Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একাত্তরের বীরকন্যা প্রিনছার কথা আমরা কি জানি?


২৫ মার্চ ২০১৮ ২১:১২

রাখাইন মেয়ে প্রিনছা। পুরো নাম প্রিনছা খেঁ। আদিবাস টেকনাফে। সত্তরের জলছ্বাসে বাবা মায়ের সাথে সাথে বসত ভিটাও হারিয়ে ফেলে মেয়েটি। নামের মতই অপরূপ সুন্দরী মেয়েটার ভাসতে ভাসতে জায়গা হয় বরিশালের সুরেন বাবুর কাছে।

সুরেন বাবু তখন পাথরঘাটা থানার সাধনা ঔষধালয়ের স্থানীয় এজেন্ট। বয়স হয়ে যাওয়ায় আর দোকানে বসে থেকে থেকে সুরেন বাবুর শরীরটাও যেন বিদ্রোহ করতে শুরু করেছিল। এমন সময়ে প্রিনছাকে খুঁজে পান। মেয়েটাকে নিজ সন্তানের মতই কাছে টেনে নিয়েছেন। আবার বাবা মা হারা প্রিনছাও সুরেন বাবুকে নিজের বাবার মতই দেখাশোনা করে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে কৈশোরে সুরেন বাবু ছিলেন বিপ্লবী। মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুটে অংশ নিয়েছিলেন। পরে বৃটিশ সরকার তাকে চট্রগ্রাম থেকে নির্বাসন দিয়েছিল এই বরিশালে। বাকিটা জীবন বৃটিশ সরকারের চোখে চোখে নজরবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে। যদিও পাকিস্তান হওয়াতে সে যন্ত্রনা থেকে আপাতত মুক্ত। কিন্তু সত্তরের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় আবার তাকে কৈশোরে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে যেন। দুর্যোগে আসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন তিনি।

এপ্রিল, ১৯৭১

আটজনের একটা সুইসাইডাল স্কোয়াড এমভি শাহারুন্নেছায় করে তিন চারদিন ধরে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা টহল দিচ্ছে। স্কোয়াডের সবার বয়স ১৮ থেকে ২২ এর মধ্যে। তাদের কাছে গোপন খবর আছে যে এই পথে একটা জাহাজে করে পাকিস্তানের প্রচুর অস্ত্র আর গোলাবারুদ আসবে। তাদের মিশন পাক বাহিনীর জাহাজটা উড়িয়ে দেবার। তিনদিন ধরে জাহাজের টিকিটিরও দেখা মেলে না। এদিকে ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা দেখে এই আটজনের চোখগুলোও ক্লান্ত। হঠাৎ এদের কাছে খবর আসলো কাছেই কোথাও মেডিকেল ক্যাম্প হয়েছে। সেখানে বিদেশি ডাক্তারদের তত্বাবধানে ঢাকা থেকে কিছু ছাত্রও আছে। এটা শুনে তারা সিদ্ধান্ত নিল ক্যাম্প ঘুরে দেখে দুপুরের খাবার খাবে সেখানে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে একে দুর্যোগে মানুষের দুঃখের সীমা নাই। তার উপর সারা দেশ পাকিস্তানিদের দেওয়া আগুনে পুড়ে ছাই। কোথাও কোথাও অবশ্য প্রতিরোধের খবরও ভেসে আসছে। সত্য না মিথ্যে জানার কোন উপায় নেই। এমন সময় মুক্তিযোদ্ধা এসেছে শুনে এলাকার মানুষ ক্যাম্পে জড়ো হয়েছে। শুধুমাত্র একটাবার দেখা চাই মুক্তি দেখতে কেমন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র তাদের অস্ত্রগুলো একটু নেড়েচেড়েও দেখলো

আটজনের সুইসাইডাল স্কোয়াডের একজনের নাম সাইদ। সাংস্কৃতিক কর্মী সাইদ। যুদ্ধের আগে ছিল গান লেখার নেশা। ৬৯’র গনঅভ্যুত্থানের সময় গান লিখে লিখে স্থানীয় মানুষকে অনুপ্রাণিত করতেন। যাই হোক সেদিন দুপুরের খাবার শেষে বিশ্রামের সময় অসম্ভব রূপবতী এক আদিবাসী মেয়েকে দেখেলেন সবাইকে পরম আদরে ডাব কেটে খাওয়াচ্ছে। মেয়েটাকে একবার দেখেই কেমন যেন বুকের মধ্যে ঝড় শুরু হলো। এরপর যতক্ষণ ছিল, পুরোটা সময় জুড়েই মেয়েটার সাথে একটা দুরত্ব বজায় রেখে দূর থেকে দেখে গেল তাকে সাইদ। ইতোমধ্যে অবশ্য মেয়েটার নাম জেনে নিয়েছে। প্রিনছা খেঁ। রাখাইন মেয়ে। সত্তরের জলোচ্ছ্বাসে বাবা মাকে হারিয়েছে মেয়েটা। আজকাল এই মেডিকেল টিমের সাথে নার্স হিসেবে আছে।

এদিকে সাইদকে যুদ্ধের ময়দানে ফিরে যেতে হবে। এভাবে বসে থাকা কোন যোদ্ধার সাজে না। কিন্তু প্রিনছার সাথে কথা না বলেই বা কী করে ফেরে?

বিকেলের দিকে সাইদ প্রিনছাকে বলেই বসল তার ভাল লাগার কথা, অসহায়ত্বের কথা। এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না প্রিনছা। মুখটা একটু মলিন হয়ে গেল মেয়েটার। কিন্তু আসলে জীবন হাতে নিয়ে বাজি ধরা এই ছেলেগুলোকে তারও যে ভাল লেগেছে ভীষণ। হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে প্রিনছাই বলল, ‘এখনতো তো তুমি যুদ্ধে যাচ্ছ, এই অস্ত্রটার যত্ন নিয়ো। এই অস্ত্রটাই এখন তোমার প্রেয়সী। তোমার প্রিনছা। যুদ্ধ শেষ করে ফিরে এসো। আমি অপেক্ষা করব।’

সাইদের আসলে বলার মত আর কিছুই ছিল না। শুধু মনে হতে লাগল যুদ্ধ মানুষকে বড়ই দার্শনিক করে তোলে। সাইদ ফিরে গেল প্রেয়সীকে রেখে দেশ মাকে বাঁচাতে। পরের নয় মাস সাইদের আর কোন খবর পাওয়া যায় না।

জুলাই, ১৯৭১

পাকিস্তানি সৈন্যরা পাথরঘাটা থানা আক্রমণ করলো। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুটে মাস্টারদার সবচাইতে কনিষ্ঠ কর্মী সুরেন বাবু তার বাড়িতেই মরে পড়ে রইলেন। হানাদাররা সুরেন বাবুর বাড়িতেই পেয়ে যায় আঠারো বছরের রূপসী প্রিনছাকে। তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। আর লুটতরাজ তো ছিলই।

একদিন একটা ছেলে রাইফেল সরিয়ে তার হাতটা ধরতে চেয়েছিল। ছেলেটাকে জন্মভূমির কথা বলে ফিরিয়ে দিয়েছিল। আর আজ শতশত রাইফেলের মাঝে আটকে থাকা প্রিনছার শরীরটাকেই মনে হয় জন্মভূমি। এই জন্মভূমির উপর দিয়ে প্রতিদিন চলে শত্রুর ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ ভর্তি গাড়ি। এটাই তো যুদ্ধ। এখানে কেউই ভেঙ্গে পড়ে না। যুদ্ধে যে সবচেয়ে ভাল অস্ত্রের ব্যবহার জানে জয় তারই হয়। প্রিনছাও ভাবে তাকেও তার অস্ত্রের সর্বোচ্চ ব্যবহারই করতে হবে এখন থেকে।

প্রিনছার ছিল অসাধারণ রান্নার হাত। পাকিস্তানিদের দ্বারা অত্যাচারিত হতে হতেই ক্যাম্পের তৃতীয় বাবুর্চির কাজটা সে হাতিয়ে নেয়। তৃতীয় বাবুর্চি হলেও প্রিনছা তার মোহজালে আটকে ফেলে সবাইকে। প্রতিদিন সৈন্যদের প্রিনছার হাতে রান্না খাবারই চাই। এমনকি আমাদের “মেছুয়া বাঙ্গালী” বলা পাকিস্তানি সৈন্যরা তো প্রিনছার রান্না করা মাছ না হলে খেতেই চায় না। ধীরে ধীরে এভাবেই সবার মন জয় করে নিল প্রিনছা।

অক্টোবর মাসে প্রিনছা পাকিস্তানি সৈন্যদের জানালো যে সে অসুস্থ। তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সাথে দুজন সৈন্য দিয়ে ঝালকাঠিতে ডাক্তারের কাছে পাঠানো হল তাকে। ডাক্তারকে প্রিনছা জানালো যে সে আসলে অসুস্থ না। কিন্তু ডাক্তার যেন সৈন্যদের বলে সে অসুস্থ। কারন তাকে আর কয়েকবার এখানে আসতে হবে। এদিকে ডাক্তারের এক ছেলেও মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে নিখোঁজ। তাই প্রিনছার প্রস্তাবে ডাক্তার সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। তিনি সৈন্যদের জানালেন যে প্রিনছা অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে তাই এখন আর এবরশনও সম্ভব না।

