নারীবাদ প্রয়োজন নাকি বিলাসিতা: সমানভাবে বাঁচুক নারী ও পুরুষ
৭ আগস্ট ২০২০ ১৭:০৬
আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছি নারীবাদ কেন প্রয়োজন তাই নিয়ে। আজ এই লেখার শেষ পর্ব। আমি যেভাবে নারীবাদ বুঝেছি তাই আমি আমার মত করে লিখেছি। আজ শেষ পর্বে আমি ইতি টানবো এই বলে যে, আমি নারীবাদী। আমি নারীবাদের পক্ষে কথা বলেই যাবো যতদিন না পৃথিবী থেকে নারী ও পুরুষের বৈষম্য দূর হবে।
একটা সাধারণ প্রশ্ন অনেকেই করেন আর তা হল, ‘সবই মানলাম। কিন্তু উগ্র নারীবাদীদের নিয়ে কী বলবেন?’ তাদের জন্য আমি বলবো, কে উগ্র আর কে উগ্র নয় তার মাপকাঠি আসলে কি? কিসের মাপকাঠিতে আপনারা মানুষকে বিচার করেন আসলে। যদি বলেন ভোকাল অর্থাৎ প্রতিবাদী নারীবাদি, উচ্চকন্ঠ নারীবাদী মানে উগ্র তবে আমি বলবো এটি একটি আন্দোলন।একটা জাতি বছরের পর বছর ধরে নিষ্পেষিত আর নির্যাতিত হলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ জমা হবেই। এটি খুব স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যাপার। তাছাড়া আমি বারবার বলেছি এবং আবারও বলছি, নারীবাদকে বারবার বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে ব্যবহার করেছে (নারী-পুরুষ উভয়েই) ,তাদের ভুল প্রিচিংয়ের জন্য আপনি একটি যৌক্তিক আন্দোলনকে নাকচ করে দিতে পারেননা।
আমি নারীবাদ নিয়ে কথা বলবো। বলেই যাবো, বলেই যাবো। যতক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ নারীর মনে হবে তারা আর লিঙ্গবৈষম্যের শিকার না, আমি বলে যাবো নারীবাদ নিয়ে কথা। আমি বলে যাবো লিঙ্গ বৈষম্যের কথা। কারণ, ‘We don’t stop talking about gender equality until gender inequality ceases to be an issue.’
যতদিন পর্যন্ত আপনারা আমাকে দেখাতে পারছেন আমার ৯৯ শতাংশ নারী নিজেদেরকে সেলফ সাফিশিয়েন্ট না ভাবছে, নিজেকে মানুষ বলে ভাবতে পারছে, তাদেরকে ধর্ষণ করা হচ্ছেনা, হ্যারাস করা হচ্ছেনা, তাদের নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে তাদের যাচাই করা হচ্ছে না, আমার পক্ষে আপনাদের ‘মানববাদ’-এ বিশ্বাস করা, ‘নারী দিবস বাদ দিয়ে মানব দিবস চাওয়া’ সম্ভব না। এত মহান আমি নই।
আপনি যদি পুরুষ হন, আপনি জানবেন আপনার জীবনের সাথে জড়িত প্রায় প্রতিটি নারীরই তার জীবনে অন্তত একবার হলেও মনে হয়েছে সে পুরুষ হলে খুব ভালো হত। এটি কতটা কষ্টের, কতটা অপমানের তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আমি খুব জেন্ডার নিউট্রাল পরিবেশে বড় হয়েছি, আমার বাবা-মা আমাকে কোনোদিন বলেননি ‘তুমি মেয়ে বলে তুমি এটা পারবেনা বা এটা তোমার জন্যে নিষেধ’- কিন্তু তাও আমার প্রায় চব্বিশ বছরের জীবনে আমার বহুবার মনে হয়েছে আমি পুরুষ হলে হয়তো অনেককিছু অনেক সহজ হত। কী অসহায় একটা মূহুর্ত একটা মানুষের জন্যে সেটা, ভাবতে পারেন? আমি নারীবাদী, তাই আমি চাইনা পুরুষও নারীর মতো অত্যাচারিত হোক, আমি বরং চাই নারী পুরুষ কেউই এই কষ্টগুলো না পাক।
