রাশিয়ার সাইবেরিয়ার অন্তঃস্থলে আছে এক বিস্ময়কর গ্রাম— ওয়মিয়াকন। পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল জনবসতিপূর্ণ গ্রাম এটি। শীতকালে এখানে তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। তুলনা করতে গেলে বলা হয়, এই গ্রাম মঙ্গলগ্রহের চেয়েও শীতল! যেখানে লাল গ্রহে গড় তাপমাত্রা মাইনাস ৬০ ডিগ্রির কাছাকাছি, সেখানে পৃথিবীতেই এক গ্রাম টিকে আছে আরও ভয়ঙ্কর ঠান্ডার ভেতরে।
বরফের কারাগারে জীবন
ওয়মিয়াকনের জীবনযাত্রা যেন জমাট বরফের সঙ্গে এক অবিরাম লড়াই। এখানে জানুয়ারিতে সূর্যের আলো টেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। বাইরে পা রাখলেই নিঃশ্বাসের বাতাস বরফ হয়ে ফুসফুসে বিঁধে যায়। চোখের পলকেই চশমা মুখে আটকে যায়, কলমের কালি জমে যায়, এমনকি ফুটন্ত গরম পানি বাইরে ফেললে সেটিও কয়েক সেকেন্ডে বরফে পরিণত হয়।
রেকর্ড ভাঙা ঠান্ডা
১৯২৪ সালে ওয়মিয়াকনের ইতিহাসে এক ভয়াবহ শীত নথিভুক্ত হয়—তাপমাত্রা নেমেছিল মাইনাস ৭১ ডিগ্রিতে। সাম্প্রতিক বছরেও মাইনাস ৬০–৬৫ ডিগ্রি প্রায় স্বাভাবিক। একবার এতোটাই ঠান্ডা হয়েছিল যে, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের থার্মোমিটারই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম
এখানে প্রায় ৫০০ মানুষ বাস করেন। কৃষি জমে যাওয়ায় তারা ফসল ফলাতে পারেন না। তাই জীবিকা নির্ভর করে বলগা হরিণ, মাছ এবং মাংসের ওপর। খাবার সংরক্ষণে কোনো ফ্রিজের দরকার পড়ে না—মাইনাস ৫০ ডিগ্রিতেই সব বরফে পরিণত হয়ে নিরাপদ থাকে। তবে বেঁচে থাকাটাই বড় সংগ্রাম। ঠান্ডায় গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে আবার চালু করা কঠিন, তাই অনেক চালক ইঞ্জিন সারাদিন চালু রেখেই রাখেন। কিছু বছর আগে গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পথচারী দুই ব্যক্তি হাঁটতে শুরু করেছিলেন—কিন্তু হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই বরফের মতো জমে মারা যান।
মৃত্যুর পরও কষ্ট
ওয়মিয়াকনে মৃত্যুও সহজ নয়। বরফে জমাট মাটিতে কবর খোঁড়া অসম্ভব। তাই মৃতদেহ সমাধিস্থ করতে আগুন জ্বালিয়ে মাটি গলাতে হয়। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে লেগে যায় তিন থেকে চার দিন। শত শত বছরেও এ অঞ্চলের মৃতদেহে পচন ধরে না— বরফ তাদের অক্ষত রাখে।
স্কুলও চলে ঠান্ডার নিয়মে
এখানকার একমাত্র স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায় যখন তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রির নিচে নামে। শিশুদের জন্য এটি স্বস্তি বটে, কিন্তু বাস্তবে সেই সময় বাইরে বের হওয়া মানেই প্রাণ হাতে করে চলাফেরা।
শীতের রাজ্যে মানুষের জয়গান
ওয়মিয়াকন প্রমাণ করে মানুষ প্রকৃতির সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাতেও টিকে থাকতে পারে। এখানে বেঁচে থাকার অর্থ হলো অভিযোজন, ঐক্য এবং সাহস। মঙ্গলগ্রহে যেখানে মানুষ বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছে, সেখানে পৃথিবীর এই ভয়ংকর শীতল গ্রাম আজও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের অনন্য প্রতীক।