প্রিনছাকে তাই কিছুদিন পরপরই চেকাপের জন্য আসতে হবে। এভাবেই প্রিনছা কিছুদিন পর পর ডাক্তারের কাছে আসে। এরইমধ্যে পাকিস্তানিদের বিশ্বাস অর্জন করে ফেলে প্রিনছা। এরকম বিশ্বস্ত প্রিনছার সাথে প্রত্যেকবার দুজন সৈন্য দিয়ে পাঠানোটা পাকিস্তানিদের কাছে ঠিক সম্মানজনক লাগে না। তাই আজকাল আর তারা তার সাথে কোন সৈন্য পাঠায় না। আর এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিল প্রিনছা। আশে পাশে কোন পাকিস্তানি সৈন্য না থাকায় তার সাহস বেড়ে যায় অনেকটা। এবার সে ডাক্তারকে বলে তার বিষ দরকার। যে বিষে একসাথে অনেক লোক মারা যাবে।

প্রিনছার প্রস্তাব শুনে ডাক্তার শুরুতে ভয় পেয়ে গেলেও প্রিনছার মনের জোর আর একাগ্র চিত্ত দেখে না বলার সাহস হলো না।

বিষ হাতে পেয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রিনছা পাকিস্তানি ক্যাম্পের সেনাদের জন্য রান্না করা খাবারের সাথে মিশিয়ে দিলো। ক্যাম্পে থাকা ৪২ জনকেই অনেক আদর যত্ন করে সেদিনের খাবার খাইয়ে সবাইকে অচেতন রেখে সে পালিয়ে চলে এল বরিশাল। বরিশাল এসে জানতে পারলো মাত্র ১৪ জন সে বিষে মারা গেছে। আর বাকিদের ঢাকায় চিকিৎসায় পাঠানো হয়েছে। এটা শুনে ক্ষেপে যায় প্রিনছা। তার মনে হল ডাক্তার তার সাথে বেইমানি করে খারাপ বিষ দিয়েছে। আর একারণেই সব পাকিস্তানি মারা যায় নি। সে এবার ঠিক করে ডাক্তারকেই মেরে ফেলবে। কিন্তু পুরো বরিশালের পাকিস্তানিরাই প্রিনছার কথা জেনে গেছে ততদিনে। তাকে ধরার জন্য হুলিয়া জারি হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রিনছা ঢাকা পালিয়ে যায়। যুদ্ধের বাকিটা সময় সে ঢাকাতেই ছিল। স্বাধীনতার পর আবার বরিশাল ফিরে আসে।

১৯৭২ সালে বরিশালে সাইদের সাথে আবার দেখা হয় প্রিনছার এক সাংস্কৃতিক আড্ডায়। দেখা হওয়ার পরে কথপোকথনের এক পর্যায়ে প্রিনছা সাঈদকে কি বলেছিল জানেন? বলেছিল “একদিন নিশ্চয়ই আমার বিয়ে হবে, কেন হবে না? আমি কি খারাপ মেয়ে? আমিতো যুদ্ধ করেছি, পাকিস্তানি শত্রু মেরেছি।”

সাইদ সেদিন নির্বাক ছিলেন। কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। একটা পুরনো জমিদার বাড়ির উঠোনের এক কোণে দীর্ঘক্ষন বসে ছিল দুজন শূন্য চোখে তাকিয়ে।

একটু থেমে প্রিনছা আবার বলে ওঠে “এখন বলতো আমার এই দেহটা কী সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার নয় শত্রু হননে? এ হাতিয়ার ব্যবহৃত হয়েছে লক্ষ কোটি মানুষের মুক্তির জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য। জানো সাইদ আমার এই দেহ, এই রূপ লাবন্যের জন্য আমি গর্বিত। মুক্তিযুদ্ধের এমন হাতিয়ার আর দেখেছ? তুমিই বল, যুদ্ধের সময় তোমার হাতে যে অস্ত্র ছিল, সেটা আর আমার এই দেহ কি আলাদা আলাদা অস্ত্র। এমন একটা মুক্তিযুদ্ধ না এলে কি করে জানতাম, আমি একজন প্রিনছা একটি সুতীক্ষ্ণ আবেগময় হাতিয়ার।”

প্রিনছাকে এখন কেউ শ্রদ্ধা মাখানো কথা বলেই চলে যাবেন না। আদিবাসীদের কথা বা রাখাইনদের কথা জানতে চেষ্টা করুন। তাদের নারীরা এখনও ধর্ষিত হন। বরগুনা, পটুয়াখালী অঞ্চলে তারা আজও নির্যাতিত। জানতে চান প্রিনছার বাংলাদেশ আজ কোথায় হারালো?

সেই দেশ কেন আর কীভাবে নিরুদ্দেশ?

তথ্য কৃতজ্ঞতা-  জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা মেজর কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া (অবঃ)

 

সারাবাংলা/আরএফ

পাকিস্তানি প্রিনছা বীর কন্যা মুক্তিযুদ্ধ রাখাইন মেয়ে সুইসাইডাল স্কোয়াড

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর