Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রহিমা


১০ আগস্ট ২০১৮ ১৩:৪২

শাহনেওয়াজ কাকলী

শাহনেওয়াজ কাকলী ।।

 

ছাদের উপর রহিমার সাথে কত চুপ চুপ করে স্বামী স্ত্রী খেলতাম। প্রথম প্রথম সে জামা পরে বেড়ালেও হঠাৎ দেখি একদিন সে শাড়ি পরা শুরু করলো মাত্র ১০/১২ বয়সেই।

বিকেল হলেই চোখে কাজল টেনেই পাড়ার সব বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখা, রাস্তা দিয়ে হেটে বেড়ানো ছিল প্রিয় শখ। এবং কার বাড়িতে কে কে আছে? তা ছিল নখদর্পণে।
পাড়ায় নতুন কোন ছেলে এলে আমরা নজরবন্দী করতে পারতাম নতুন আগন্তুক হিসেবে যেমন, ঠিক খুঁজেও বের করে ফেলতাম সে কোন বাড়ির ছেলে । এ ছিল আমাদের কৈশোরের অসাধারণ প্রতিভা। পরের দিকে এসব বেশি আমি আর ময়নাই করতাম কারণ রহিমা তখন আর আমাদের মাঝে ছিলনা।

আমার খুব ঘনিষ্ঠ কাছের বান্ধবী ছিল দুইজন। একজন ময়না আর অন্যজন রহিমা।
আমাদের বাড়ির ডানহাতে ব্রিজের পাশেই খালের ধারে রহিমাদের বাড়ি। আর বামহাতের পাশের বাড়িটি ময়নাদের ছিল। আমরা তিনজন ছিলাম পাড়াবেড়ানি।

রহিমাকে আম্মা পছন্দ খুব একটা করতো না। কিন্তু সেটা রহিমা কোনদিন জানতো না কারণ বাড়িতে এলে আম্মা রহিমাকে একটুও বুঝতে দিতো না। ভাল আচরণ করতো। সেই সময় আম্মাকে দেখলে পাড়ার অনেকেই কাঁপতো ভয়ে। কেউ আম বা লিচুগাছে ঢিল দিলে আম্মার হুংকার; কেরে..? তাতেই দৌড়। কাজেই রহিমাও চুপিচুপি প্রবেশ করতো। আর আমাদের তো খেলার সময় আগেই চুড়ান্ত থাকতো কবে রান্না বাটি, কবে চাল ডাল ডিমের পিকনিক, গোল্লাছুট, কুতকুত, ইচিং বিচিং, ছি বুড়ি সব। সবাই শুধু সময়মত আমাদের বাড়ির সামনে খোলাজায়গা মাঠে সেখানে এসে হাজির হতো সকাল বিকাল।

রহিমা ছিল দোকানদারের মেয়ে, সে ব্যাপারে আম্মার কটু দৃষ্টি ছিলনা, কিন্তু দৃষ্টি ছিল রহিমার শাড়ি। তখন আমরা মাত্র ক্লাশ ফোরে পড়ি, এই বয়সী একটা মেয়ে দাদীর শাড়ি পড়ে ছুটোছুটি করে বেড়াতো। ওর মধ্যে একটু পাকা স্বভাবও ছিল। ইস্কুলে ফেল করতো বারবার তাই তাকে শাড়ি পড়িয়ে অভস্থ্য করানো হচ্ছে এই ভেবে ওকে বিয়ে দিয়ে দেবে।

বিজ্ঞাপন

দরিদ্র্রতার কারণে আম্মা রহিমাকে অবহেলা করতো না, করতো অন্য অনেক কারণে। ওদের বাড়ির সামনে দোকান আর দোকানের সাথেই ওদের শোবার ঘর। টানা সব ভাইবোন, বাবা-মা এক সাথেই ঘুমাতো। চিপা উঠানের একপাশে ওর দাদীর ঘর ছিল। ও দাদীর সাথেই ঘুমাতো। দাদীর দশহাতি শাড়িগুলোকে ছোট করে ওকে পরতে দিত। তারপর উঠানজুড়ে ঘর আর ঘর। টানা ঘরগুলোতে যারা ভাড়া থাকতো প্রায় সময় ঝগড়া, মারামারি, চুল ছেঁড়াছেড়ি করতো। আমরা দৌড়ে জানালা দিয়ে দেখতে গেলে আম্মা পিছন দিয়ে বিছানার ঝাড়ু দিয়ে সিনেমা দেখা বন্ধ করে দিত।

