টেক দুনিয়ায় অ্যাপেল মানেই উদ্ভাবন, নান্দনিকতা আর প্রিমিয়াম লাইফস্টাইলের প্রতীক। আইফোন, আইপ্যাড, ম্যাকবুক— এসবের দাম বেশি হতেই পারে। কিন্তু একটি স্নিকার্সের দাম অর্ধকোটি টাকা! —এ খবর শুনলে চোখ কপালে ওঠাই স্বাভাবিক।
সাম্প্রতিক সময়ে সোথবি অকশন হাউসের নিলামে আলোচনায় এসেছে অ্যাপেলের সেই ‘আলট্রা রেয়ার’ স্নিকার্স, যার দাম শুনলেই যে কেউ হতবাক হয়ে যায়।
এই স্নিকার্স শুধুই জুতা নয়— অ্যাপেলের তিন দশকের ইতিহাস, সংগ্রহযোগ্যতার মূল্য, আর ব্র্যান্ডের ঐতিহ্যের প্রতীক।
রেনবো লোগোর সোনালি যুগ
অ্যাপেলের পুরনো ব্যবহারকারীরা নিশ্চয় মনে করতে পারবেন— আজকের মিনি-মালিস্টিক কালো-সাদা লোগোর আগে অ্যাপেলের ছিল এক উজ্জ্বল রঙিন ‘রেনবো লোগো’। রঙধনুর মতো সাত রংয়ের সেই লোগো ছিল অ্যাপেলের সৃজনশীলতার প্রতীক। এই বিশেষ লোগো লাগানো স্নিকার্স তৈরি হয়েছিল ১৯৯০ সালে— শুধুমাত্র অ্যাপেল কর্মীদের জন্য একটি এক্সক্লুসিভ গিফট হিসেবে। আজকের দিনে সেটাই হয়ে উঠেছে কালেক্টরদের স্বপ্ন।
বিশেষ উপহার থেকে নিলাম বাজারে
স্নিকার্সটি কখনও জনসাধারণের জন্য বাজারে আসেনি। ১৯৯০-এর মাঝামাঝি সময়ে অ্যাপেল একটি জাতীয় সেলস কনফারেন্সে কর্মীদের উপহার হিসেবে দেয় সাদা রঙের এই স্নিকার্স। সেই সময় কেউ কল্পনাও করেনি যে একদিন এই জুতার দাম গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ হাজার ডলার, বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় ৫৪ লাখ টাকা!
অনেকের কাছে এটি হয়তো বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু ব্র্যান্ড কালেক্টরদের কাছে এটি আইফোনের চেয়েও মূল্যবান এক ইতিহাস।
কেন এত দাম?— কারণগুলো অবিশ্বাস্য
১. ‘আলট্রা রেয়ার’ কালেক্টিবল
এ ধরনের অ্যাপেল স্নিকার্স পৃথিবীতে কতগুলো আছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে ধারণা করা হয়, খুব অল্প সংখ্যক তৈরি হয়েছিল। ফলে এটি এখন বিরল সম্পদের তালিকায়।
২. অরিজিনাল বাক্সে একদম নতুন
নিলামের ঘোষণা অনুযায়ী স্নিকার্সটি অরিজিনাল প্যাকেজিংয়ে রয়েছে। পুরনো পণ্যের ক্ষেত্রে অবস্থান যত ভালো, দাম তত বেশি।
এর সঙ্গে রয়েছে একজোড়া লাল শ্যু লেস, যা সংগ্রহযোগ্য মূল্য আরও বাড়িয়েছে।
৩. রেনবো অ্যাপেল লোগো— একটি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস
রেনবো লোগো আজ আর অ্যাপেলের পরিচয় নয়। তাই এই লোগো-সংবলিত প্রোডাক্ট যেকোনো সংগ্রাহকের জন্য অমূল্য।
৪. ফ্যাশন ও প্রযুক্তির মিলন
আজকের দিনে অ্যাপেল মূলত গ্যাজেট তৈরি করলেও ১৯৮০–৯০-এর দশকে কোম্পানি চেষ্টা করেছিল একটি লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে। সেই সময়ই জন্ম নেয় ‘দ্য অ্যাপেল কালেকশন’—যেখানে ছিল পোশাক, ব্যাগ, ছাতা, মগ, চাবির রিংসহ নানা অ্যাকসেসরিজ। স্নিকার্সটি ছিল সেই লাইফস্টাইল এক্সপেরিমেন্টের অন্যতম অংশ।
৫. ব্র্যান্ড ভ্যালু ও আবেগ
অ্যাপেল ভক্তদের কাছে এই স্নিকার্স শুধু ফ্যাশন নয়—স্মৃতি, ইতিহাস, নস্টালজিয়া এবং কোম্পানির এক ভিন্ন সময়কে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ।
দ্য অ্যাপেল কালেকশনের বিস্ময়
১৯৮৬ সালে অ্যাপেল চালু করে ‘দ্য অ্যাপেল কালেকশন’। তখন স্টিভ জবস কোম্পানিতে ছিলেন না, এবং অ্যাপেল নিজেকে প্রযুক্তি ছাড়াও এক ফ্যাশনেবল ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল। কালেকশনে ছিল:
