Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বউ-শাশুড়ি সংঘাত? বদলেছে কি সময়?


১৭ মার্চ ২০১৮ ১২:৫১

মারজিয়া প্রভা।।

কেস স্টাডি ০১ : আঞ্জুমান আরা বেগম (ছদ্মনাম) একজন কলেজ শিক্ষিকা। একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলের বউ চাকরি করেন না, ঘর সংসার সামলান। প্রতিদিন সকালে উঠে আঞ্জুমান আরা বেগম বউকে একগাদা কাপড় কাচতে দেন। বউই রান্না করে। কলেজ সেরে ফিরে এসে নিজে খান। কিন্তু বউকে খেতে দেন না। বাড়ির সবার খাওয়া হলে বউকে খাওয়ার অনুমতি দেন। মাঝেমাঝে নিজের মর্জি হলে বউয়ের ভাতের পাতিলে পানি ঢেলে দেন যাতে বউ খেতে না পারে। ছেলের সামনে বউকে ‘মা মা’ বলে আদর করেন। কিন্তু ছেলে ট্যুরে গেলে ছেলের বউয়ের উপর শুরু করেন অবর্ণনীয় অত্যাচার।

বিজ্ঞাপন

কেস স্টাডি ০২ : শাম্মা (ছদ্মনাম) মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির বউ। চাকরি করেন। বিয়ে হয়ে আসার পর তার সবচেয়ে ভয় ছিল শ্বশুরবাড়ি কীভাবে তাকে সম্মান করবে তাই নিয়ে। কিন্তু শাশুড়ি বুকে টেনে নিলেন শাম্মাকে। দুই মেয়ের চাইতেও বেশি আদর করেন শাম্মাকে। শাম্মা চাকরি সেরে বাসায় ফিরলে ঘর গোছানো পায়, খাবার রেডি থাকে। সকালে উঠে শাশুড়ি আম্মাই তাকে টিফিন রেডি করে দেন। আবার ছুটির দিনে শাম্মা শাশুড়িকে কোন কাজ করতে দেয়না। শাম্মা এক সন্তানের মা। প্রায় নয় বছর বিবাহিত জীবন যাচ্ছে তার। এই নয় বছরে কোনদিন শ্বাশুড়ির সঙ্গে তার কোন মনোমালিন্য হয়নি।

কেস স্টাডি ০৩ : পারভিন (ছদ্মনাম) মাস্টার্স পাশ করা উচ্চশিক্ষিত মেয়ে। বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে দেন। যৌথ পরিবারে থাকেন পারভিন। সংসারে খরচ শ্বশুর এবং স্বামী মিলে চালান। তবুও পারভিন রান্না করলে শাশুড়িকে খেতে দেন না। দশ বছরের দেবর অভুক্ত থাকে। কাজের লোক থাকা সত্বেও ননদ শাশুড়িকে দিয়ে ঘরের ভারি ভারি কাজ করান। যদি শরীর অসুস্থ থাকে, কাজ করতে অপারগ জানায় কেউ, তাহলে পারভিন অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।

বিজ্ঞাপন

এই তিনটি ঘটনা কিন্তু প্রাগৌতিহাসিক কালের নয়। ঘটনাগুলো এই সময়েরই। শাশুড়ি এবং ছেলের বউয়ের সম্পর্ক চিরন্তন একটা গবেষণার বিষয় রয়ে গেছে। সাহিত্য, সিনেমা, জেন্ডার বিষয়ক প্রবন্ধে বারবার উঠে এসেছে এই সম্পর্কের কথা! ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে এই সম্পর্ককে। শাশুড়ি এবং ছেলের বউয়ের মধ্যকার সম্পর্ক আসলে কি? সংঘাতের না ভালোবাসার!

শিক্ষার সাথে সাথে সংঘাত কমার কথা থাকলেও সংঘাত কমেনি। আবার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক শাশুড়ি এবং ছেলের বউ নিজেদের ভূমিকা পাল্টে ফেলেছেন। সহজ সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠছে তাদের মাঝে। এইক্ষেত্রে অপর্ণা সেন পরিচালিত “পারমিতার একদিন” চলচ্চিত্রটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এই সিনেমার মূল উপজীব্য ছিল শাশুড়ি অপর্ণা সেন এবং বউ ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের মধ্যকার সম্পর্ক। ছেলের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাবার পরেও এই সম্পর্ক অটুট থাকে। এমনকি ঋতুপর্ণা পুনরায় বিয়ে করার পরেও অপর্ণা সেন তার মৃত্যুশয্যায় ঋতুপর্ণাকেই পাশে চান।

সম্পর্ক তো এমনই হবার কথা! দুইজন নারী একই পরিবারে যখন পাশাপাশি বাস করে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকাটাই সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত। প্রতিদিনকার ভালোবাসার মাঝে অল্প একটু খুনসুটি- যেমন প্রতিটি মা মেয়ের সম্পর্ক হয়, তেমনই হওয়া উচিত শাশুড়ি বউয়ের সম্পর্ক। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। বরং বাংলাদেশে পারিবারিক নির্যাতনের বেশিরভাগ মামলায় মূল ভুমিকা পালন করে এই দুই অসম বয়সের নারীই।

কেন শাশুড়ি এবং বউয়ের মধ্যে সংঘাত এর সম্পর্ক তৈরি হয়? এই প্রশ্নটিই রাখা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে সোশ্যালওয়ার্ক ও জেন্ডার বিষয়ে গবেষণারত জোসিয়া নিশাতের কাছে। নিশাত বলেন, ম্যাক্স ওয়েবারের মতে একজন মানুষ তার ইচ্ছা অনিচ্ছা অন্য একজনের উপর চাপিয়ে দিতে পারে ক্ষমতার কারণে।

নিশাতের একটি গবেষণাই এমন ছিল যে যখন একজন নারী ক্ষমতাশীল হয়ে উঠেন, তখন তিনি তার অধীনস্তদের এক্সপ্লয়েট করতে চান অর্থাৎ তাকে শাসন করতে চান, জোর খাটাতে চান। শাশুড়ি এবং বউয়ের সম্পর্কের মধ্যেই ক্ষমতার এই অপ-অনুশীলন চর্চা করা হয়। এখানে শাশুড়ি বউ মূল কথা নয়, মূলত ক্ষমতাবান একজন ক্ষমতাহীনের উপর ক্ষমতার চর্চা চালায়।

যুগ যুগ ধরে নারীর উপর এই ক্ষমতার অপ-অনুশীলন চালিয়ে আসছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। শাশুড়ি এবং বউ কেবল সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিনিধি হয়েই এই সংঘাতকে জিইয়ে রেখেছে। পুরুষতান্ত্রিকতার মগজধোলাই নারীর উপর নারীর এই সহিংসতা বজায় রাখতে চায়। কেননা এতে পুরুষতন্ত্রেরই লাভ! নারীমুক্তি কেবল স্বপ্নই থেকে যায়!

কিন্তু এতটুকু কি দিনবদল হয়নি? আইনজীবী এবং লেখক প্রমা ইসরাতের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, পারিবারিক নির্যাতন মামলাগুলোতে শাশুড়ি বউয়ের সংঘাতময় সম্পর্ক কতখানি জুড়িয়ে আছে! প্রমা জানান, “পারিবারিক নির্যাতনে যে দেওয়ানি মামলাগুলো আসছে তার অধিকাংশতেই থার্ড পার্টি হিসেবে জড়িয়ে আছে শাশুড়ি অথবা বউয়ের ভুমিকা। ডিভোর্সের মামলা, যৌতুকের মামলাসহ বিভিন্ন মামলাতে পরিলক্ষিত হয় শাশুড়ি বউয়ের সংঘাতময় সম্পর্ক”।

কেন শাশুড়ি বউকে নির্যাতন করে কিংবা বউ শাশুড়িকে! মূল কী কী কারণ বাস্তব জীবনে দেখা যায়?

দীর্ঘদিন পারিবারিক নির্যাতন মামলার অভিজ্ঞতা থেকে প্রমা জানান, এই নির্যাতনে মূল কারণ থাকে পুরুষকে দখল করার ইচ্ছা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে পুরুষকে নিজের কাছে ধরে রাখতে পারলে নারী সফল। তাই শাশুড়ি ছেলেকে এবং স্ত্রী নিজের স্বামীকে দখল করতে চায়। এই জায়গা থেকেই নির্যাতনের এই ঘটনাগুলো ঘটে। এরপরেই যে বিষয়টা চোখে পড়ে তা হচ্ছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। আমাদের দেশের নারীদের অধিকাংশই এখনো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। পরিবারে পুরুষের অর্জিত অর্থের উপর তারা নির্ভরশীল। এই কারণে নিজেদের নিরাপত্তার তাগিদে তারা এই দখলের লড়াই চালিয়ে যায়। সেখান থেকেই শাশুড়ি বউয়ের সংঘাতময় সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। এছাড়া অনেকসময় পরিবারের পুরুষরাও রাজনীতি করে এই সম্পর্ক নিয়ে। যেমন অনেকক্ষেত্রে অনেক পুরুষ নিজেরাই স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে চায় না বলে মাকে দিয়ে স্ত্রীর উপর নির্যাতন চালায়। এইক্ষেত্রে পুরুষের তৈরি করা রাজনীতির হাতিয়ার হয়  দুই নারী।

শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু এই নির্যাতন বন্ধ হয়নি। দীর্ঘদিন মানবাধিকার সংস্থায় কর্মরত  আইনজীবী প্রমা ইসরাতের কাছে আমরা জানতে পারি এখন আগের তুলনায় শাশুড়ি এবং বউয়ের নির্যাতন মামলা বেশি আসছে। তার মানে শিক্ষাও এই সংঘাতময় সম্পর্ককে কোনভাবে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি।

এবার আসি আইনের কথায়। নির্যাতন যখন, তখন এটি প্রতিরোধ করার আইনও রয়েছে। যদিও বেশিরভাগ মানুষই পারিবারিক সহিংসতা আইন সম্পর্কে জানে না। তারা এইসব ক্ষেত্রে যৌতুক বা ডিভোর্সের মামলা করে। কিন্তু পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ এবং সুরক্ষা) ২০১০ সালের মতে, পারিবারিক সহিংসতা বলতে বোঝানো হয় পারিবারিক সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তির উপর শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন এবং আর্থিক নির্যাতনকে। এই আইনের ভিত্তিতে সরকার নির্যাতিতকে সবধরণের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে দেবে।

শাশুড়ি এবং বউয়ের মধ্যকার সংঘাতময় সম্পর্ক অনেকসময় একে অপরের মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকে। অনেকেই এই সম্পর্কের নির্যাতনকে মেনে নিতে পারে না বলে সুইসাইডও করে। তাই সংঘাতময় সম্পর্ককে প্রতিহত করার জন্য সবার পারিবারিক সহিংসতা ২০১০ আইন সম্পর্কে জেনে রাখা খুবই দরকার।

আইন থাকা সত্বেও এবং শিক্ষার প্রসারের পরওত সবক্ষেত্র থেকে এই সংঘাতময় সম্পর্ক নিরসন হয়নি। কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কিছু কিছু পরিবর্তন আসছে। বিশেষ করে শহুরে জীবনে, যেখানে শাশুড়ি এবং বউ দুইজনই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তাদের আত্মসম্মানবোধ তাদেরকে পুরুষ দখল লড়াই থেকে মুক্তি দিয়েছে। তারা নিজেরাই তাদের নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণকর্তা হচ্ছে। আর তাতেই বদল ঘটছে সম্পর্কের। একে অপরকে সম্মান করছে তারা। হয়ত খুব বেশি দেরি নয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে বৃদ্ধাআঙ্গুল দেখিয়ে, সব রাজনীতি ছিন্ন করে সব পরিবারেই শাশুড়ি এবং বউয়ের সম্পর্ক হয়ে উঠবে শুধু ভালোবাসার ও বন্ধুত্বের।

 

অলংকরণ- আবু হাসান

 

সারাবাংলা/এসএস

 

 

সারাবাংলা/এসএস

বউ বউ শাশুড়ি সংঘাত শাশুড়ি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর