্ধের আগের বছরে এ কালজয়ী গানটি লিখেছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সুর করেছিলেন খ্যাতিমান সূরস্রষ্টা আনোয়ার পারভেজ। ২০০৬ সালের ১৭ জুন পৃথিবী ছেড়েছিলেন আনোয়ার পারভেজ। আজ বৃষ্টিভেজা ভোরের প্রত্যুষে চলে গেলেন গানটির রচয়িতা।

বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে গানটির রচয়িতা ও সুরকার দুজনেই একাধিকবার শুনিয়েছেন গানটির জন্মকথা। ১৯৭০ সালের কথা। ‘জয় বাংলা’ নামে সিনেমাতে সংগীত পরিচালনা করছেন আনোয়ার পারভেজ। ছবিটি ছয় দফা নিয়ে। গাজী মাজহারুল আনোয়ার গান লিখলেন। তখন এমন পরিস্থিতি গান সুর করার জন্য গীতিকার-সুরকার একসঙ্গে বসার জায়গা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। এখন যেটা সংসদ ভবন, তখন ‘সেকেন্ড ক্যাপিটাল’ বলে পরিচিত ছিল সেই জায়গা। সেই সেকেন্ড ক্যাপিটালের উল্টো দিকে গলির ভেতর রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলেন তারা। গাজী মাজহারুল চাইছিলেন গানটি আরেকটু সংশোধন করতে। কিন্তু সেই সময় ছিলো না। আনোয়ার পারভেজের তাড়া খেয়ে প্যান্টের পকেট থেকে গানটি বের করলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এরপর ২০ মিনিট! মাত্র ২০ মিনিটে তারা তৈরি করে ফেললেন ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানের কম্পোজিশন।

বিজ্ঞাপন
আনোয়ার পারভেজের তাড়া খেয়ে প্যান্টের পকেট থেকে গানটি বের করলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার

আনোয়ার পারভেজের তাড়া খেয়ে প্যান্টের পকেট থেকে গানটি বের করলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার

খুবই সতর্কতার সঙ্গে ঢাকা ইন্দিরা রোডে একটি রেকর্ডিং স্টুডিওতে সেই গানটি রেকর্ড করা হলো। চারিদিকে সেনাবাহিনীর টহল। পরিস্থিতি থমথমে, তখন এর ভেতরে গভীর রাত পর্যন্ত এ গান রেকর্ড করা হল। বের হয়ে দেখেন এলাহী কারবার। জনতা কোত্থেকে খবর পেয়েছে বাংলা ছবির গানের রেকর্ডিংয়ের কথা। কয়েক’শ লোক মিলে স্লোগান তুলেছে ‘জয় বাংলা’। অবস্থা বেগতিক দেখে রিল-রেকর্ডিং গুছিয়ে সবাই পেছনের দরজা দিয়ে পালালেন। আর ছবির নতুন নাম ফেঁদে এ গানটি আবহ সংগীত করা হলো লাহোরে। এটাই মোটামুটি জয় বাংলা গানের জন্ম ইতিহাস।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার শুধু ‘জয় বাংলা’ লিখেননি। লিখেছেন আরও অনেক সময় ছাপিয়ে যাওয়া গান। অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। ২০ হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন তিনি। সব গান সংরক্ষণ তার কাছে ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের যে ফাঁসির তালিকা তৈরি করেছিল, তাতে ১৩ নম্বরে ছিলেন তিনি। তাকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। পরে ফিরে এসে দেখেন বাসায় থাকা তার গানের পাণ্ডুলিপি আর নেই। এরপর রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখেন সেখানেও তার গানগুলো নেই। পাকবাহিনী বাঙালিদের সব সৃষ্টিকর্ম ধ্বংস করে দিয়েছিল। তার রচিত প্রচুর গান হারিয়ে গেছে। তবুও রয়ে গেছে হাজার হাজার আলোচিত গান। সেই গানগুলোর কয়েকটি হলো— একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল, একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনারগাঁয়, জন্ম আমার ধন্য হলো, গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, ও পাখি তোর যন্ত্রণা, ইশারায় শীষ দিয়ে, চোখের নজর এমনি কইরা, এই মন তোমাকে দিলাম, ও আমার রসিয়া বন্ধু রে…। তার দেশাত্মবোধক গানের দিকে দেখা যাবে, তার প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেমে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

মূলত জমিদার বংশের সন্তান গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও ছোটবেলা থেকেই দেশ-প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। সেই আগ্রহ থেকে তার ভেতর জন্ম নেয় সৃজনশীলতা। ধীরে ধীরে তা তাকে পরিণত করে গীতিকারের। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি গীতিকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

১৯৬৪ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে তার লেখা প্রথম গান প্রচার হয়। সেই থেকে শুরু। তারপর কেটে গেছে অর্ধশতাধিক বছর। সৃষ্টি করেছেন হাজার হাজার গান। মুগ্ধ করেছেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা গানের ইতিহাস। তাকে বাদ দিয়ে বাংলা গানের ইতিহাস লেখা অসম্ভব।

বাংলা গানের গৌরবোজ্জ্বল যাত্রায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের নাম থাকবে অবিনাশী।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

‘জয় বাংলা’র গাজী মাজহারুল আনোয়ার গাজী মাজহারুল আনোয়ার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর