[পর্ব-১] বৈবাহিক ধর্ষণ- যাকে কেউ অপরাধ মনে করেনা!
৫ আগস্ট ২০১৮ ১৪:৩৮
শুরুর কথা
দেশের স্বনামধন্য একটি মানবাধিকার সংস্থায় প্রায় ১৬ বছর কাজ করেছি। নারীদের সমস্যা আর তাদের জীবন খুব কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছে আমার। কেউ এসেছে আইনগত সাহায্য চাইতে, কেউবা আইনের সহযোগিতা নয় শুধুমাত্র নিজের কষ্টের কথাটা বলে হাল্কা হতে চেয়েছে।
চেষ্টা করেছি তাদের চাওয়াটাকে প্রাধান্য দিয়ে সহায়তা করতে। মধ্যস্থতার কাজটি আমার দায়িত্বের মধ্যে ছিল। পারিবারিক যে সমস্যাগুলো শুধুমাত্র মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য এবং যে নারী মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধান চাইতো তাকে সেইভাবেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি।
সব সমস্যার যে মধ্যস্থতায় সমাধান করতে পেরেছি তা নয়! সেক্ষেত্রে আদালত অব্দি গড়িয়েছে। আমার দায়িত্বের জায়গা থেকে আমি কতটা সফল তা জানিনা। তবে মধ্যস্থতার এ কাজটা খুব নিষ্ঠা, সততা ও আবেগ দিয়ে করেছি। যার কারণে প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসার পরও শুনি ‘আপনার সালিশের জন্যই আমরা আজও ভাল আছি।’
সেই নির্যাতিত আর সংসারে অবহেলিত নারীটি যখন এ কথা বলে তখন একজন মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী হিসেবে নিজেকে সফল মনে হয়। আর ভাললাগায় ভরে ওঠে মনটা। যেসব নারী তাদের কষ্টের সময় সংস্থায় আসত সহায়তার জন্য সেইসব কষ্ট আর বেদনায় সিক্ত জীবন কাহিনীগুলো (নাম পরিচয় গোপন রেখে) ‘সারা বাংলার’ এই কলামে নিয়মিত লিখবার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। হয়ত তাদের জীবনের গল্পগুলো মিলে যেতে পারে আমার আপনার জীবনের সাথে।
নয়নতারার গল্প
খুব বড় বড় চোখ নিয়ে নয়নতারা (ছদ্মনাম) তাকায় আমার দিকে। খুব সাধারণ কাপড় আর বেশভূষার নয়নতারা। কথাবার্তায় খুব সাধারণ। তাকে আমার টেবিলের সামনের চেয়ারে বসতে বলি। খুব আস্তে জিজ্ঞেস করি, কী নাম তোমার? ওই দিন আমার রিসিপসনিষ্ট আমাকে বলে যায় তার নামটি।
নয়নতারাকে বলি, কোন সমস্যা নিয়ে এসেছেন?
সে খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে আপা, স্বামী স্ত্রীর সমস্যা। আপনাকে বলতে চাই। আর সহ্য হয়না। নয়নতারা চেয়ারে বসার আগেই তার দৈহিক অবস্থা দেখে বুঝি সে অন্তঃসত্বা। স্বাস্থ্য খারাপ। বলি, ক’ মাস? সে সলজ্জ হেসে বলে, আপা ৮ মাসে পড়েছে।
আমি তার সমস্যা শুনতে চাই। তার আগে তাকে মধ্যস্থতার নিয়মকানুন খুব সহজভাবে বুঝিয়ে দেই। নিরক্ষর নয়নতারা বিষয়টি বোঝে এবং খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। সে বলে, আপা আমি কোন মামলা করতে চাই না। সংসার চাই। আমি জানি আপা মামলা করলে সংসার হয় না। স্বামীর ভাত খাওয়া যায় না। আমি সালিশের মাধ্যমেই সমাধান চাই।
আমি তার সমস্যাগুলো শুনতে শুরু করি। নয়নতারা অভয় পেয়ে অনর্গল বলে যায়। নিদারুণ কষ্টের কথামালা। তবে প্রথমে সে বলে, আপা লজ্জা করছে।
আমি অবাক হয়ে বলি, কেন? তোমার লজ্জা, ভয়, সংকোচ সব ছাড়।
নয়নতারা বলে, আপা স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকলে শারীরিক মিলন হবেই। তাই বলে আপা আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, অসুখ-বিসুখ এমনকি মাসিকের দিনগুলোতেও সে বাদ দিবেনা। এ কেমন বলেন আপা? একটা পশু আপা।
আমি আবারও বলি, তুমি আমাকে লজ্জা করো না, ভয় করো না। সব খুলে বল। আমি তোমাকে সমস্যার সমাধান দিতে চেষ্টা করবো।
আবারও নয়নতারা বলতে শুরু করে। খুব গরীবের ঘরের মেয়ে আমি। বড় হওয়ার সাথে সাথে মা বিয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। একরকম ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলতে পারেন জোর করে বয়সের অনেক ব্যবধানে বিয়ে হয়ে যায় রহমত আলীর (ছদ্মনাম) সাথে। বিয়ের পর থেকেই নির্যাতন। শরীরের নির্যাতন সেই সাথে মারধর আর বাজে কটুক্তি। প্রতি রাতে হায়ানার মত ঝাঁপিয়ে পড়ত রহমত নয়নতারার শরীরে। না দিতে চাইলেই গালমন্দ আর সন্দেহ। পাছে ঘর ভেঙ্গে যায় এই ভয়ে নয়নতারা মেনে নিয়েই শরীর দিতে বাধ্য হতো। তাতে ছিলনা প্রেম, ভালবাসা বা যৌনতার ভাললাগা। লোকটা নিজের যৌনক্ষুধা মিটলেই নেমে পড়তো নয়নতারার উপর থেকে। আর বিকৃত কামলিপ্সাও সহ্য করতে হতো তাকে। নয়নতারা দাম্পত্যের সুখ কাকে বলে বোঝেনি। মনে করেছে এটাই হয়ত নিয়ম আর স্বামীর একচ্ছত্র অধিকার।
নয়নতারা প্রকৃতির নিয়মে একসময় অন্তঃসত্বা হয়। খুব খুশি সে। বলে, জানেন আপা আমার বয়স অনেক কম। তারপরও মা হব, কি যে ভাললাগা! অন্যরকম অনুভূতি। আমি আস্তে আস্তে লক্ষ্য করতে থাকি আমার শারীরিক পরিবর্তনগুলো। সে আমাকে কোন ডাক্তারের কাছে নেবে না বলে জানায়। সন্তান হবে তার জন্য আবার ডাক্তার কি! নয়নতারা গোপনে পড়শী রত্নাকে নিয়ে সূর্যের হাসি ক্লিনিকে যায়। ডাক্তার আপা আমাকে পরীক্ষা করে। ওষুধ আর কিছু নিয়ম কানুন লিখে দেয়। এ সময়টাতেও রহমত ছাড় দিতে রাজি নয়। তার লাগবেই।
নয়নতারা আবার ডাক্তার আপার কাছে যায় এবং সব খুলে বলে। আপা বলে, তোমার বয়স কম। শরীরের অবস্থাটাও ভাল না। এ সময়টাতে স্বামী-স্ত্রী মিলন না করাই উচিত। নয়নতারা ঐ দিনই বাড়ি ফিরে সিদ্ধান্ত নেয়। সে বাবার বাড়ি চলে যাবে। আর যাই হোক সুস্থ সন্তানের জন্য কোন আপোষ নয়। নয়নতারা তার ২/৪ টা কাপড় নিয়ে গরীব বাবার সংসারে গিয়ে ওঠে। মা, বোনকে বিষয়টি জানায়। ঐ রাতেই রহমত তাকে নিতে আসে। নয়নতারা সাফ জানিয়ে দেয় সে ফিরবেনা। নয়নতারাকে অকথ্য গালিগালাজ আর তালাকের হুমকি দিয়ে বেড়িয়ে যায় রহমত।
পরদিন পরিচিত একজনের মাধ্যমে নয়নতারা আমাদের সংস্থাটির সন্ধান পায়। আইনের সাহায্য চায় আর চায় তার অধিকার। এভাবেই আমি নয়নতারার কেস পাই। রহমতকে নোটিশ করে সংস্থায় ডেকে পাঠাই। মধ্যস্থতার দিনটিতে দুজনে আমার মুখোমুখি হয়। নয়নতারার চোখে মুখে ভয়। রহমতের হিংস্র আচরণ হয়তো মনে পড়ছিল তার।
নয়নতারাকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানাতে বলি। সে বলে, সন্তান না হওয়া পর্যন্ত আমি রহমতের ঘরে ফিরবো না। ও মানুষ না আপা। সে কেঁদে ফেলে। নয়নতারার সিদ্ধান্ত শুনবার পর রহমত ক্ষেপে ওঠে। বলে, ‘কন কি আপা, সে বাপের বাড়ি থাকলে আমার কি হইবে। আমার যত্নআত্তি ও রাতের কামের জন্য কই যাইব। আপনি কন?’
এত অসভ্য অশালীন অরুচিকর কথাগুলো শুনবার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এরপরও বহু কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে মাথা ঠান্ডা রেখে মধ্যস্থতার সিদ্ধান্তটি লিখিত করি। নয়নতারার সন্তান হবার পরেই স্বামীর বাড়ি ফিরবে এবং সংসার করবে। ঐ পর্যন্ত সকল খরচ (সন্তান হওয়াসহ) রহমত সংস্থার মাধ্যমে প্রতি মাসে পরিশোধ করবে। স্ত্রীর নিয়মিত খোঁজখবর রাখবে। অন্যথায় নয়নতারা রহমতের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। রহমত কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হয় এবং ভয়ও পায়। এক পর্যায়ে রহমত মেনে নেয় এবং সিদ্ধান্তপত্র সাক্ষর করে।
নয়নতারা সংসার চায়, সুখের সংসার। আর তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তার। নেই আর্থিক স্বচ্ছলতা।
‘আপা, মানুষটাকে আমি ভালবাসি। ওরে একটু বুঝায়েন।’
তার চোখ দুটি জলে ভরে ওঠে। নয়নতারা সিদ্ধান্তনুযায়ী বাবার বাড়িতে ফিরে যায়। আর যাওয়ার সময় বলে যায়, ‘আপা, সন্তান হওয়ার পর রহমতরে নিয়া আপনার কাছে আসবো। আপনি বুঝাইলেই সে ঠিক হইবো।’
আমি নয়নতারার ফিরে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি আর ভাবি, হায় নারী। এরপরও সংসার!
এমনি অনেক নয়নতারা রয়েছে আমাদের সংসারে। বিয়ের পরে পরম আশ্রয়ের জন্য স্বামীকেই নির্ভরযোগ্য মনে করে দেশের অধিকাংশ নারী। কিন্তু সেই স্বামীর দ্বারাও স্ত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। যাকে বলা হয় ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বা ম্যারিটাল রেপ। যখন বিবাহিত সম্পর্কে স্বামী জোর করে বা ভয় দেখিয়ে স্ত্রীর অসম্মতিতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে সেটাই বৈবাহিক ধর্ষণ। পৃথিবীর কোন কোন দেশে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হলেও বাংলাদেশে এ সংক্রান্ত কোন আইন নেই। এ দেশের আইনে বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত নয়। বাংলাদেশে অধিকাংশ পুরুষ স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনকে বৈধ মনে করে এবং এক্ষেত্রে নারীরও কিছু করার থাকে না। অধিকাংশ নারী জানেই না মেরিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণ বলে কিছু আছে। কারণ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলে গণ্য করার প্রয়োজন সরকার বা সংশ্লিষ্ট আইন প্রণেতাদের নেই, ফলে কোন উদ্যোগও নেই।
এটিকে অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আইনের আওতায় আনা উচিত। কারণ নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন একপ্রকার নির্যাতন। এ বিষয়টিকে অধিকাংশ পুরুষ নির্যাতন মনে করে না। ভাবে এটি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের স্বাভাবিক অংশ, যা নিন্দিত, ঘৃণিত ও পীড়াদায়ক। আমাদের সমাজের ৯০ শতাংশ নারী আজও স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার। আমরা তা জানিনা কিংবা জানলেও কোন প্রতিকারের পথ দেখাতে পারি না।
তাই আর নয় এমন নয়নতারা ,যারা জানে না বিবাহিত জীবনের সম্পর্কে তারও ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য আছে। নয়নতারা তোমরা সচেতন হও আর প্রতিবাদ কর। রুখে দাঁড়াও। প্রতিবাদ কর, যেন বৈবাহিক ধর্ষণকে আইনের আওতায় আনা হয়। ওই সমস্ত ঘৃণিত পুরুষদের শাস্তি দেওয়ার সুযোগ করে দাও। এ বিষয়ে আমাদেরও কাজ করবার আছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মহলকে উপলব্ধে করানোর আছে। তা না হলে নয়নতারাদের দুর্ভোগ আর অপমান কোনদিন শেষ হবে না।
নাহিদ শামস্- আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
সারাবাংলা/এসএস