Saturday 14 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উমারা লড়ে যাচ্ছেন, আমরা দায়িত্ব পালন করছি তো?


২ জুন ২০২০ ২২:৪৯ | আপডেট: ৩ জুন ২০২০ ২০:১৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা মহামারির এই সংকটকালে এক কঠিনতম যুদ্ধে চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব অপারেটর এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা আমাদের ফ্রন্টলাইনের সবচেয়ে অকুতোভয় ফাইটারদের অন্যতম। দিনের পর দিন অন্তহীন কোভিড-১৯ এর সাথে অন্তহীন যুদ্ধ করে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করে তুলছেন তারা, ফিরিয়ে দিচ্ছেন আপনজনদের কাছে। কিন্তু তবুও এই মহামারীকালে প্রায়ই আমরা দেখছি ডাক্তারদের এলাকাছাড়া করবার হুমকি দেয়া হচ্ছে, স্বাস্থ্যকর্মী-নার্সদের কাছ থেকে ভাইরাস ছড়াবার অজুহাত তুলে তাদের একঘরে করে রাখা হচ্ছে, কোয়ারান্টারিনে রাখবার নাম করে বাঁশের চাটাইয়ের ছাপড়ায় থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে, এমনকি চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের বাসা ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিচ্ছেন বাড়িওয়ালারা। যেখানে তাদের পাশে দাঁড়াবার কথা ছিল আমাদের, সেখানে হাতে গোনা কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া নির্দয় আচরণ করছি আমরা।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু তারপরেও করোনা সংকট মোকাবেলায় সেবা প্রদান এক মুহুর্তের জন্য বন্ধ হয়নি তাদের। শত সীমাবদ্ধতা এবং সমস্যা সত্ত্বেও দায়িত্বপালনে একবিন্দু ছাড় দিচ্ছেন না আমাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া ফাইটারেরা। ইতালি- আমেরিকার মত আমাদের দেশেও করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ডাক্তার এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন, কিন্তু তারপরেও তারা অন্যান্য ফ্রন্টলাইন ফাইটারদের মত একবিন্দু পিছু হটেননি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এক নার্সের তাৎক্ষনিক কর্তব্যপরায়ণতার অসাধারণ এক দৃষ্টান্ত তো রীতিমত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে স্ত্রী ও প্রসূতি বিভাগে কর্মরত এই নার্সের নাম উমা অধিকারী। নিজের একটা দুধের শিশু আছে তার। প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে তাকে ব্রেস্টফিড করাতে হয় উমার। তো সেদিন রাতে নাইট ডিউটির সময় প্রসুতি বিভাগে এক মায়ের C- Section করা হয়। একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেও ল্যাকটেশন না হওয়ার কারণে বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে পারছিলেন না। সদ্যোজাত বাচ্চাটার তারস্বরে চিৎকারে অসহায় বোধ করছিলেন চারপাশের সবাই। কারণ স্বাভাবিক সময়ে কোন সদ্য প্রসূতী মায়ের বুকে দুধ না এলে অন্য মায়েরা এগিয়ে আসেন বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানোর জন্য। কিন্তু এক্ষেত্রে মরনব্যাধি করোনা ভাইরাস থামিয়ে দিয়েছিল সব। যেখানে এই সময়ে কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলোতে এই পর্যন্ত ৩০ জন অন্তঃসত্ত্বার Covid-19 পজিটিভ এসেছে এবং ওই হাসপাতালেই সে মুহুর্তে বেশ কয়েকজন কোভিড-১৯ পজিটিভ মা থাকায় কেউই বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াবার জন্য এগোচ্ছিলেন না।

ঠিক তখনই এগিয়ে আসেন সদ্য মা হওয়া ওই অপারেশনেরই নার্স উমা অধিকারী। সেবিকার রুপ বদলে উমার তখন মাতৃরুপ। দু’বার স্তন্যপান করিয়ে শিশুর কান্না থামান তিনি। উমা পরে জানিয়েছেন, “অনেক ক্ষেত্রে নিঃসরণ স্বাভাবিক করার জন্য সেই মা’কে মোটিভেট করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে বাচ্চা এত কাঁদছিল যে কান্না থামাতে ওকে স্তন্যপান করালাম। পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পর শিশুটির মা স্তন্যদানে সক্ষম হয়েছিলেন।”

ঠিক সেই সময়ই বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। ফোন করেছিলেন উমার স্বামী। কিন্তু রোগীর সন্তানকে স্তন্যপানে ব্যস্ত থাকায় ফোনটাই ধরতে পারেননি। উমা বলেন, “রাত তখন প্রায় সাড়ে ১১টা। সাড়ে আট মাসের ছেলে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভিডিও কলে একবার আমার মুখটা দেখে। তাই স্বামী ভিডিও কল করছিল। কিন্তু ফোনটা কেটে দিই। স্বামীকে জানাই স্তন্যপান করাতে ব্যস্ত। কথাটা শুনে স্বামী একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে আমি আশ্বস্ত করেছি যে আমি পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছি। আসলে আমাকেও তো বাড়ি গিয়ে নিজের সন্তানকে স্তন্যপান করাতে হয়।”

এই চমকপ্রদ ব্যাতিক্রমী ঘটনাটি ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে সবজায়গায়। যদিও হাসপাতালে এ ধরণের ঘটনা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়, অনেকক্ষেত্রেই নার্স এবং সংশ্লিষ্ট ডাক্তারেরা রোগীর জন্য প্রাথমিক সকল সহায়তার ব্যবস্থা করেন, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তুলনামূলক অস্বচ্ছল রোগীদের ক্ষেত্রে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে ওষুধ-পথ্য কিনে দেন এবং নানা সহায়তা দেন। সদ্যপ্রসূত বাচ্চাকে নার্সের ব্রেস্টফিডিং করানোও তেমনই খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাহলে এই ঘটনাটা এভাবে সামনে আসবার কারণ কি?

কারণটা হচ্ছে এই নার্সকেই পাড়ার লোকেরা হেনস্থা করেছিল। স্বাস্থ্যকর্মী উমা অধিকারী পাড়ায় করোনার সংক্রমন ছড়াতে পারে এই আশঙ্কায় পাড়ার লোকেরা ওকে এবং ওর পরিবারকে চরম হেনস্থা করে। পরে নিজের কোলের বাচ্চাকে নিয়ে তিনি থানায় অভিযোগ জানানোর পর তাঁর পরিবারের রেহাই মেলে পাড়া প্রতিবেশীর হাত থেকে। অথচ এই উমা অধিকারীই আমাদের মনে করায় যিনি মা হতে জানেন, তিনি সব শিশুকেই নিজের সন্তান বলে মনে করেন।

এই করোনাকালে উমা অধিকারীর কাছে সদ্যপ্রসূত বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো খুব স্বাভাবিক ঘটনা হলেও আমাদের কাছে তা অস্বাভাবিক। একমতার বাচ্চার মা-ই জানেন এটা সে মুহুর্তে কতখানি জরুরি এক কর্তব্যপরায়ণতা ছিল! রোগীদের মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনা, নিরাপদে রাখা ডাক্তার-নার্সরা সবসময়ই এটাকে তাদের স্বাভাবিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে দেখলেও আমরা অনেকেই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা তো দূরে থাক, প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দিতেও কার্পণ্য বোধ করি। এই মহামারির সময়েও আমরা ঘাতক করোনার মুখোমুখি হয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের নিরাপদে রাখবার জন্য যুদ্ধ করে যাওয়া ডাক্তারদের এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে চরম নির্দয় আচরণ করছি। যেহেতু তারা করোনা চিকিৎসা দেন, সুতরাং তাদের কাছ থেকে করোনা ছড়াতে পারে এই বিচিত্র অজুহাতে তাদের এলাকাছাড়া করবার হুমকি দিচ্ছি, একঘরে করে রাখছি, দুর্ব্যবহার করছি, বাড়ি থেকে বের করে দেবার চেষ্টা করছি।

অথচ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায়, শ্রদ্ধা ও সম্মানে মাথা নত হবার কথা ছিল আমাদের। ফ্রন্টলাইনে ফাইট করে যাওয়া ডাক্তার-নার্স-টেকনিশিয়ান-স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ-আনসার-র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারি, সাংবাদিক, অনলাইন গ্রোসারি শপ, আইএসপি, টেলিফোন সংস্থা, ব্যাংকার, সকল প্রকার জরুরি সেবাদানের সাথে জড়িত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নির্বিশেষে প্রত্যেকটা মানুষের স্যালুট জানাবার কথা ছিল। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে এই কাজটা সরকারিভাবে এবং সাধারণ জনগণের পক্ষ থেকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে হচ্ছে প্রতিনিয়তই, কিন্তু আমাদের দেশে এখনো দুঃখজনকভাবে এই ট্রেন্ডটা গড়ে ওঠেনি, বরং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বদলে উল্টো আচরণটাই হচ্ছে বেশি।

তবুও কিছু মানুষ যথাসাধ্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন প্রতিদিন। আপনি, আমি, আমরা যখন বাসায় বসে ‘কি করবো’ তা খুঁজে পাচ্ছিনা, তখন আমাদের ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক, অনলাইন গ্রোসারি শপ, আইএসপি, টেলিফোন সংস্থা, ব্যাংকার, আইন শৃংখলা বাহিনী এবং জরুরী ও সাধারন সেবাদানকারী প্রতিটি মানুষ ‘কোনটা আগে করবো’ অবস্থায় আছেন।

আসুন করোনার এই দিনগুলোতে সবাই মিলে প্রতিদিন রাত ৯ টায় (বংলাদেশ সময়) যার যার বারান্দা/ছাদ এ দাঁড়িয়ে করতালি দেই এই এখনকার সুপার হিরোদের। এটি শুরু করেছেন পুষ্টিবিদ সুস্মিতা খান। প্রতিদিন নিয়ম করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে করতালি দেওয়ার কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি। হয়তো আর কেউ করবে না আপনার এলাকাতে। হয়তো আপনি একাই থাকবেন ছাদে/বারান্দায়। তাও করুন। শুরুটা নাহয় আপনাকে দিয়েই হোক। শুরুটা ২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, রাত ৯ টায় হয়েছে। আগামী কাল নাহয় আবার হোক।

আসুন কৃতজ্ঞ হই, শ্রদ্ধায় নত হই এই দুঃসময়ে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে সর্বস্ব দিয়ে লড়ে যাওয়া বীরদের প্রতি! তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন আমাদের ভালো রাখবার, আমাদের দায়িত্ব তাদের উৎসাহিত করবার, প্রেরণা যোগাবার, কৃতজ্ঞ হবার। এটুকু করতে পারব না আমরা?

ইভেন্টের লিংক- https://www.facebook.com/events/3655368997870131/

উমা অধিকারী করোনা মহামারি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর