শহিদ মিনার বানানোর উদ্যোগ লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৯:৫৫
রাজনীন ফারজানা ।।
পৃথিবীজুড়ে প্রায় ছাব্বিশ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। সারা বিশ্বের সাড়ে ছয় হাজার ভাষার মধ্যে বাংলার অবস্থান ষষ্ঠ। বাংলাদেশ, ভারতসহ সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। কিন্তু এই যে আমরা আজ বাংলায় কথা বলি, বাংলায় চিন্তা করি। বাংলায় লিখি। তার পেছনে আছে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস।
১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন যখন রেসকোর্স ময়দানে বলেন, ‘উর্দু ও কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’; সেখানেই বাঙালিরা ‘না, না’ বলে সমস্বরে গর্জে উঠেছিল। আইনসভা থেকে শুরু করে মাঠে-ময়দানে, প্রতিবাদে-সমাবেশে, লেখনীতে সবখানে লড়াই চালিয়ে যাই আমরা। যে লড়াইয়ের নিষ্পাপ দাবি ছিল, আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলতে চাই!
শেষ পর্যন্ত সালাম-জব্বার-রফিক-বরকতের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ, নতি স্বীকারে বাধ্য হয় পাকিস্তানী স্বৈরশাসক। মাতৃভাষার জন্য এমন আত্মত্যাগ পৃথিবীতে বিরল। এমনই বিরল ঘটনাকে স্মরণ করতেই শহিদ মিনারে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা খালিপায়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই ভাষা শহিদদের প্রতি। শহিদ মিনার শুধু ফুল দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতার জন্য নয়, এই শহিদ মিনারই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভাষার জন্য আত্মত্যাগের গৌরবময় স্মৃতি। এই শহিদ মিনারই আমাদের বাঙালি হিসেবে গর্ব করার উপলক্ষ মনে করিয়ে বারবার।
১৯৫২ সালেরএকুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনার স্মৃতি জাগ্রত রাখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিল। অপরিকল্পিতভাবে রাতারাতি নির্মিত হয়েছিল ১০ ফুট উচ্চতা ও ৬ ফুট চওড়া সেই মিনারটি। মেডিকেল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালি ও পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে আনা সিমেন্ট দিয়ে বানানো হয়েছিল প্রথম শহিদ মিনার। ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাষাশহিদ শফিউরের বাবা উদ্বোধন করেন মিনারটি। এই মিনারটিসহ আরও কয়েকটি মিনার ভেঙে ফেলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার।
অবশেষে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পরে ভাস্কর হামিদুজ্জামানের নকশায় ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক আইন জারির পর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের কাজ বন্ধ হয় যায়। পরবর্তীকালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খানের আমলে পুনরায় এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের আরেকজন শহিদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম নতুন বানানো শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন।
তাই শহীদ মিনার আমাদের জন্য শুধুই একটি স্মৃতির মিনার নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় আবেগ ও গৌরবমাখা ইতিহাস। শহিদ মিনার আমাদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা জাগায়। জাগায় দেশ ও মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্ববোধও।
ভাষার প্রতি এই যে টান, ভাষার প্রতি যত্ন, ভাষাকে লালন করার এই বোধটুকু নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়াটা ভীষণ জরুরি। তাই লাইটার ইয়ুথ ফাউন্ডেশন নামক একটি সংগঠন নিয়েছে দারুণ একটি উদ্যোগ। তারা এমন স্কুলগুলোতে শহিদ মিনার নির্মাণ করে, যেখানে আশেপাশে কোনো শহিদ মিনার নেই। এসব স্কুলের বাচ্চাদের প্রভাতফেরিতে যাওয়ার সুযোগ হয় না। তারা বাঙালি জাতির জীবনের এমন গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নতুন তৈরি শহিদ মিনার দেখে দেখে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারতো শহিদ মিনারের ইতিহাস ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। বাড়বে দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা।
ইতোমধ্যে তারা ভাষা শহিদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বিগত বছরগুলোতে ৩টি শহিদ মিনার বানিয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় এম কে রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেরানীগঞ্জের আব্দুল্লাহপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নীলফামারীর শৌলমারী আলসিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসব শহিদ মিনার নির্মিত হয়। ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম ফয়সাল ইবনে মামুন রাব্বী বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি নবসাজে সজ্জিত শহিদ মিনার দেখে স্কুলের বাচ্চাদের চোখেমুখে যে আনন্দের ঝিলিক দেখেছি, সেই মুহূর্তকে বর্ণনা করা বোধকরি ভীষণ দুঃসাধ্য!’
তিনি আরও বলেন, এ বছর মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে সামনে রেখে লাইটার ইউথ ফাউন্ডেশন দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চল রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নের তারানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি শহিদ মিনার নির্মাণ করবে।
শুধু শহিদ মিনার নির্মাণেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এবার লাইটার ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগ। একুশে ফেব্রুয়ারি স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। থাকবে কবিতা আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক গান ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। পাশাপাশি স্কুলমাঠে স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে গোল হয়ে বসে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে, বাংলা ভাষার ব্যবহারের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলা হবে।
শহিদ মিনার তৈরিসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে প্রয়োজন অন্তত লাখখানেক টাকা। কেউ চাইলে লাইটার ইউথ ফাউন্ডেশনের এই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই উপলক্ষে ফেসবুকে খোলা হয়েছে একটি ইভেন্ট। ইভেন্ট লিংকে গিয়ে বিস্তারিত দেখে নিতে পারেন।
https://www.facebook.com/lighterfoundationbd/
সারাবাংলা/আরএফ/