‘মেয়েদের পেশা- অমুকটা ভাল তমুকটা খারাপ’- এসব কারা বলে?
১৩ আগস্ট ২০১৮ ১৩:৪৮
তিথি চক্রবর্তী।।
বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় জীবনটাকে ভালভাবেই উপভোগ করতেন মৌসুমী জান্নাত (ছদ্মনাম)। একটি প্রাইভেট সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে প্রথম চাকরি শুরু করেন। এরপর মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যান চার মাসের জন্য। ছুটি শেষে অফিসে ফিরে দেখেন তার জায়গায় একজন পুরুষকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর তাকে বদলি করা হয়েছে মুন্সিগঞ্জে। কারণ জানতে চাইলে বলা হয়, মেয়েরা এই ধরনের কাজের জন্য যোগ্য না। হেড অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কাজ মেয়েরা সামলাতে পারবে না।
মৌসুমীর মত অসংখ্য নারী পেশা নিয়ে নানা ধরনের জটিলতায় পড়েন। আবার পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও স্বামী, বাবা কিংবা পরিবারের বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। জন্মের পর থেকে আমরা ছেলেদের পেশা ও মেয়েদের পেশার পার্থক্য সম্পর্কিত একটা ধারণা পেয়ে যাই। ছেলেদের পেশাগুলো হবে চ্যালেঞ্জিং আর অপেক্ষাকৃত কম চ্যালেঞ্জিং, কিছুটা আরামদায়ক ও কোন জায়গায় বসে কাজ করা যায়- এমন পেশাগুলো হবে মেয়েদের। সেই অর্থে মেয়েরা হবে শিক্ষক, ডাক্তার কিংবা প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আর ছেলেরা ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, বৈমানিক, স্থাপত্যশিল্পী হবে।
সমাজ বা পরিবার কেন নারী ও পুরুষের পেশাকে আলাদা করে?
এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে।
আদিম সাম্যবাদী যুগে নারী ও পুরষের কাজের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। সব কাজ নারী, পুরুষ উভয়ই করত। তখনকার সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। নারীরা উৎপাদনশীল কাজ যেমন পশুপালন, ফলমূল সংগ্রহ ইত্যাদি করত ও পুনরুৎপাদনশীল কাজ অর্থাৎ সন্তান গর্ভে ধারণ করার কাজটিও নারীর। উৎপাদনশীল ও পুনরুৎপাদনশীল দুটো ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা ছিল এবং তখন পরিবার ছিল মাতৃপ্রধান।
পরবর্তীতে দাস সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা তৈরি হয়। ফলে সম্পত্তিতে উত্তোরাধিকারের প্রশ্নটি চলে আসে। পরিবারের চিত্র অনেকটা পাল্টে যায়। সন্তান গর্ভে এলে বাইরের কাজে নারীর অংশগ্রহন কমে যেতে লাগল। ফলে পুরুষরাই বাইরের কাজ করত। আর নারীর গর্ভে যে সন্তান আছে তাকে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ভাবা হত। এরপর নারী ঘরেই বেশিরভাগ সময় কাটাত। তাই সন্তান লালনপালন ও রান্না করা ছিল মূলত নারীর কাজ। আর পুরুষ বাইরের কাজগুলো করত।
যেহেতু উৎপাদনশীল কাজে অর্থ আসে, ফলে পুরুষের হাতেই অর্থ থাকত। এভাবে কর্তৃত্ব চলে গেল পুরুষের হাতে। মেয়েদের এই দৈন্যদশাকে দার্শনিক ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ বইয়ে ব্যাখ্যা করেন, “ইতিহাসে নারীর প্রথম পরাজয়” হিসেবে। এই পরাধীনতা যুগ যুগ ধরে নারীকে এবং নারীর পেশাকে প্রভাবিত করছে। বর্তমানে নারী চাকরি করছে, পরিবারের হাল ধরছে। কারণ পুরুষের একার উপার্জন দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই যে কাজগুলো করলে নারীর সাংসারিক কাজে সমস্যা হবে না, সেগুলোই ‘নারীর পেশা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এজন্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পরও অনেক নারী শিক্ষকতা বা এনজিও কর্মীর পেশা বেছে নেন। অথচ পুরুষকে সংসারের কথা বিবেচনা করে পেশা নির্বাচন করতে হয় না।
প্রাকৃতিক কারনেই নারী পুরুষের শারীরিক গড়ন ভিন্ন হয়। এই ভিন্নতা ছাড়া বাকি সমস্ত বৈষম্যই সমাজ আরোপিত। যেমন জন্ম থেকেই ছেলে ও মেয়েদের বেড়ে ওঠার মধ্যেও পার্থক্য থাকে। ছেলেরা সাইকেল, বল, পিস্তল এসব দিয়ে খেলে। আর মেয়েদের খেলনা হয় পুতুল ও হাড়ি পাতিল। অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই একজন মেয়েকে শেখানো হয় রান্না ও ঘরের কাজগুলো তার। আর বাইরের কাজগুলো ছেলেকে দিয়ে করানো হয়। ব্যাংকের কাজ মানে টাকা পয়সার হিসাব রাখাও ছেলেদের কাজ হিসেবে গণ্য হয়। তাই মেয়েদের জামায় পকেট থাকে না। এভাবে ছোটবেলা থেকেই মেয়েকে ‘নারী’ হিসেবে ও ছেলেকে ‘পুরুষ’ হিসেবে বড় করা হয়, মানুষ হিসেবে নয়।
আমাদের সমাজে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হল- মেয়েরা শারীরিক পরিশ্রম করতে পারেনা। এজন্য আরামদায়ক পেশা তাদের জন্য উপযুক্ত। অথচ একটু গভীরভাবে চিন্তা করে বোঝা যায়, সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণির অধিকাংশ নারী কায়িক শ্রমের সাথে যুক্ত। ফসল উৎপাদন, ইট ভাঙ্গা ও নির্মাণের মত কঠিন কাজগুলো নারীরাও করছে।
অনেক দেশের মত বাংলাদেশি নারীরাও আজকাল খেলাধুলায় এগিয়ে যাচ্ছে। কোনক্ষেত্রেই নারী পিছিয়ে নেই। তবে কেন নারীকে এমন অপবাদ মেনে নিতে হয়? ছোটবেলা থেকেই তো বাড়ির চারদেয়ালে বন্দি থাকে নারী। বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করার সুযোগ পায় না। ফলে শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল হওয়াই স্বাভাবিক। এজন্য নারী তো দায়ী না। দায়ী এই সমাজ।
আবার সমস্ত যোগ্যতা থাকার পরেও নারীকে তার পছন্দের পেশা নির্বাচনে অনুৎসাহিত করা হয়। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক শারমিন নিপা (ছদ্মনাম)। তারঁ ইচ্ছা ছিল অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা করার। কিন্তু পারেননি। অফিস থেকে বলা হয়েছে, এসব কাজ মেয়েদের দিয়ে হয় না। ছেলেরাই যেখানে হিমশিম খেয়ে যায়, সেখানে মেয়েদের পারার তো প্রশ্নই আসে না! এভাবে নারীর বুদ্ধিমত্তা ও যোগ্যতা পদে পদে ভূলুন্ঠিত হয় আমাদের সমাজে।
কখনও কখনও শিক্ষিত নারীও কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতায় পড়েন। চাকরিতে যৌন হয়রানি, নিম্ন মজুরি, খারাপ পরিবেশ, নিম্ন মর্যাদা ইত্যাদির মুখোমুখি হন।] ফলে উৎসাহ নিয়ে পছন্দের পেশায় আসলেও টিকে থাকা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়না।
অনেক বাধা অতিক্রম করে যেসব মেয়ে চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন তাদের সমস্যার শেষ নেই। সবাই যেন তাদের দিকে বাঁকা চোখেই তাকায়! সাংবাদিক শেখ সিরাজুম মুনিরা কাজ করেন একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে। তিনি বলেন, প্রথম ঢাকায় এসে একটি সাবলেট বাসা খুঁজে পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় আমাকে। সাংবাদিক বলে রাতে বাসায় ফিরি। তাই বাড়িওয়ালারা ভাড়া দিতে চাইত না। অথচ আমার পুরুষ সহকর্মীরাও রাতেই বাসায় ফিরছেন। তাদের ক্ষেত্রে বাসা নিয়ে কোন সমস্যা হচ্ছে না।
সমাজের মধ্যে আরও একটি বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, ড্রাইভিং মানেই ছেলেদের পেশা। নারী গাড়িচালকের পেছনে বসে অনেকেই কৌতুহলভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কোন নারী বাইকচালকের পেছনে বসে পুরুষের যাত্রা আজও মানুষের মনে হাসির খোরাক যোগায়। বিআরটিসি ২০১২ সাল থেকে মহিলা বাস সার্ভিস চালু করলেও আজ পর্যন্ত কোন বাসে নিয়োগ করা হয়নি নারী চালক। গাড়ির চালকের আসনে নারীকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।
নারীর পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সামাজিক বা পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও আজকাল অনেক নারী নিজের চেষ্টায় সেগুলো অতিক্রম করছেন। বকুল রায় (ছদ্মনাম) একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট। বাবা লালমণিরহাটে একটি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে ডাক্তার কিংবা শিক্ষক হবে। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছা তো ভিন্ন!
‘ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল পুলিশ হওয়ার। একটু বড় হওয়ার পর এক আত্মীয়কে দেখে আর্মি অফিসার হওয়ার সাধ জাগল। আমার এ ধরনের ইচ্ছায় বাবা, মায়ের আপত্তি ছিল বরাবর। তারা মনে করেন, মেয়েরা এ ধরনের পেশায় গেলে বিয়ে ও সংসার করা কঠিন হয়। তারপরও নিজের ইচ্ছাতেই পরবর্তীতে ট্রাফিক সার্জেন্টের পেশা গ্রহণ করি। দেখা যাক, সংসার-বিয়ে এসব আমার কপালে আছে কি না’।
হাসতে হাসতেই বললেন বকুল।
অভিভাবকরাও নানা ধরনের চিন্তা থেকে মেয়েদের পেশার ওপর কিছু বাধা নিষেধ আরোপ করেন। শুরুতেই মৌসুমী জান্নাতের কথা জেনেছি। তিনি বিয়ের পরও ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতেই আছেন। কথা হল তার স্বামী তানভীর খানের সাথে। বললেন, স্ত্রীর পেশা নিয়ে তিনি কোন আপত্তি করেননি। তার বাবা মায়ের সহযোগিতায় একমাত্র সন্তান লালনপালনে কোন সমস্যা হচ্ছে না। অন্যদিকে, বকুল রায়ের মা মেয়ের পেশা নিয়ে বেশ চিন্তিত। তিনি বললেন, ট্রাফিক সাজেন্টের পেশা মেয়েদের জন্য না। মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, শ্বশুর বাড়ির লোকজন মেয়ের পেশা নিয়ে ঝামেলা করবে। তখন সংসার সামলানো কঠিন হয়ে যাবে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পেশাগত দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে দেয় নারীকে। সন্তান দেখাশোনা, রান্না করা ও সংসার সামলানো যেন শুধু নারীর কাজ! দিনশেষে পুরুষের ঘরনী হয়ে থাকাই যেন নারীর গুরুত্বপূর্ণ পেশা। নারীবাদী লেখক কমলা ভাসিনের একটি উক্তি এক্ষেত্রে অনেকটা প্রাসঙ্গিক।
“যদি একজন নারী রাঁধতে পারে, তবে একজন পুরুষও তা পারবে
কারণ, নারী তার জরায়ুর সাহায্যে রান্না করেনা।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন্স এন্ড জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. সোমা দে বলেন, মেয়েদের উৎপাদনশীল ও পুনরুৎপাদনশীল দুই ধরনের কাজ থাকে। বাড়ির সব কাজ করার পর বাইরের কাজগুলোও করতে হয় মেয়েদের। এজন্য নারীকে এমন কিছু কাজ বেঁধে দেয়া হয় যে কাজগুলো সেবামূলক এবং যেগুলো করলে সংসারের অন্যান্য কাজ করতে অসুবিধা হবে না। নারী যত শিক্ষিতই হোক না কেন, অনেক ক্ষেত্রেই নারীসুলভ কাজ থেকে বের হতে পারে না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে আমরা নারী অধিকার কিংবা স্বাধীনতার কথা অনেক বলি। কিন্তু দিনশেষে নারীকেই বাচ্চা, ঘর-সংসার সামলাতে হয়। যদি রাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসত, তাহলে নারীর এই অবস্থা অনেকটা পরিবর্তন হতে পারত। যেমন ডে কেয়ার সেন্টারের সংখ্যা বাড়ানো, স্কুল থেকে বাচ্চাকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা- এই দায়িত্বগুলো রাষ্ট্র নিলে মায়েদের টেনশন অনেক কমে যেত এবং নিজের পেশায় মনোযোগ দিতে পারত।
মাহাত্মা গান্ধী বলেছেন, তিনি নিজেকে একজন ভাল মানবসন্তান হিসেবে তখনই মনে করবেন যখন তিনি মাতৃসুলভ গুণাবলি অর্জন করতে পারবেন।
আমরা ক’জন এভাবে ভেবে দেখি? দক্ষিণ এশিয়ার হাজার হাজার পরিবারে মেয়ে শিশুর জন্মকেই তো অশুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়! এই ধরনের মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে পেশাগত দিক থেকেও নারী স্বাধীন হতে পারবে না। সর্বোপরি নারীকে ‘নারী’ হিসেবে নয়, ‘মানুষ’ হিসেবে দেখতে হবে।
ফিচার ফটো– ফারহানা ফারা
সারাবাংলা/টিসি/ এসএস