রঙিন শার্ট,
জ্যাকেট,
থার্ড পার্টি কোম্পানির তৈরি অ্যাকসেসরিজ,
ছাতা, ব্যাগ, চাবির রিং,
মগ ও ডেকোর আইটেম,
এই সংগ্রহের প্রায় সব পণ্যের প্রধান আকর্ষণ ছিল সেই রেনবো লোগো।
সেসময় প্রায় ২২ হাজার শার্ট বিক্রি হয়েছিল— যা অ্যাপেলের ব্র্যান্ড-প্রেমীদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে।
সোথবির নিলাম— কালেক্টরদের দৃষ্টি আবার অ্যাপেলের দিকে
বিশ্বখ্যাত অকশন হাউস সোথবি সাম্প্রতিক নিলাম আয়োজন করে অ্যাপেলের এই আলট্রা রেয়ার স্নিকার্স নিয়ে। যারা প্রযুক্তি ও ফ্যাশন- দুটোই ভালোবাসেন, তাদের কাছে এটি একদম ‘ড্রিম আইটেম’। অনেকে এটি কিনেন না পরার জন্য, বরং তাদের সংগ্রহে রাখার জন্য— একটি প্রিমিয়াম শোকেসের গ্লাস বাক্সে।
এত দামি জুতা নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া
অনেকে অবাক, অনেকে সমালোচনাও করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মজার মন্তব্য চলছে…
‘এক জোড়া জুতার দামে তিনটা আইফোন কেনা যায়!’
‘জুতা না টাইম মেশিন?’
‘এই স্নিকার্স পায়ে দিলে কি অ্যাপেল স্টোরে VIP লাইন পাবে?’
তবে ব্র্যান্ড সংগ্রাহকদের চোখে এটি বিরল এক রত্ন।
টাকা থাকলেই কিনতে পারবেন— প্রেম না থাকলে নয়
অনেকে মনে করেন, এত দামি জুতা শুধু ধনী ব্যক্তিরাই কিনতে পারে। কিন্তু আসল বিষয় হলো—এই ধরনের কালেক্টিবল আইটেম কেনার জন্য শুধুমাত্র টাকা যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন:
ব্র্যান্ডের প্রতি গভীর ভালোবাসা,
প্রযুক্তি ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ,
শিল্প-সংগ্রহের মনোভাব,
এবং বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করার দক্ষতা,
কারণ কালেক্টিবল জিনিস সময়ের সঙ্গে আরও বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে।
কীভাবে তৈরি হয়েছিল এই স্নিকার্স
সাদা রঙের কাস্টম ডিজাইনে তৈরি করা হয় এই জুতাটি, যাতে ছিল—
সাইডে রেনবো অ্যাপেল লোগো,
নরম আরামদায়ক সোল,
ক্লাসিক ৯০-এর দশকের ডিজাইন,
সাথে অতিরিক্ত লাল শ্যু লেস,
জুতা প্রস্তুত করে তৃতীয় পক্ষ সংস্থা, ঠিক যেমন অ্যাপেল তাদের লাইফস্টাইল কালেকশনের বেশিরভাগ পণ্য তৈরি করত।
আজকের অ্যাপেল— ফ্যাশন দুনিয়ায় ফেরার সম্ভাবনা?
যদিও অ্যাপেল এখন প্রধানত প্রযুক্তি কোম্পানি, তবে ব্র্যান্ডটির ডিজাইন দর্শন সবসময় ফ্যাশন দুনিয়ার কাছেও অনুপ্রেরণার উৎস। বর্তমানে আইফোন কেস, অ্যাপেল ওয়াচ ব্যান্ড—এসবই অ্যাপেলের আধুনিক লাইফস্টাইল পণ্য। তবে ৮০–৯০-এর মতো আবার পূর্ণাঙ্গ পোশাক বা জুতার লাইনে অ্যাপেল ফিরবে কিনা— সেটি অনিশ্চিত। কিন্তু পুরনো ‘অ্যাপেল কালেকশন’-এর জিনিসপত্র আজও বাজারে কালেক্টরদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।
অর্ধকোটি টাকার জুতা— বিলাসিতা নয়, ইতিহাসের মালিকানা
স্নিকার্সটি হয়তো অনেকের কাছে অযৌক্তিক বিলাসিতা মনে হতে পারে। কিন্তু যারা ব্র্যান্ড ইতিহাস, বিরল সংগ্রহযোগ্য আইটেম এবং ডিজাইনের গল্পকে মূল্য দেন, তাদের কাছে এই জুতার দাম আসলে প্রতীক— অ্যাপেলের একটি যুগের।
একটি রঙিন লোগোর গল্প, কোম্পানির অতীত, নস্টালজিয়া, এবং প্রযুক্তি-ফ্যাশনের মিলনের স্মৃতি— সব মিলিয়ে অর্ধকোটি টাকা যেন শুধু একটি মূল্য নয়, বরং একটি ইতিহাসের মূল্যায়ন।