আমার ত্রিভুবন আর ত্রিভুবনের আমি
১৬ মার্চ ২০১৮ ১৬:৫২
আজ পাঁচ দিন। বিএস ২১১ এর দুর্ঘটনার পরে এ আমার একান্ত কথা, কারুকে দুষি না, কোন বিশ্লেষণ না, দুর্ঘটনার আফটার ইফেক্ট হিসেবে সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ অনুভব।
জীবনে প্রথমবারের মতন নেপাল গিয়েছিলাম খুব সম্ভবত উনিশশো ছিয়ানব্বই সালে। রাজা বীরেন্দ্রবিক্রম শাহদেব তখন নেপালের রাজা। রানি ঐশ্বর্যলক্ষীদেব আমার চোখে (অনেকের চোখেই) দারুণ সুন্দরী। মনে পড়ে দরবারমার্গে গিয়ে রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, কি জানি যদি রাজা রানীর দেখা পাই। তারপরে দ্বিতীয়বার গেলাম মাওবাদী গৃহযুদ্ধকালীন সময়ে, বোধহয় সাল দুই হাজার হবে সেটা। বার কয়েক গেলাম সেই বছর, অফিসের কাজে। ত্রিপুরেশ্বরে ব্লুবার্ড নামে এক হোটেলে থাকতাম তখন, এখন আর হোটেলটা নাই। সেই সব দিনে সন্ধ্যার মধ্যেই হোটেলে ফিরতে হত। কাঠমান্ডু শহরের কাছেপিঠের এলাকাগুলি ছাড়া দূরের পাহাড়ি এলাকায় যাওয়া নিষেধ ছিল।
মাঝে বেশ ক’বছর বিরতির পরে আবার নুতন করে নেপাল যাত্রা শুরু হলো অনিয়মিত ভাবে দুই হাজার আট সালে। এরমধ্যে দুই হাজার এক সালে রাজা বীরেন্দ্র শাহদেব সপরিবারে নিহত হয়েছেন। সেই রাজপ্রাসাদটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে মিউজিয়াম বানানো হয়েছে। তারপরে দুই হাজার নয় থেকে দুই হাজার ষোল সাল পর্যন্ত বছরে ছয় থেকে দশবার যাতায়াত, ঠাট্টা করে বন্ধু বান্ধব জানতে চাইতো, আমি কি যাচ্ছি না এলাম!
একপর্যায়ে নেপালে সাময়িক বসবাস শুরু। ঝামসীখেল বলে জায়গাটায় আমার অফিস আর গেস্টহাউজ।
কাঠমান্ডু আমার দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠল ক্রমশ। প্রতিবার ঢাকা থেকে ফেরত আসার সময় আমি নিজ থেকেই খুঁজতাম নেপালী ছাত্রছাত্রী যাদের প্রায়ই লাগেজের ওজন বেশী হয়ে যেত আর করুনমুখে অনুনয় করত কাউন্টারের লোকদের কাছে। তখন তাদের কাছে থাকা অতিরিক্ত ওজন নিজের একাউন্টে নিয়ে নিতাম, বেড়াতে যাওয়া বাংলাদেশিদের যেচে যেচে বেড়ানোর জায়গার, কেনাকাটার টিপস দিতাম, নিজের বাড়িতে চা খাওয়ার নেমতন্ন করতাম। আমার এক্সটেন্ডেন্ড ফ্যামিলি হল আমার সহকর্মীরা, আমার বন্ধু ক’জন, তাদের মধ্যে একজন আমার সহপাঠী।
শুধু ঢাকা-কাঠমান্ডু নয়, কাঠমান্ডু থেকেই দিল্লী, কলকাতা, ইউরোপের কিছু দেশে যাতায়াত করেছি। এই ত্রিভুবন বিমানবন্দর দিয়েই সেইসব যাতায়াত। দুই হাজার পোনেরো সালে টার্কিশ এয়ারলাইন্সের যে বিমানটি মুখ থুবড়ে রানওয়ের বাইরে পড়ে গিয়েছিল, সেইটার ফিরতি ফ্লাইটেই আমার কোপেনহেগেন যাওয়ার কথা ছিল, গেলামও তো প্রায় বারো ঘণ্টা ডিলেইড হবার পরেও। কতবার খারাপ আবহাওয়ার কারণে দিল্লী থেকে, কি কাতার থেকে, একবার কুয়ালালামপুর থেকে, একবার ব্যংকক থেকে ফেরার পথে ফ্লাইট নামতে না পেরে কলকাতা বা বারানসি বিমানবন্দরে গিয়ে অপেক্ষা করেছে, বর্ষাকালে আর শীতের শেষে এটা প্রায়ই ঘটত।
আমার নেপাল অভিজ্ঞতায় কমপক্ষে পাঁচ বারের বেশি ঢাকার ফ্লাইট ঢাকায় ফেরত এসেছে নামতে না পেরে। একবারতো ঢাকায়ও নামতে পারলো না ঝড় বৃষ্টির কারনে, গেলাম চিটাগং। বাংলাদেশ বিমান, জিএমজি, নভো, ইউনাইটেড, ইউএসবাংলা সবার ফ্লাইটেই উড়েছি কাঠমান্ডুর পথে। অবশ্য বাংলাদেশ বিমান ছাড়া একমাত্র ইউএসবাংলাই মনে হয় বেশিদিন টিকে আছে। শেষের দিকে অবশ্য ঢাকা কাঠমান্ডু যাতায়াতের জন্য অফিস থেকে বাংলাদেশ বিমান ছাড়া আর কোন এয়ারলাইন্সে যাওয়ার অনুমতি দিতনা।
তবু মনে পড়ে এই বিএস২১১ তেও তো গেছি কতবার। অন্য দেশে যাতায়াত করার সময় এম্বারকেশন কার্ডে ফ্লাইট নম্বর লিখবার জায়গায় মনের ভুলে বিজি৭০১ বা বিএস২১১ লিখে ফেলেছি। শুধু তো ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট নয়, কত ডোমেস্টিক ফ্লাইট, অফিসের কাজে গেছি কত জায়গায়, নেপালগঞ্জ, বিরাটনগর, ভইরয়া, জনকপুর, ধানগাড়ি, পোখরা সবই তো এই ত্রিভুবন দিয়েই। আর মাউন্টেন ফ্লাইট, সেওতো এই ত্রিভুবন দিয়েই। সব মিলিয়ে প্রায় ষাট বা সত্তর বারের পরও প্রতিবার ত্রিভুবনে ওঠা নামার আগে ক্যামেরা হাতে রেডি থাকতাম। কাঠমান্ডু ভ্যালির উপর দিয়ে যখন চক্কর দিত যান্ত্রিক পাখিটি, আমি দেখতাম নীচে ঐ যে দেখা যায় বৌদ্ধানাথ স্তুপা, ছুটির দিনে আমার অবসর কাটানোর প্রিয় জায়গা, উপর থেকে দেখতে কি যে অপরূপ লাগে!
অথবা প্রায় নালার মতন মরা নদীটার উপরে বাগমতি ব্রীজ। বর্ষাকালে ত্রিভুবন বিমানবন্দর এপ্রোচ করবার ঠিক আগে সবুজে মোড়া পাহাড়গুলোতে আলো ছায়ার খেলা, বালুর চর পড়া নদী বা শরতকালে গৌরিশংকর আর গনেশহিমালের তুষারে ঢাকা সাদা চূড়া! কতদিন রানওয়ে ট্র্যাফিক ক্লিয়ারেন্স না পাওয়ার কারনে বিমানকে আকাশে একই অবস্থানে অপেক্ষা করতে হয়েছে কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট বা আধাঘণ্টা।
এমনকি ল্যান্ড করার পরেও বিমান থেকে নামতে অপেক্ষা করতে হয়েছে অনেক সময়। আমার মনে কোনদিন কোন ভয় বা আশংকা জাগে নাই কোন দুর্ঘটনার। এমনকি লক্কর ঝক্কর মার্কা অগ্নি এয়ার, বা বুদ্ধা এয়ার বা সিতা এয়ার, এসব ডোমেস্টিক ছোট্ট ছোট্ট ফ্লাইটে চড়ে উঠা নামা করতেও ভয় লাগেনি কখনও।
এমনকি দুই হাজার নয় সালের কোশী ফ্লাডের সময় আর্মির হেলিকপ্টারেও সওয়ার হয়েছি এই বিমানবন্দর দিয়েই। ইন্টারন্যাশনাল আর ডোমেস্টিক সবই ওই এক সিঙ্গেল রানওয়েতে। ০২ বা ২০ কনফিউশন কখনো শুনিনি। তবে, এটা ভালোভাবেই মনে করতে পারি যে বেশিরভাগ সময়েই ফ্লাইটগুলি বৌদ্ধানাথের দিক থেকে ওঠা নামা করতো, কোটেসশরের দিক থেকে খুব কম। কারণটা জানতে বা বুঝতে চেষ্টা করি নাই কখনও।
দুনিয়ার সবচাইতে বিপদজনক এয়ারপোর্টটাই আমার কাছে এত পছন্দের। কোনদিন জানবার চেষ্টাও করি নাই এই বিমানবন্দরে দুর্ঘটনার ইতিবৃত্তান্ত। যেন ত্রিভুবনের আমি আর ত্রিভূবন আমার অংশ হয়ে উঠেছিল।
অব্যবস্থাপনায় ভরা ছোট এই বিমানবন্দরটি আমার বড় প্রিয়, বড় আপন। বাথরুমের কমোড ভাঙ্গা, কলে জল থাকে না, একটামাত্র কফিশপ ছাড়া আর কোন খাবার দোকান নাই, গোটা পাঁচেক মাত্র ডিউটিফ্রি শপ আছে সময় কাটাবার জন্য। ডিসেম্বর জানুয়ারির শীতে বিমানবন্দরে বসে হাঁটু কাঁপে খটখট। না ভয়ে নয়, ঠাণ্ডায়। গরমের দিনে না আছে কোন এসি না হিটিং সিস্টেম টেম্পারেচার যখন তিনে নামে। বোর্ডিং গেটে অপেক্ষারতদের বসবার জন্য যথেষ্ট চেয়ার নাই। এখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে থেকে বিমানের ওঠা নামা দেখা যায়। একতলা এই লাল বিল্ডিংটা ভালো লাগে আমার।
এই লড়ঝড়ে বিমানবন্দর দিয়েই আমার জীবনের প্রায় পচাত্তর শতাংশ বিমান যাত্রা। কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ বিমানের স্টেশন ম্যানেজার থেকে শুরু করে কাউন্টারের গুঞ্জন নামের নেপালী কর্মী যার বাংলা শুনে বুঝবার উপায় নাই সে নেপালী, ইমিগ্রেশনের অফিসার, সিকিউরিটি গার্ড সবার আমি পরিচিত, কারো ‘দিদি’ কারো ‘বইনি’ (বোন)। আমার টুটাফুটা নেপালী ভাষা দিয়ে দিব্যি আলাপ চালাই। দুই হাজার ষোল সালের শেষের দিকে নেপালে আমার কার্যক্রম শেষ হলো, যাত্রা শুরু আফ্রিকাতে। তারপরেও অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত এই ত্রিভূবন আমার ভূবনে বেশ বড় জায়গা জুড়েই আছে, থাকবেও।
মার্চ মাসের বারো তারিখে আমি বসে ছিলাম কাম্পালার হাসপাতালে ডাক্তারের অপেক্ষায়, সহকর্মী জানালো দুর্ঘটনার কথা। নিজের পিঠের ব্যথা যেন ভুলে গেলাম। কেউ ছিল না সেই বিমানে আমার সহকর্মী বা বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন?
মুনমুন প্রায়ই যাতায়াত করে ওর ছোট মেয়েটি নিয়ে, মুনমুনের বরও আসা যাওয়া করে, হারুন বা তার ফ্যামিলি, বা আমার আগের অফিসের সহকর্মীরা ইদানিং প্রায়ই বলতে গেলে প্রতি সপ্তাহে কেউ না কেউ যাতায়াত করছে, এনজিওর সহকর্মীরা যাতায়াত করে, জলিলের কাঠমান্ডু ফেরত যাবার কথা মার্চের বারো তারিখেই, কৃষ্ণা কারকী কি আজই ফেরত যাচ্ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে কাজ শেষে! সুমন বা আর কেউ, যারা কাঠমান্ডুর রেগুলার যাত্রী! খবর পাওয়া গেল তারা কেউই সেই বিমানে ছিল না। স্বার্থপরের মতন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরে টেলিভিশনের সামনে বসি, বিবিসি, আলজাজিরা আর এনডিটিভি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি। ফেসবুকের স্টাটাসে চোখ রাখি। হারুন আর আশেক কাঞ্চণ কি অমানুষিক পরিশ্রম করছে সব বাংলাদেশী আহতদের সহায়তা দেবার জন্য। ঘন্টায় ঘন্টায় ফেসবুকে আপডেট দিচ্ছে। আস্তে আস্তে যাত্রীদের নাম আসতে থাকে। আমার একান্ত কাছের কেউ নাই সেই লিস্টে। আবারো স্বস্তি পাই, স্বার্থপর আমি।
রফিক জামান সাহেবকে কিছুটা জানি কাজের সূত্রে। যখন ক্যানাডিয়ান সিডায় কাজ করতাম তখন ওনাদের সংস্থাকে সহযোগিতা করেছিলাম। বৈশাখী টেলিভিশনের তরুন সাংবাদিক, আমার মামাতো ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আচ্ছা নেপালী ছাত্রছাত্রী যারা সিলেট মেডিকেলে পড়তে এসেছিল তাদের মধ্যে কেউ নাই তো আমার পরিচিত! নেপালী বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করি। ঈশ্বর, আছো কি তুমি?
এক নেপালী সহকর্মীর বড় ভাইয়ের ছেলে ছিল সেই ফ্লাইটে, বড় ভাইটিও আমার পরিচিত, কতবার তাঁদের বাড়িতে হোলি আর দশাইন (দুর্গাপূজা) উদযাপন করতে গেছি। আর আমার সহপাঠী নেপালী বন্ধুর বড় মেয়েটি পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরছিল, তার নাম আহতদের তালিকায় নাই। বসে থাকি বোধহীন। বন্ধুর মেয়েটি আমার নিজের মেয়ের চাইতে অল্প কয়েক বছরের বড়, আমার ছেলের চাইতে বেশ কিছু বছরের ছোট। আমাকে সে ‘মউসি’ (মাসি) না ডেকে খালা ডাকতো। কতবার যে ঢাকা থেকে এই মেয়েটির জন্য চানাচুর, আর সন্দেশ নিয়ে গেছি, নিয়ে গেছি লিচু আর আম। আমরা দুই বন্ধুতে প্রায় ঠাট্টা করতাম যে আমরা ইচ্ছা করলেই বেয়াইন হতে পারি। ফুটফুটে মেয়েটি পড়ালেখায় ভালো ছিল। গাইনোকোলজিস্ট হবার ইচ্ছা ছিল তার।
আজ হয়ে গেছে পাঁচদিন সেই দুঃস্বপ্নের পরে। মন শক্ত করে ফোন করি বন্ধুর নম্বরে, কাঠমান্ডু শহরের বানেশ্বরে তাদের বাড়ি, ত্রিভুবন থেকে খুব দূরে নয়। কতবার গেছি সেই বাড়িতে, খেয়েছি, থেকেছি, গভীর রাত পর্যন্ত গল্প করেছি, নেপালীরা বেশী রাত জাগতে পারে না, মেয়েটি কফি বানিয়ে এনে দিত মা আর তার বন্ধুকে। হেসে হেসে বলতো, খালা, আমি মিরচি (মরিচ) খাওয়া শিখে গেছি। ডাক্তার হয়ে গভীর পাহাড়ের বসতিতে মেয়েদের জন্য কাজ করতে চাইতো, আমি বলতাম তোর মা দেবে তোকে গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে? হাসতো খুব, তুমি আমার হয়ে বলে মামুকে।
তাদের বাড়ির তিনতলার ছাদ থেকে গনেশহিমালের চূড়া দেখা যায় দীপাবলীর সময়ে মেঘ কুয়াশা ছাড়া দিগন্তে। সকাল থেকে কতবার যে ফোন হাতে নিয়েছি, বন্ধুর নম্বর বের করেছি আবার রেখে দিয়েছি ফোন, সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারি নাই। ঘড়ি দেখে সময় হিসাব করি কখন ফোনটা করতে পারি। শেষ পর্যন্ত অনেক শক্তি সঞ্চয় করে ফোন করি, ফোন বেজে যায় ওই প্রান্তে …
ফোন বেজে যায় ওই প্রান্তে কেউ ধরে না, কেটে দিয়ে স্বস্তিরশ্বাস নেই। যাক কেউ ধরে নাই। নিজের মনের সাথে ঠেলা ধাক্কাধাক্কি করে কিছুক্ষণ পরে আবার কল করি, মনে মনে বলি কেউ যেন না ধরে, কিন্তু দুইবার বাজার পরে কেউ ধরে, পরিচয় দিয়ে জানতে চাই আমার বন্ধুর কথা, ফোনটি অন্য কারো কাছে দেওয়া হয়।
ফোনের অন্য প্রান্তে বন্ধুর স্বামীর গলা। আমার গলা দিয়ে স্বর বের হয় না, মনে হয়, ফোন না করলেই হতো। শান্ত স্বরে আমার বিনাজু ( দুলাভাই) কথা বলেন আমার সাথে, বলেন “ছোড়ি (মেয়েকে আদর করে এই নামেই ডাকে নেপালিরা) ডাক্তার হওয়ার পরে বাংলাদেশেই ইন্টার্ন করতে চেয়েছিল। তোমার সাথেই তো কাজ করার কথা আলাপ করতো! বলতো খালার মতো মানবিক সহায়তাকর্মী হবে সে। সেই স্বপ্নতো পুড়ে ছাই হলো বইনি! ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইটে উঠেও ফোন করে বলল যেন ঘণ্টা দুই পরে বিমানবন্দরে আসি যাতে বেশি অপেক্ষা করতে না হয়! আমরা এয়ারপোর্টে বেরোবার আগে তোমার বন্ধু নিয়ম মাফিক পূজা দিয়ে তিলক কাটছিল আমার কপালে! কি হয়ে গেল, বলতো!”
ভয়ে ভয়ে জানতে চাই আমার বন্ধুর কথা, বিনাজু বলেন, দাঁড়াও দিচ্ছি তাকে ফোন, আমি না করে উঠবার আগেই ফোন আমার বন্ধুর কাছে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যেন, তার শান্ত ধীর স্বর শুনি, আমার বুকের ভিতরে কাঁপে। ‘ তুমিতো জানো সাথী (বন্ধু) আমার ছোড়ি ছিল হাজারে এক, হাজারে কী, বলো লাখে-কোটিতে এক। কেন এমন হলো বলোতো? কার দোষে? আমিতো প্রতিবার বাংলাদেশে ফেরৎ যাওয়ার আগে বিপদনাশিনী পূজা দিতাম, দেশে ফেরার পরে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা পশুপতিনাথজি’র চরণে মাথা ঠুকে আসতাম। এই বছর দশাইনের পরে ছোড়ির বেয়ার (বিয়ে) কথা হচ্ছিল! শপিং শুরু করেছি, ইন্ডিয়া থেকে গহনা বানিয়ে এনেছি, একসাথে শাড়ি কিনতে যাবার কথা, বাংলাদেশে ছোড়ি ছুটি শেষে যখন ফেরৎ যাবে! আমাকে বলতো করো তুমি শপিং মামু (মা) আমি কিন্তু আরও পড়বো! আমিতো কারো ক্ষতি করি নাই কখনো, কার পাপে এমন হলো সাথী! ভগবান আমাকে তুলে নিতো!”
আমার কথা বন্ধ হয়ে আসে, ফোন কানে শুনি তার কথা, বলতে পারি না, কারো পাপে নয় সাথী, এ ছিল নিয়তি। বলতে থাকে সে, “আচ্ছা তুমি যে খালি শোনাও আমাদের সন্তানেরা আমাদের নয়, জীবনের সন্তান, তো বলোতো সাথী, জীবনের সন্তানই যদি হবে তবে জীবনতাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে কেন?” ডুকরে ওঠে সে , ‘ও মেরো ছোড়ি! ও হামরো বাবুয়া!’ সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরের সেই হাহাকার ভরা রোদন হিমালয় ডিঙিয়ে, আরব সাগর পাড়ি দিয়ে আমাকে, আমার ত্রিভুবনকে বিদীর্ণ করে দেয়। আমি ফোন নামিয়ে রাখি।
সারাবাংলা/আরএফ