পুরুষের কাঁদতে মানা, কে বলেছে ভাই!
১৯ আগস্ট ২০২০ ২০:১৭
‘ফ্যাচ ফ্যাচ কইরা কান্তাছস ক্যা, তুই কি মাইয়া নাকি?’
‘হালায় মাইয়াগো মত অভিমান করে’
‘তুই তো পুরাই সেন্টিখোর দেখি!’
‘পুরুষ মানুষের কেন মন খারাপ হবে?’
‘পুরুষমানুষ হইয়া ভয়/লজ্জা পাস ক্যামনে? এর চেয়ে মাইয়াগো মত দুই হাতে চুড়ি পইরা ঘরে গিয়া বইসা থাক’
‘অ্যাই, তুমি না ব্যাডা? এইগুলা কী বল? আর কাউরে কইওনা, মাইনসে হাসব!’
পুরুষ হয়ে এটা করা যাবে না, ওটা বলা যাবে না, আবেগী হওয়া যাবে না, কাঁদা যাবে না ইত্যাদি অসংখ্য কথা বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, ভাই-বোনসহ প্রিয়জন বা পরিচিতের কাছ থেকে শুনে শুনে বড় হই আমরা। এভাবে আমরা দুঃখ-কষ্ট, রাগ-হতাশা, অভিমান-হাহাকারের মত অতি সাধারণ মানবীয় প্রতিক্রিয়া আড়াল করতে শিখি। ছেলে হয়ে জন্ম নিয়ে স্বাভাবিক মানবিক আবেগ কাউকে টের পেতে দেই না, নিজেকে রাফ এন্ড টাফ, স্ট্রং আর সবসময় হাসিখুশি কিংবা সবসময় গম্ভীর হিসেবে দেখাতে শিখি।
আর আমাদের মনজগতে এসব ভাবনার বীজ বুনে দেয় আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। ছেলেবেলা থেকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার কাছ থেকে এগুলো শুনতে শুনতে নিজেদের জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ছেলেদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সাথে সাথে মস্তিষ্কের নিউরনে প্যারাসাইটের মত এই নোংরা জাজমেন্টাল রেসিস্ট লাইনগুলো গেঁথে যায়। অজান্তেই সে মানুষের আবেগ-অনুভূতি, দুর্বলতা আর ভালনারেবিলিটিকে টিটকারী দেওয়া একজন হয়ে গড়ে ওঠে।
বাইরের জগতে নিজেকে দৃঢ়চেতা দেখাবার জন্যে ভেতরে ভেতরে একজন পুরুষকে কতবার ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে যেতে হয়, সে হিসেব কখনও জানার চেষ্টা করা হয়না। পুরুষের মনসামাজিক পরিস্থিতি কেউ বিচার করে দেখতে চায় না। পুরুষের ভালনারিবিলিটির স্বীকৃতি না দেয় সমাজ, না দেয় রাষ্ট্র। যেন ভেঙে পড়া পুরুষ অক্ষমতার প্রতীক। পুরুষকে হতে হবে এমন এক অক্ষয় অবিচল নির্ভরতার প্রতীক, যে ঈশ্বরের মতই সর্বদা অবিচল, চির ভরসার জায়গা। তার ভেঙে পড়ার সময় কই?
এর ফলাফল একজনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে খুব একটা ভালো হয় না। কারণ, সে নিজেও নিজের অজান্তেই তার বন্ধু, ভাই কিংবা পরিচিত ছেলেদের এসব শেখাচ্ছে, সহজাত আবেগের বহিঃপ্রকাশ নিয়ে টিটকারি দিচ্ছে, হাসিতামাশা করছে এবং এভাবেই সমাজের বাকি পুরুষদেরও মনোজগতের, মানসিক স্বাস্থ্যের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে তাদের অজান্তেই জাজমেন্টাল হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু এভাবে কি ছাঁচে ঢেলে মানুষ গড়া যায়? না, এভাবে সহজাত ব্যক্তিত্ব ও চাহিদাকে চাপ দিয়ে সুস্থ কোন মানুষ হিসেবে কেউ বেড়ে উঠতে পারে না।
পুরুষের যখন কষ্ট হয়, খারাপ লাগে, প্রবল হাহাকারে সবকিছু শুন্য মনে হয়, হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, তখন তাকে তা চাপা দিতে হয়। একজন ‘পুরুষমানুষ’ হয়ে সে কাঁদছে, অভিমান করছে, অভিযোগ করছে- বিষয়গুলো কেউ যেন মেনেই নিতে পারে না। ভুল করে যদি কখনও বন্ধুবান্ধবদের কাছে বলেও ফেলে, হাসির পাত্র হতে হয় তাকে, শুনতে হয় ‘শালা দেখি একটা সেন্টিখোর!’ তাই ভেতরটা চুরমার হয়ে গেলেও ‘সেন্টিমেন্ট’ প্রকাশ করা হয় না, ‘টাফ এন রাফ’ ভাব নিয়ে চলতে হয় কিংবা ভান ধরতে হয়। এভাবে পুরুষই সর্বশ্রেষ্ঠ, সমাজের অধিপতি- এই প্রথা অজান্তেই পুরুষকে আটকে ফেলে এক ভয়ংকর জালে।
চারপাশের মানুষ কি বলবে ভেবে পুরুষ নিজেকে লুকিয়ে রাখে। কষ্ট আর হাহাকার কারো সাথে শেয়ার করতে না পারার এই প্রবল মানসিক যন্ত্রণা অথবা বুকের ভেতর জমতে থাকা কান্নাগুলোয় তাকে ক্রমাগত গ্রাস করে নিতে থাকে ডিপ্রেশন নামের এক ভয়াবহ হা মেলে থাকা দানব। উপসর্গ পরিণত হয় রোগে, রোগ পরিণত হয় ব্যাধিতে। মানসিক ব্যাধি। সত্যি বলতে অভিমান, কষ্ট, যন্ত্রণা কান্নার মত খুব স্বাভাবিক মানবীয় বৈশিষ্ট্যকে পুরুষ মানুষের দুর্বলতা ভেবে লুকাতে গিয়ে আসলে একজন পুরুষ নিজেকেই লুকাতে চায় নিজের কাছ থেকে।
ভেতরের নানাবিধ মানসিক দ্বন্দ্ব এক সময় অসহায়ত্বের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যায়। ভেতরের এতসব অমীমাংসিত হতাশা কারো সাথে শেয়ার করতে না পেরে মানুষটা ক্রমাগত জীবনের ক্যানভাসে ধূসর হতে শুরু করে। না বেঁচে থাকা যায়, না মরে যাওয়া যায়। এই মানসিক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে ভুগতে কেউ জীবনের একটা খারাপ সময় পার করতে না পেরে কেউ কেউ বেছে নেয় আত্মহত্যার মত পথ। আর একজন পুরুষের যেন আত্মহত্যা করাও অপরাধ। তখন পরিচিত-অপরিচিত সকলে মিলে তার মৃত্যুর বিচার করতে বসে। কেন সে পুরুষ হয়েও হীরার মত শক্ত মানসিকতার হলো না, কেন সে ‘রাফ এন্ড টাফ মাচোম্যান’ হলো না, কেন অল্পতেই হাল ছেড়ে পালিয়ে গেলো, পারলে মৃত মানুষটাকে নিয়ে গ্রামাই সালিশী বসাই আমরা। কতটা অসহায় হয়ে মানুষটা হাল ছেড়ে পালিয়ে গেল, সেটা বোঝার চেষ্টা করি না। কেউ কেউ আফসোস করে, ‘কই আগে তো বুঝিনি, আগে যদি জানতাম!’ কিন্তু বেঁচে থাকতে আমরা কখনোই তার মানসিক পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করি না।
অথচ একজন পুরুষও যখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে তখন একটু মানসিক আশ্রয়, মনের কথা বলার স্পেস, মনোযোগী একজন শ্রোতা খোঁজে। কিন্তু যেহেতু পুরুষের কোন মানসিক দুর্বলতা থাকতে পারেনা, তাই প্রচন্ড মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থাতেও তা কাছের মানুষদের সাথে শেয়ার করার সাহস পায় না। যদি কেউ হাসে, টিটকারি দেয়, ট্রল করে!
বাইরে থেকে দেখা আকর্ষণীয় পুরুষটি হয়ত ক্যারিয়ার, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ঈর্ষণীয় রকমের সফল, কিন্তু দেখা যায় রাফ এন্ড টাফ মাচোম্যান সেই হাসিখুশি মানুষটাই হয়ত ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড একা, অসহায়, হতাশ এবং নিজের কাছে ক্রমেই ধূসর আর অচেনা হতে থাকা একজন। এধরনের মানসিক বিপর্যস্ততার পর্যায়ে অনেকেই বেছে আত্মহত্যার মত পথ। বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে। নিজের জীবন এভাবে শেষ করে দেওয়া এই মানুষগুলোর বেশিরভাগই পুরুষ। যুক্তরাজ্যে ৪৫ বছরের কম বয়সী পুরুষরা সবচাইতে বেশি যে কারণে মৃত্যুবরণ করেন, তা হচ্ছে আত্মহত্যা। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই পুরুষদের আত্মহত্যার এ হার রীতিমত উদ্বেগজনক।
পুরুষের ঘাড়ে চাপানো কর্তব্যের বোঝা বনাম পুরুষের স্বপ্ন!
সেজন্যই গত বছর বিশ্ব পুরুষ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘পুরুষ ও কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা।’ যদিও এ নিয়ে তেমন আলোচনা কোথাও দেখা যায় না। অথচ পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা হওয়া খুব জরুরি। দরকার যুগের পর যুগ ধরে পুরুষকে মানসিকভাবে পঙ্গু করে ফেলা নানা বিচিত্র প্রথা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে পুরুষের আধিপত্য দেখাতে গিয়ে, পুরুষকে রীতিমত অভিমান-শোক-দুঃখ-কষ্ট-কান্নাপ্রুফ বিচিত্র এক এলিয়েন হিসেবে বেড়ে উঠতে বাধ্য করে আসলে যে অসংখ্য মানসিকভাবে পঙ্গু ভেঙ্গে যাওয়া মানুষ তৈরি হচ্ছে, কথা হোক সেই বর্বর প্রথা নিয়ে। কথা হোক, পুরুষের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা নিয়ে।
একজন পুরুষের গোলাপি রঙ পছন্দ হতেই পারে, তারও কাছের মানুষের সাথে ড্রামা করতে ইচ্ছে হতে পারে, একটু মনোযোগ পেতে আকুল হতে পারে সে, ন্যাগিং করতে পারে বিশেষ কিছুর জন্য, ফুল পছন্দ হতে পারে, চাইতেই পারে সে যে তার ভালোবাসার নারীটি তাকে গোলাপ উপহার দিক- এসব চিন্তাভাবনাকে ট্রল করা বন্ধ হোক। আমাদের বুঝতে হবে এতে কোন ভুল নেই, এতে জাত যায় না, এগুলো হাস্যকর কিছু না। বন্ধ হোক ‘মেয়েলি’ নামক চরম সেক্সিস্ট এক মন্তব্য করা। বিশেষ বিশেষ কাজ ও চাহিদা নারীত্বের পরিচায়ক বলে চলে চাপিয়ে দেওয়ার এই সামাজিক কুপ্রথা বন্ধ হোক।
সময় এসেছে ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’ কথাটিতে লাল রঙের ক্রস চিহ্ন দেওয়ার। আমাদের শিশুদের শেখানো হোক, কান্না খুবই স্বাভাবিক একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য। যেমনি স্বাভাবিক রাগ-দুঃখ-অভিমানের মত আবেগ প্রকাশ।
অভিভাবকের দায়িত্ব সন্তানকে এসব ক্ষতিকর ধারণা থেকে দূরে রেখে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। আর নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সকলের দায়িত্ব পরিচিত প্রিয়জন- সে বাবা, ভাই, স্বামী কিংবা বন্ধু হোক, তাকে সবধরনের সহযোগিতা-সহমর্মিতা দিয়ে একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা। আমাদের আন্তরিকতাই পারে ডিপ্রেশন আর হতাশায় মানসিকভাবে এলোমেলো পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষটাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে!
মানুষ অনেকটা চাপ দিয়ে রাখা গাছের মত। ইটের নিচে চাপা পড়া ঘাস যেমন সূর্যের আলোর অভাবে ক্লোরোফিল তৈরিতে ব্যর্থ হয়ে সাদা হয়ে যায়, তেমনি মানুষকেও সহজাতভাবে বেড়ে উঠতে না দিলে সে স্বাভাবিক হয়ে বেড়ে উঠতে পারে না। তাই ছেলে হোক কি মেয়ে, তাকে সমাজের চাহিদা অনুযায়ী নারী ও পুরুষ অনুযায়ী না গড়ে তাকে ন্যায়বান একজন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করতে হবে। কিছুতেই যেন তার সহজ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সত্ত্বাকে চাপা না দেওয়া হয়।
তথ্যসুত্র
১. https://www.bbc.com/future/article/20190313-why-more-men-kill-themselves-than-women
২. https://www.thecalmzone.net/about-calm/what-is-calm/
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাহিদা পুরুষের অভিমান পুরুষের কান্না রা'আদ রহমান