আমি প্রতিবার হ্যারাজড (নিগৃহীত) অনুভব করার পর, ক্যাটকলড (রাস্তাঘাটে শিষ বাজান শোনা) হওয়ার পর আমার বাবাকে বলেছি, আমার ভাইদের বলেছি, আমার বন্ধুদের বলেছি। কিছুটা নিষ্ঠুরতা থেকেই, যাতে তারা বোঝে একটা মেয়ের কেমন লাগে যখন তাকে এসব টিজিং সহ্য করতে হয়। এবং আমি নিজে এটা চিন্তা করতে খুব অস্বস্তি বোধ করি যে আমি এমন একটা সমাজে যদি বাস করতাম যেখানে একজন পুরুষ যদি নারীদের দ্বারা অ্যাবিউজড হতেন, কেমন হত? বিশ্বাস করুন, আমি আগাগোড়া একজন নারীবাদী বলে নিজেকে মানি। কিন্তু এই চিন্তাটাও আমাকে খুব অস্বস্তি বোধ করায়।
নারীবাদ প্রয়োজন নাকি বিলাসিতা: নারীবাদ এখনও কেন প্রাসঙ্গিক
আমি নারীবাদী, তার মানে এটা না যে আমি চাই নারীদের মতো পুরুষও নির্যাতিত হোক। আমি চাই নারী-পুরুষ কেউই নিজেকে নির্যাতিতবোধ না করুক। তাদের কারোরই নিজেকে অনিরাপদ না লাগুক। আমি নারীবাদী, তার মানে এটা না যে আমি চাই নারীকে তাদের যোগ্যতার বিচারে বিচার না করে তাদের লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় কনসিডার করে সবকিছু খুব সহজে দিয়ে দেয়া হোক। আমি শুধু চাই আমি নারী বলে যেন আমাকে আমার সেক্সের বেসিসে আমাকে বিচার না করা হয়, আমার সেক্সের চেয়ে গুরুত্ব যেন আমার কাজ ও আমার যোগ্যতা পাক। আমি নারীবাদি, তাই আমাকে একজন মেয়ে কিংবা একজন ছেলের ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা একই পরিমাণে রাগিয়ে দেয়। আমি নারীবাদি, তাই আমি চাই আমাদের মেয়ে শিশুরা যেমন নিরাপত্তা পাবে, ঠিক ততটুকু পাবে আমাদের ছেলে শিশুরা।
আমি চাইনা আমার পৃথিবীতে একজন মানুষও নির্যাতিত হোক, একটা মানুষও নিজেকে এই পৃথিবীতে অনিরাপদ বোধ না করুক। আমি নারীবাদী, আমি তাই চাই আমার ছেলে বন্ধু ও মেয়ে বন্ধু দুজনেই সমান সুযোগ পাক। নারীবাদ আমাকে শিখিয়েছে নারী ও পুরুষকে সমান স্কেলে মাপতে, নারীবাদ আমাকে পুরুষ জাতিকে ঘৃণা করতে শেখায়নি। নারীবাদ আমাকে শিখিয়েছে নারী পুরুষের মধ্যে কেউই অসম্মানের যোগ্য না, নারীবাদ আমাকে পুরুষকে নিচু জাত বা নারীকে সুপেরিয়র ভাবতে শেখায়নি। আমি যদি পুরুষকে ঘৃণা করি, আমি যদি চাই পুরুষজাতি নিপাত যাক, নারীরা পৃথিবীর সব দখল করে নিক পুরুষদের ধ্বংস করে, তাহলে তা আমার ব্যক্তিগত সমস্যা, এটা প্রমাণ করবে মানুষ হিসেবে আমি একজন খারাপ মানুষ। একটি চমৎকার মতবাদকে আমি যদি নিজের খেয়াল-খুশিমতো নিজের সুবিধার জন্যে ব্যবহার করি, এর জন্যে তো আমি ছাড়া আর কেউ দায়ি নয়। এজন্যে আমাদের সমাজের একটা বড় অংশের কাছে নারীবাদ কেবল হাসিঠাট্টা, মজা করার ব্যাপার আর বিলাসিতা মনে হলেও, নারীবাদ মূলত একটি প্রয়োজন। (সমাপ্ত)
লেখক- তরুণ উদ্যোক্তা (ডিজাইনার ও ফাউন্ডার, ময়নার গয়না)
আমার নারীবাদ নারীবাদ নারীবাদ প্রয়োজন নাকি বিলাসিতা নারীবাদের প্রয়োজনীয়তা