Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চেয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেন সাংবাদিক পারুল


২৪ জুন ২০২০ ২১:৫৫

ঢাকা: নির্যাতিতা, অধিকারবঞ্চিত নারীদের নিয়ে অসংখ্য রিপোর্ট করলেও আজ নিজের জন্য বিচার চাইতে রাস্তায় দাঁড়ালেন দৈনিক সমকালের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সাজিদা ইসলাম পারুল। ভ্রূণ হত্যা, যৌতুকের দাবিতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে সাবেক স্বামী রেজাউল করিম প্লাবনের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছিলেন। মামলার পর দেড় মাস হয়ে গেলেও প্লাবন এখনও গ্রেফতার না হওয়ায় আজ বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যায়বিচার চেয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

পারুলের অভিযোগ প্লাবনের দিক থেকে তাকে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়ার পাশাপাশি নানারকম হুমকি দেওয়া হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন অবহেলায় বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চেয়ে একাই মানবন্ধ করেন তিনি।

বুধবার (২৪ জুন) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়ান তিনি। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি কি বিচার পাবো না?/ যৌতুকের দাবি, নির্যাতন ও ভ্রূণ হত্যাকারী প্লাবনের গ্রেফতার চাই।’ বেলা ১১ টা থেকে ১২ পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধনের পুরোটা সময় শুধু চোখ দিয়ে পানিই ঝরে তার।

পারুল বলেন, ‘প্রায় দেড় মাস হল তিনি রেজাউল করিম প্লাবনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেছেন। বিচার চেয়ে বিভিন্ন জায়গায় ধরনাও দিচ্ছেন। প্লাবন ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়ালেও তাকে নাকি খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।’

পারুল অভিযোগ করেন, বেশকিছু সাংবাদিক নেতার প্রশ্রয় এবং পুলিশ প্রশাসনের অবহেলা কাজে লাগিয়ে প্লাবন তাকে সমঝোতার চাপ, হুমকি ও ফেসবুক হ্যাক করার চেষ্টা করছে। তাই ন্যাবিচারের দাবিতে আজ একাই প্রেস ক্লাবে দাঁড়িয়েছেন। এরপরও বিচার না পেলে প্লাবনকে গ্রেফতারের দাবিতে হাতিরঝিল থানার সামনে দাঁড়াবেন বলে জানান।

প্লাবনকে কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না এই প্রশ্নের উত্তরে হাতিরঝিল থানার ওসি আবদুর রশিদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না। প্লাবনকে ধরার জন্য তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে।’

এদিকে পারুলের দাবি প্লাবন ঢাকাতেই আছে। সে ক্ষেত্রে তিন সদস্যের টিম কেন দেড় মাসে প্লাবনকে খুঁজে পাচ্ছে না, এই প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রশিদ বলেন, ‘তারা যখন যেখানে খবর পাচ্ছেন সেখানে যাচ্ছেন কিন্তু যাওয়ার পর আর আসামিকে পাচ্ছেন না।’

বিজ্ঞাপন

অভিযোগকারী পারুলের ওপর আসা হত্যাসহ নানাধরনের হুমকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন,  ‘এ ধরনের কোন অভিযোগ তার কাছে আসেনি। এলে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’

মানববন্ধনে পারুল সাংবাদিক নেতাদের কাছে বিচার পেতে সহায়তার আবেদন করেন। তারা যেন পারুলকে নিজেদের মেয়ে বা বোন ভেবে তার পাশে দাঁড়ান, সেই দাবি করেন।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ বলেন, ‘আজ পারুল প্রেসক্লাবে যাবে এটা তিনি জানতেন না। জানলে একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি পারুলের পাশে যেয়ে দাঁড়াতেন। প্লাবন এবং পারুল দুজনেই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সদস্য।

সেক্ষেত্রে এই সংগঠনের পক্ষ থেকে প্লাবনের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্লাবনের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও ভ্রূণ হত্যার অভিযোগ করার পরপরই অভিযুক্ত প্লাবনের ডিআরইউর সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। তিন সদস্যের একটি শৃঙ্খলা কমিটি গঠন করা হয়েছে যারা বিষয়টি তদন্ত করছে। কমিটিকে দুই মাস সময় দেওয়া হয়েছে। শৃঙ্খলা কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্লাবনের সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার প্রতিটি মেয়ের মতো পারুলও ন্য্যবিচার পাওয়ার দাবিদার।’

তিনি ব্যক্তিগতভাবে পারুলের সঙ্গেই আছেন। অভিযুক্তকে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি আশা প্রকাশ করি আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে ও যত দ্রুত সম্ভব অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।’

সাংবাদিকদের আরেক অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহ-সভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘পারুল যখন থেকেই তার ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করেছে তখন থেকেই তার প্রতি মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন জানাচ্ছি। কিন্তু করোনাসৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে কর্মসূচি দেওয়া বা সেভাবে পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।’

আজ প্রেস ক্লাবের সামনে বিচার চেয়ে পারুলের এই একক মানববন্ধন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। একজন মানুষ হিসেবে, একজন সাংবাদিক হিসেবে পারুলের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। অথচ দেড় মাসেও যুগান্তরের স্টাফ রিপোর্টার রেজাউল করিম প্লাবন গ্রেফতার না হওয়ায় আজ তাকে এভাবে বিচার চাইতে হচ্ছে।’

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আরও বলেন, ‘এই ঘটনায় যুগান্তর কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ আসার পরেও তারা তেমন কোনো অ্যাকশন নেয়নি। প্লাবনকে পুলিশ খুঁজে পায় না, এটি অবিশ্বাস্য। আমি পুলিশকে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাই। একটা মেয়ের পাশে দাঁড়ানো তাদের নৈতিক দায়িত্ব।’

পারুলের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, সে যেন কিছুতেই মনোবল না হারায় এবং শেষ পর্যন্ত লড়াইটা চালিয়ে যায়। তিনি পারুলের পাশে আছেন এবং আশা প্রকাশ করেন পারুলের প্রতিষ্ঠানও তাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

শুরু থেকেই সমকাল কর্তৃপক্ষ পারুলের সঙ্গে আছে বলে জানালেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি। তিনি বলেন, ‘পত্রিকা হিসেবে আমরা সবসময়ই নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করি। পারুল একজন মানুষ ও আমাদের সহকর্মী। তাই সর্বতভাবে তার পাশে আছি। সবধরনের সহযোগিতা তাকে দেব।’

কিছু সাংবাদিক নেতার প্রশ্রয়ে প্লাবনের দিক থেকে সমঝোতার প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিছু অপরাধের কোনো সমঝোতা হয় না। প্লাবন ও তার পরিবার শুধু পারুলকে নির্যাতনই করেনি, তার ভ্রূণ হত্যা করেছে। এটি শুধু নির্যাতন নয়, রীতিমত মানবাধিকার লঙ্ঘন।’

তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় প্লাবনকে দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান। পুলিশ এখনও পর্যন্ত গ্রেফতারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে বক্তব্য দিচ্ছে। শুধু প্লাবনই নয়, এই মামলার বাকি চার অভিযুক্ত প্লাবনের গ্রামের বাড়িতে থাকলেও তাদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনি পক্রিয়ায় সকল অভিযুক্তকে দ্রুত গ্রেফতার করবেন।

এদিকে মানববন্ধনে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে পারুল জানান, তিনি আজ বাধ্য হয়ে এখানে দাঁড়িয়েছেন।

প্রশাসন তাকে কোনো সাহায্য করছে না তাই এই মামলায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে পারুল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী একজন মায়ের মতো। অন্তত তিনি যেন আমার দুঃখটা বোঝেন। আমি চাই, প্লাবনকে দ্রুত গ্রেফতার করা হোক এবং আশা করি তার অফিস যুগান্তর থেকেও যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

উল্লেখ্য, যৌতুক দাবি, যৌতুকের জন্য নির্যাতন এবং ভ্রূণ হত্যার অভিযোগে গত ১১ মে হাতিরঝিল থানায় প্লাবনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সাজিদা ইসলাম পারুল।

মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২ এপ্রিল যুগান্তরের স্টাফ রিপোর্টার প্লাবনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর যৌতুক হিসেবে প্লাবন ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট দাবি করেন পারুলের কাছে। একাধিক নারীর সঙ্গে প্লাবনের অনৈতিক সম্পর্ক থাকার কথা জেনে যান পারুল। অনৈতিক সম্পর্কে বাধা ও যৌতুক না দেওয়ায় পারুলকে নির্যাতন করা হয়। মারধরের কারণে পারুলের গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। ৫ মে তিনি প্লাবনের গ্রামে বাড়ি গেলে সেখানেও মারধরের শিকার হন। প্লাবনের বড় ভাই এমএ আজিজ, ছোট ভাই এসএম নিজামউদ্দিন এবং বাবা সামসুল হক ও মা মারধর করেন পারুলকে।

সাংবাদিকদের কাছে পারুল জানান, একজন সাংবাদিক হয়েও তিনি বিচার পাচ্ছেন না, সেখানে সাধারণ মেয়েরা কী পরিস্থিতিতে পড়েন তা বলাই বাহুল্য। আজ মানববন্ধনের পরও প্লাবনকে গ্রেফতার করা না হলে প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি সামনে এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছেও ন্যায়বিচারের দাবি নিয়ে যাবেন তিনি।

নারী নির্যাতন মামলা পারুল সাজিদা ইসলাম পারুল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর