যেখানে ইতিহাস কথা বলে
উত্তরের জনপদ বগুড়া মানেই যেন এক জীবন্ত ইতিহাস। এর বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতার ফিসফাস, মাটির গভীরে ঘুমিয়ে আছে কত না রাজ্যের উত্থান-পতনের গল্প। এর কুয়াশামাখা সকাল আর করতোয়ার প্রাচীন স্রোত যেন এক নীরব কথক, যে যুগ যুগ ধরে বলে চলেছে পুণ্ড্রবর্ধনের গৌরবময় উপাখ্যান। মহাস্থানগড়ের বিশালতার ছায়ায়, বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরের বুক চিরে জেগে থাকা এক মহাকাব্যের নাম ‘ভাসু বিহার’। এটি কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সমষ্টি নয়; এ হলো পালযুগের মেধা, মনন, শিল্প আর আধ্যাত্মিকতার এক জীবন্ত উপাসনালয়, যার প্রতিটি ইট কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বগুড়া শহর থেকে উত্তর পশ্চিমে, শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার ইউনিয়নে অবস্থিত এই প্রত্নস্থল স্থানীয়দের কাছে ‘নরপতির ধাপ’ নামে পরিচিত। ফসলের সবুজ গালিচার মাঝে এই উঁচু ঢিবি প্রথম দর্শনেই দর্শকের মনে জন্ম দেয় এক অপার্থিব কৌতূহল ও শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময়। এর শান্ত, স্নিগ্ধ চত্বরে পা রাখলেই মনে হয়, এক অদৃশ্য টাইম মেশিনে চড়ে আমরা পৌঁছে গেছি সেই অতীতে, যখন এই অঙ্গন মুখরিত থাকতো শত শত ভিক্ষুর মন্ত্রোচ্চারণে, আর জ্ঞানীদের পদচারণায় স্পন্দিত হতো এর প্রতিটি ধূলিকণা।
কিংবদন্তি যখন ইতিহাসের গায়ে চাদর বোনে
ভাসু বিহারের নামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এক করুণ লোকশ্রুতি। কথিত আছে, এ অঞ্চলের প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন ভাসুদেব। রাজ্যের মঙ্গল কামনায় এক দৈববাণী পেয়ে তিনি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ছোট ভাই ভোলাকে ‘জীয়ত কুণ্ড’ নামক এক দিঘিতে বলি দিতে বাধ্য হন। রাজার নামানুসারে এই বিহারের নামকরণ হয় ‘ভাসু বিহার’ এবং তার আত্মত্যাগী ভাইয়ের নামে পাশের গ্রামের নাম হয় ‘ভোলাগাড়ী’।এই লোককথা হয়তো ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণে টেকে না, কিন্তু তা এই স্থানকে এক মানবিক আবেগের চাদরে ঢেকে দিয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুসন্ধানী চোখ অবশ্য অন্য কথা বলে। তাঁদের মতে, সপ্তম শতকে ভারত ভ্রমণে আসা কিংবদন্তি চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তাঁর ভ্রমণগ্রন্থে যে ‘পো-শি-পো’ বা ‘বিশ্ব বিহার’-এর কথা উল্লেখ করেছিলেন, এটিই সেই মহিমান্বিত জ্ঞানকেন্দ্র।

ভাসু বিহারের নামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এক করুণ লোকশ্রুতি
ইতিহাসের পর্দা উন্মোচন: হিউয়েন সাঙ থেকে কানিংহাম
ভাসু বিহারের প্রকৃত ইতিহাস উন্মোচনে আমাদের ফিরে যেতে হবে সপ্তম শতকে। জ্ঞানপিপাসু বৌদ্ধ পণ্ডিত হিউয়েন সাঙ (৬৩৯-৬৪৫ খ্রি.) পুণ্ড্রবর্ধন অঞ্চলে যে চারটি বিশাল বৌদ্ধ বিহারের বর্ণনা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে ‘পো-শি-পো’ ছিল সর্বাধিক জাঁকজমকপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছিলেন, এখানে মহাযান বৌদ্ধধর্মের চর্চা হতো এবং প্রায় ৭০০ ভিক্ষু বাস করতেন, যাঁরা ছিলেন দূরদর্শী জ্ঞানী ও পণ্ডিত। বহু শতাব্দী পর, প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম হিউয়েন সাঙের বর্ণনার সূত্র ধরেই এই স্থানকে ‘পো-শি-পো’ বিহার হিসেবে শনাক্ত করে ইতিহাসের এক হারানো অধ্যায়কে পুনরুদ্ধার করেন।বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে শুরু হওয়া ধারাবাহিক খননকারজ এই বিহারের ঘুমন্ত কাঠামোকে ধীরে ধীরে জাগিয়ে তোলে। মাটির নিচ থেকে একে একে বেরিয়ে আসে দুটি সুবিশাল সংঘারাম (বিহার) যা এক সমৃদ্ধ সভ্যতার নীরব দলিল।
ইটের ক্যানভাসে মহাকাব্য: স্থাপত্য ও শিল্পশৈলী
ভাসু বিহারের স্থাপত্য পালযুগের বিহার স্থাপত্যের এক শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন। প্রথম বিহার উত্তর-দক্ষিণে ১৪৮.১৩ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৩৯ মিটার পরিমাপের প্রায় আয়তক্ষেত্রাকার বিহারটি পোড়া ইটের তৈরি। দুই ইটের মাঝখানে মর্টার হিসেবে কাদামাটির ব্যবহার লক্ষণীয়। আয়তক্ষেত্রাকার আঙিনার চারদিকে কাদামাটির তৈরি ১১ মিটার × ১০ মিটার আয়তনের মোট ২৬টি কক্ষ রয়েছে। পূর্বদিকের বাহুর মধ্যভাগে তোরণের সম্মুখভাগটি (ফাসাদ) ছিল আকর্ষণীয়। বিহার কক্ষ সারিতে অবস্থিত অভ্যন্তরীণ হলঘরের মতো একটি কক্ষে প্রবেশ করার জন্য একটি স্তম্ভবিশিষ্ট প্রবেশপথ ছিল। তোরণটিতে দুটি রক্ষীকক্ষও ছিল।
দ্বিতীয় বিহার ভূমি পরিকল্পনায় দ্বিতীয় বিহারটি ১ম বিহারের প্রায় অনুরূপ এবং উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। উন্মুক্ত আঙিনার চারদিকের বারান্দা সংলগ্ন বিহারের ৩০টি কক্ষের অবস্থান। পূর্ব ও পশ্চিমে ৭টি এবং দক্ষিণ বাহুর মাঝখানে প্রবেশপথ ছাড়াও ৮টি করে কক্ষ রয়েছে। দক্ষিণ বাহুর মধ্যখানে প্রধান তোরণটি বাইরের দিকে অভিক্ষিপ্ত এবং সেদিকেই মন্দিরটি অবস্থিত। বিহারটির উত্তর এবং পশ্চিমে গভীর নিচু খাদটি প্রাচীন কোন নদীখাত বা জলাশয়ের চিহ্ন বহন করে। সেকারণে হয়ত বা বিহারের পূর্বদিকে প্রবেশপথ রাখা হয় নি, যা বাংলার বৌদ্ধবিহারের স্থাপত্যিক ঐতিহ্য অনুসারে থাকার কথা ছিল। তোরণটিতে দুটি রক্ষীকক্ষও ছিল
প্রধান মন্দির প্রধান মন্দিরটি ছিল কমপ্লেক্সের দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্বে, দু নম্বর বিহারের দক্ষিণে এবং এক নম্বর বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব পার্শ্বে। মন্দিরটি প্রায় ক্রুশাকৃতি এবং এখানে ধাপবিশিষ্ট সিঁড়ির প্রদক্ষিণ পথ ছিল। পশ্চিম দিক থেকে মন্দিরে প্রবেশ করতে হতো। সমাবেশ স্থল বা মন্ডপটি ছিল মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় প্রদক্ষিণ পথ ছিল। ভিত্তির সর্বনিম্ন অংশের বহিসম্মুখভাগ পোড়ামাটির ফলকে অলঙ্কৃত ছিল।
পোড়ামাটির ফলক: কথা বলে হারানো সময়
ভাসু বিহারের প্রাণভোমরা হলো এখান থেকে আবিষ্কৃত প্রায় ৮০০টিরও বেশি পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটা। এই ফলকগুলো নিছক অলংকরণ নয়, বরং পালযুগের সমাজজীবনের এক চলমান চিত্রশালা। নিপুণ শিল্পীর হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে হাতি, ঘোড়া, সিংহ, ময়ূরের মতো প্রাণী; ফুটে উঠেছে পদ্ম, কল্পলতার মতো নকশা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো মানব-মানবীর চিত্র—তীর-ধনুক হাতে শিকারি, বাদ্যযন্ত্রে মগ্ন বাদক, নৃত্যরত রমণী আর যুদ্ধসাজে সজ্জিত যোদ্ধা। এই টেরাকোটাগুলো পাল আমলের সমাজ, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও দৈনন্দিন জীবনের এক অমূল্য ভিজ্যুয়াল আর্কাইভ।এছাড়াও খননের ফলে প্রাপ্ত ব্রোঞ্জের ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি, মূল্যবান পাথরের পুঁতি, লিপিযুক্ত পোড়ামাটির সিলমোহর এবং মাটির পাত্র প্রমাণ করে, ভাসু বিহার কেবল এক বিচ্ছিন্ন ধর্মশালা ছিল না। এটি ছিল এক সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যার সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ ছিল নিবিড়।
বিশ্বজনীন জ্ঞানকেন্দ্র: কেন ভাসু বিহার এতটা গুরুত্বপূর্ণ ?
নালন্দা, বিক্রমশীলা বা সোমপুর মহাবিহারের মতো ভাসু বিহারও ছিল প্রাচীন বাংলার এক শ্রেষ্ঠ জ্ঞানতীর্থ। এখানে কেবল ধর্মশাস্ত্র নয়, পড়ানো হতো যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা এবং শিল্পকলা। রাজধানী পুণ্ড্রনগরের সন্নিকটে এবং বাণিজ্যপথ করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় এটি একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। দূর-দূরান্ত থেকে বণিক, পর্যটক আর জ্ঞানপিপাসুরা এখানে আসতেন, যা এই বিহারকে এক বিশ্বজনীন চরিত্র দান করেছিল। এটি ছিল তৎকালীন বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক রাজধানী।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ: ঐতিহ্যের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা
বর্তমানে ভাসু বিহার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। এর সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর, প্রাচীন ইটের দেয়াল আর রহস্যময় পরিবেশ দর্শনার্থীদের এক অন্য জগতে নিয়ে যায়। সংলগ্ন জাদুঘরে প্রদর্শিত প্রত্নবস্তুগুলো সেই হারানো সময়ের গল্প বলে।
তবে এর সম্ভাবনা এখনও পুরোপুরি বিকশিত হয়নি। মহাস্থানগড় ও ভাসু বিহারকে মিলিয়ে একটি সমন্বিত পর্যটন মানচিত্র তৈরি করা প্রয়োজন। উন্নত যোগাযোগ, আকর্ষণীয় তথ্য উপস্থাপন এবং স্থানটির ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে প্রাণবন্তভাবে তুলে ধরতে পারলে এটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
কালের স্রোতে ভাসমান বাতিঘর
ভাসু বিহার ইট-পাথরের স্তূপ নয়, এ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের এক বাতিঘর। এর প্রতিটি ইটে, প্রতিটি টেরাকোটার ভাঁজে লেখা আছে জ্ঞান, শিল্প আর সাধনার অমর আখ্যান। এই নীরব ধ্বংসাবশেষের মাঝে দাঁড়ালে আজও যেন প্রাচীন ভিক্ষুদের প্রার্থনার সুর বাতাসে ভেসে আসে, যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এক আলোকিত অতীতের কথা। আমাদের দায়িত্ব, বিস্মৃতির ধূসর চাদর সরিয়ে এই অমূল্য ঐতিহ্যকে রক্ষা করা এবং এর গল্পকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া, যেন ইতিহাসের এই সোনালি অধ্যায় আমাদের চেতনায় চিরভাস্বর হয়ে থাকে।
লেখক: লেখক ও গবেষক