ইতিমধ্যে নিশ্চয় বোঝা গেল কেন আম্মা রহিমার সাথে খেলতে দিত না? আবার আমাদের সাথে এসে রহিমা খেলতো বলে হয়তো আম্মার একটা মায়াও কাজ করতো। মাঝে মাঝে আম্মা রহিমাকে ধরে বসতো, এই তোদের বাড়িতে এই রকম ঝগড়াবিবাদ লাগছে কি নিয়া রে? রহিমা খুব বেশি বলতে পারতো না দেখে আম্মাই কথা শেষ করে বলতো “দাঁড়া, আমি তোর বাপকে ধরবো ভদ্রলোকের পাড়ায় এসে বাড়ি বানায়ে বস্তী ভাড়া দেয়, তাই না। দুইদিন পর পর জঘন্য গালিগালাজ এরপর আমি পুলিশ ডাকবো।
আম্মার এই অগ্নিমূর্তি দেখে যেমন ভয় পেতাম তেমন রাগও হত; খেলার সময়টা চলে যাচ্ছে।

রহিমার বাবা পেশায় একজন দোকানদার হলেও তার চেহারাটা মনে হলেই মনে হত উনি খেঁজুর গাছের ওপরে ঝুলছে। কতগুলো রশি, একটা মাটির পাতিল আর একটা কাঁচি বা কাস্তে নিয়ে চলছে। রস পেড়ে জীবিকা নির্বাহও ছিল তার অন্যতম প্রধান কাজ।
এই খেজুররসের গল্প খানিকটা রসময় গুপ্তের রসের মতই।

পড়ন্ত বিকেলগুলোতে রহিমার আসতে দেরি হলে ব্রীজ পার হয়ে দৌড়ে ওদের বাড়িতে ছুটে যেতাম।
ওদের বাড়িতে ঢুকলেই একটা চিপাগন্ধ নাকটাকে ঝাঁজিয়ে তুলতো। বিশ্রী গন্ধগ্রহণে ওকে বাহিরে এনেই বলতাম, তোদের বাড়িতে কেমন একটা গন্ধ। কিসের গন্ধ রে? ও প্রথম প্রথম কিছুই বলতো না। অনেক পরে জেনেছি এই গন্ধ ভাতপচা গন্ধ।
আম্মা তো আর সাধে সাধে ওর সাথে মিশতে মানা করতো না। আর তাঁর মেয়ে কেনই বা একজন দোকানদারের মেয়ের সাথে মিশবে যদিবা মেয়েটি স্কুলে পড়তো ভিন্ন কথা ছিল।

বিজ্ঞাপন

আমরা যখন স্কুলে পাঠে মনোযোগী তখন সে পুরো সময়টা নুরপুরের বস্তিবাসীদের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াতো। আমাদের চেয়ে তার অভিজ্ঞা ভিন্নমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আমি বা ময়নার বোঝার ক্ষমতা কম ছিল। রহিমার অনেক ভাইবোন ছিল সিঁড়ির মত। প্রতি বছর ওদের নতুন নতুন ভাইবোন হত। দৌড়ে দৌড়ে ওদের বাড়িতে আতুরনিবাস চিনে আসতাম। কুলসুম খালাকে বেশিরভাগ সময় অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় চোখে পড়তো। মনে পড়ে এখনো।

একবার একটি ছোট নিচু দেয়ালের উপরে বসে আমরা গল্প করছিলাম। রহিমা ছিল দেয়ালের বসা আর আমি ওর পায়ের কাছে হঠাত কি মনে হলো আমি ওর পা উঁচু করে তুলে ধরতেই নিয়ন্ত্রন হারিয়ে উল্টে পড়ে গেলো সে ইটের উপর।ইটের মধ্যে ওর মুখ গিয়ে আঘাত পায়। ভয়ে ওকে দ্রুত তুলে ধরি। ও তখন কাঁদতে কাঁদতে মুখের সব ময়লা পরিষ্কার করছে। আমরাও ওকে সাহায্য করছি। আমিও অনুতপ্ত মনে সাহায্য করছি তাই চোখের কাছের বালিগুলো টেনে সরিয়ে দেই। সাথে সাথে রহিমা আঃ শব্দে চেঁচিয়ে উঠতেই দেখি ও’র ভ্রু উঠে এসেছে আমার হাতে। হায়রে সেকি কান্না! ও মোর ভ্রু… নাই। আল্লাহ্‌রে! মোর কেমন করিয়া বিয়া হইবে। আব্বা তো আমাকে মারবে। আমি, ময়না আর কোহিনুর তিনজন ওকে শান্ত করে বলি তুই বাড়িতে বলিসনা হ্যাঁ, বলবি পড়ে গেছিস খেলতে খেলতে। বল, আল্লাহ্‌র কিরা। আমাকে মাফ করে দে। তুই বাড়িতে বলিস না। ও কেঁদেই চলছে। খুব খেয়াল! এরপর ধীরে ধীরে ওর ভ্রু গজিয়ে যায়।

প্রতিদিন বিকালে তিনতলার ছাদের উপর বসে পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে পেয়ারা, বরই, কাঁচা আম খেয়ে গুপ্তপাড়ার ছেলেদের দেখা ছিল আমাদের বয়ঃসন্ধিকালের রোমাঞ্চকর স্মৃতি। তখন আমরা ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। একটু একটু প্রেম বুঝি এবং মনেও জাগে। কেউ একজন মিঠুন চক্রবতীর মত গলায় মাফলার পেঁচিয়ে, সাদা প্যান্ট আর গ্যাবাডিনের শার্ট পরে আসলে স্বয়ং ভি.সি.আর. ভেঙে যেন বোম্বের হিরো এসে সামনে হাজির হতো। খিক খিক হাসিতে, বারবার নিজের সিল্কী চুলগুলো সরিয়ে কী এক ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা! হিরো একজন হিরোইন সবাই। এরমধ্যে যে যে ব্যক্তিগত স্বপ্ন দেখতো সে সে স্কোরে এগিয়ে যেতো। তেমনি আমি একদিন স্বপ্ন দেখেছিলাম ওই ছেলেটাকে নিয়ে, সেটা বলার জন্য ছিল গোপন আলাপন। আজও মনে আছে সেই স্বপ্নটা; সে আমাদের বাসায় এসেছিল আমি আম্মার বানানো আচারের বয়াম থেকে আচার বের করে তাকে খেতে দিয়েছিলাম। বাকি চোখাচোখি হয়তো জয়া প্রদা-জিতেন্দ্র, হেমা মালিনী-ধর্মেন্দ্র কাছ থেকে কপিপেস্ট।

সত্যি মনের মধ্যে যেন কী কী হত! ছেলেটাকে চিনিনা, জানিনা কিন্তু রোজ নির্দিষ্ট সময়ে এসে দূরের মোড়ে কিপটা বুড়ার বাড়ী ঘেঁষে কিছুক্ষণ দাঁড়াত আর আমরা ছাদের উপর থেকে নিজেদের মধ্যে অদ্ভুত নাটকীয়তা করে আকর্ষণ সৃষ্টি করতাম।
সেই ছেলেটিও ইশারায় হাত তুলে মাইর দেখাত। কি এতবড় সাহস! আমাদের মাইর দেখায়… ওর নামটা খুঁজতে হবে, বাড়ি কোনটা বের করতে হবে? এই ছিল আমাদের কিশোরী অবুঝ প্রেম কিংবা প্রেমময় ধুসর স্মৃতি।

একদিন দুপুরে আমরা স্কুল থেকে ফেরার পথেই রহিমা আমাদের অপেক্ষায় ব্রীজের উপর দাঁড়ান। কথা আছে; আল্লাহ কী সংবাদ কে জানে?

খুব গোপন আলাপন চলছে তিনজনের মধ্যে- ছেলেটির নাম নাকি ফেরদৌস! লজ্জাবতী লতার মত শরীর অবশ হয়ে আসছে। সত্যি তো ওর নাম ফেরদৌস! তুই কিভাবে পাইলি এই নাম?

বল! বল! রহিমা তিন সত্যি আর আল্লাহর দিব্যি কেটেই নাম নিশ্চিত করে।

নাম পাওয়ার সত্য ঘটনা রহিমা এভাবেই বলা শুরু করে; কাল রাতে আমি দোকানের পাশের ঘরেই ঘুমাইছি। রাতে দেখি গুপ্তপাড়ায় ছেলেরা আসছে। আমি বলি-যারা আমাকে টিকটিকি বলে ডাকে। আজাদ,ধলু, পেসকা আরো কি কি নাম যেন ছিল। তারপর,তারপর বল কি হলো? রহিমা আরো বলে- ঘুমের মধ্যে দেখি ওই ছেলেগুলার সাথত ওইয়ো আসচ্ছে। আর ওরা তো ওই নামই ডাকছে। আমি না ঘুমের ভান ধরিয়া পড়ি ছিলাম। ওদের না সইগ কথা শুনিয়া ফেলছি। কী বলিস! ওরা তোদের বাসায় এতো রাতে কেন আসছে? দোকান বন্ধ করে ভিতরে বসে কি করতেছিল? আমার কথার পর ও একটু চুপ থেকে আবার বলে রস খাইতে আসছে। ওরা তো প্রায় রাইতেই রস খাইতে আসে। তোদের বাসায় রসের গন্ধ এমন কেনরে? কই আম্মা যে রসের পায়েশ রান্না করে এমন গন্ধ তো হয়না।

-আমরা রস মচাই তো সেজন্য এমন গন্ধ করে।
– তুই যে সেইদিন বললি তোদের বাসায় ভাতের গন্ধ এমন, আমি দেখছি তোদের বাড়িতে মাটির পাতিলে ভাত আর ভাত।
– হ্যা তো ভাত পচায় তো অই রস বানান।
– তাইলে ওরা কেন আসছে তোদের বাড়িতে?
– তাড়ি খাইতে।
– কী ওরা তাড়ি খায়। মদ তাড়ি তো খারাপ ছেলেরা খায়। তোর আব্বা এগুলা কেন বানায় রে?
– আমি কি জানি? রহিমার শেষ উত্তর।

একদিন রহিমা আমাদের জন্য সংবাদ বয়ে এনেছিল বটে, তাতে কি? আমাদের আবেগ কাঁচের টুকরা টুকরা হয়ে গেল। মনের মধ্যে ক্ষোভ আর ঘৃণা বাসা বেঁধেছিল যদিও সেটা কোন প্রেম পর্যায়ের পরিণতি ছিলনা তবুও আবেগের প্রথম বুদ বুদ হৃদয়স্থলে। তাতো অস্বীকার করা যায়না।

ঘৃণা আর ঘৃণা। আমরা আর তাকে ছাদ থেকে দেখতে চাই না। আমাদের মুখ ঘুর্বে গেছে আমাদের পাড়ার দিকে। কিন্তু সে রোজই আসে। আমরা তার ব্যাপারে অমনোযোগী, শুধু তাই নয় রহিমাকে সে ব্যাঙ্গার্থক কথা বলায় ঘৃণায় অগ্নিকন্যা হয়ে উঠি। রহিমা আমাদের চেয়ে এক দুই বছরের বড় ছিল। কাজেই ওর শীর্ণ শরীরে আগেই স্তনের দেখা দেয় প্রাকৃতিকভাবেই।

খুব ছোটকালে ও আমাকে ছাদের উপর নিয়ে গিয়ে জামা তুলে ওর মাত্র ফুলে উঠা চামড়ার অস্তিত্ব দর্শন করায়। আসলেই ও পাকা এবং পরিবেশগতভাবে অশিক্ষায় বেড়ে ওঠায় আমাদের আগেই সবকিছু জেনে যাচ্ছিল। সেকারণে আম্মার হয়তো ভেতরে ভেতরে গা জ্বলে যেতো। আমাদের বাড়িটা ষাট দশকের অদ্ভুত জাহাজ আকৃতির, এই বাড়ির মাস্তুল আর কয়লা ইঞ্জিনের ব্যবধান ব্যাপক। রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় আরেক মাথার খবর রাখা। আমরা প্রায়ই কোনাচিপায় বসে রান্নাবাটি খেলতাম বড়দের চোখের বাইরেই। রান্নাবাটি খেলায় রহিমা প্রায় নির্দেশনা দিত। ওর বেশ প্রিয় ছিল স্বামী-স্ত্রী/ বাবা-মা খেলা। বাজার করা মানে ফুল তোলা, ইট বালি,পাতা বিভিন্ন উপকরণ খুঁজে এনে চলতো রান্নাকরা। তারপর গোসল; কখনো ডুব দিয়ে, কলচিপে নানান অভিনয়ে স্নান সেরে খেতে বসা। কটকট শব্দে পাতার থালায় খাবার খেয়ে আমরা শুয়ে পড়তাম। এবার সেই শুতে যাওয়া মানে বাবা-মার গোপন আচরণ। যেহেতু আমি ৪ বছর বয়সে বাবা হারিয়েছি আর আম্মার কোলেই ঘুমাতাম আমার তো বাবা-মা, বাবা-মা খেলা সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞাই নাই। সেই রহিমা আমাকে শেখালো এসব। কত গোপন তথ্য সে আমার মাথায় দেয়। কিছু বুঝি আবার কিছু বুঝিনা। খেলায় অভিনয়ে বান্ধবীর সাথে সহবাস হলে আমাদের সকাল হয়। দ্রুত উঠে হাত মুখ ধুয়ে ঘড়ি পড়ে দরজা লাগিয়ে আমরা অফিস চলে যাই। দুপুরবেলা খাবারের সময় হয়ে যেতো বলে খেলা সমাপ্তি করে বিকালের গোল্লাছুটের আশায় যে যার বাড়িতে চলে যেতাম।

রহিমা তার দশহাত শাড়ির ভেতর দ্রুত বড় হতে লাগলো, একদিন সত্যি ওর বিয়ে হয়ে যায় তখন আমরা ষষ্ট বা সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রী। ভালই বিয়ে হলো ওর, স্বামী রেডিও তে চাকুরী করে। বাঁশীবাদক। বেশ সুখী সুখী ভাব নিয়ে পাড়ায় এসে ঘুরে বেড়াতো। আমি মন দিয়ে ওর সাজসজ্জা দেখতাম। হাতে চুড়ি, কানে দুল, এখন আর দাদীর শাড়ি নয়, নিজের মাড় দেয়া সুতি শাড়ি পরিহিতা রহিমা। শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেই ওর ছোটভাই বোনদের কোলে করে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতো।

রহিমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে আম্মা আমাদের তার সাথে বান্ধবীত্ব বজায় রাখতে দিবেন, মোটেও না। চোখে চোখে পাহারা যেন তিনগুণ বেড়ে গেল। রহিমা এলে আমাদের সাথে যেন আলাদা গল্প করতে না পারে তাই আম্মাই ওকে নানান প্রশ্নে গল্প শুনতো। কিরে তোর শ্বশুর কেমন? শাশুড়ি কেমন? স্বামীরা কয় ভাইবোন ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আমাদের এগুলো পাঠ্যপুস্তকের বাহিরে জটিল লাগতো। চা পানি বিস্কুট খাওয়ায় আম্মা বিদায় দিত, আমাদের সাথে আর আলাদাভাবে গল্প হয়ে উঠতো না। সেটা আসলে ছিল আম্মার টেকনিক। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় তার যে অভিজ্ঞা আর আমরা এখনো শিশুতোষ চিন্তার দেয়ালেই আবদ্ধ। তাই সেখানে কোন যৌনকামনা গল্পে আমাদের মস্তিস্কে যেন কাউয়ার বাসা না বাঁধে সেটাই ছিল আম্মার খেয়াল। আমরা ছিলাম নজর বন্দী।

সেই সময়ে আমাদের হাজার হাজার মায়েদের স্কুল ডিঙিয়ে কলেজ ওঠার সৌভাগ্য কমই হয়েছে কিন্তু তারা তাদের জ্ঞানের সর্বস্ব দিয়ে নিজেকে একজন মা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। শত শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে বটগাছের মত একেকজন মা, আমাদের বাঙালী মা। তাদের চোখ এড়ায় না সন্তানের অমঙ্গল।

পৃথিবীতে সকল মঙ্গল কামনা নিয়ে আসেন একজন মা। মা হলেন প্রকৃত ঈশ্বর।
দুর্গাদেবীর দশহাত এক মহীয়সী নারীর শক্তি রূপী মা হলেও বাস্তবে আমাদের মা’দের চোখ ছিল মাছির চোখের মত চতুর্দশীযুক্ত।

কাঠমিস্ত্রির সন্তান যদি শিক্ষিত হয় তার সাথে বন্ধুত্ব করো, আর ডাক্তার উকিলের সন্তান যদি অশিক্ষিত হয় তারসাথে কথা বলাও বিপদজনক- এটা ছিল আম্মার উক্তি। এই বাণীর মর্ম অনেক সন্তানই অনুধাবন করতে অক্ষম হওয়ায় বিপদগ্রস্ত হয় বটে।
এর মানে এই না যে আম্মা মানুষ ঘৃণা করেছে। কয়েক বছর আগেই আম্মা একদিন বলে রহিমা তো তোমার কথা প্রায়ই বলে, ও ভালোই আছে আল্লাহ্‌র রহমতে। আহারে! ওর বাবাটা খুব অসুস্থ। মুখের জবান নাই। শীতে খুব কষ্ট পাচ্ছে। কিছু গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

আম্মা আমাদের মেলামেশার ব্যাপারে ছিল সতর্ক। এখন অনেক বড় হয়ে বুঝি কেন ছিল সেইসব দিনের শাসন?

 

সারাবাংলা/আরএফ

 

রহিমা রহিমার শাড়ি শাহনেওয়াজ কাকলী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর