নামের শেষে স্বামীর নাম! নারীর এটা কেমন নাম?
১৭ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:২০
জান্নাতুল মাওয়া।।
গত ১৯শে মার্চ নির্বাচন কমিশনের সভায় একটি নতুন সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নারীরা চাইলেই বিয়ের পরে জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম সংশোধন করে স্বামীর নামের কোন অংশ বা পদবি যুক্ত করতে পারবেন না। বিশেষ প্রয়োজনে যদি কেউ স্বামীর নাম যুক্ত করতে চান তাহলে তাকে নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এই বিষয়ে বলেন, “শিক্ষা সনদে যে নাম ছিলো সে নামে পরিচয়পত্র করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাদের সনদ নেই তাদের ক্ষেত্রে মা বাবা যে নাম রেখেছেন সেটিই রাখতে হবে। প্রয়োজনে কেউ স্বামীর নাম যুক্ত করতে চাইলে ইসিতে দরখাস্ত করতে হবে। প্রতিটি আবেদন আলাদা আলাদা ভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ইসি সিদ্ধান্ত নেবে”।
গণমাধ্যমে এই খবর আসার পর এর পক্ষে বিপক্ষে শুরু হয়েছে নানান আলোচনা সমালোচনা। অনেকেই বলেছেন, স্বামীর নামের অংশ নিজের নামের সাথে জুড়ে দেয়ার বিষয়টিকে মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। আবার অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অন্যদিকে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা ইসির এই নতুন নিয়মের বিরোধিতা করেছে। এর পেছনে রয়েছে হিন্দু ধর্মের বিবাহের বিশেষ নিয়ম যে নিয়ম অনুযায়ী বিয়ের পর নারীরা বাবার গোত্র থেকে স্বামীর গোত্রে চলে যান। তখন তাদেরকে স্বামীর গোত্রের পদবি ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ ভারতীয় উপমহাদেশে বিয়ের পরে স্বামীর নামের অংশ মেয়েদের নামের সাথে ব্যবহার করার মূলে রয়েছে হিন্দু ধর্মের বিবাহ রীতির এই বিশেষ নিয়মটি।
একসময় শুধু পদবি নয় ভারতের অভিজাত পরিবারের লোকেরা নতুন বউ এনে তার পুরো নামটাই পালটে ফেলতো। ঠাকুরবাড়ির লোকেরা ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হলেও তাদের সব বউদেরই বিয়ের পর নতুন নাম দেয়া হত। সে সময় এ অঞ্চলের অনেক অভিজাত মুসলিম পরিবারকেও দেখা যায় বিয়ের পর মেয়েদের নামের শেষে স্বামীর নামের অংশ জুড়ে দিতে। এই অঞ্চলের মুসলিমরা মূলত হিন্দু এবং ইওরোপিয়ানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এই কাজ করছে বলে অনুমান করা যায়।
ইওরোপ আমেরিকায় প্রায় সব নারীই বিয়ের পর স্বামীর বংশের পদবি বা স্বামীর নামের শেষ অংশ ব্যবহার করেন। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত একটি জরিপের ফল বলছে ৭৫ শতাংশ ব্রিটিশ নারী তাদের স্বামীর পদবি নেন। তবে ১৯৯৪ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী এই সংখ্যা ছিল ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ নাম পালটানোর এই প্রবণতা খুব ধীরে হলেও পাল্টাচ্ছে। এই নাম পালটানোর সাথে বিয়ের বয়সেরও একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি জরিপ থেকে দেখা যায় সেদেশে ৩০ বছরের কম বয়সে যে নারীরা বিয়ে করেছেন তাদের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশ নিজের নাম পরিবর্তন করেন নি। অন্য দিকে ৪০ এর বেশি বয়সে যারা বিয়ে করেছেন তাদের মধ্যে এই হার বেড়ে ৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
হাফিংটন পোস্টের একটি জরিপে বের হয় ৫৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন নাম পরিবর্তনের বিষয়টি নারীদের স্বাধীন সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। তবে মজার বিষয় হল এদের অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে স্বামীর নাম নেয়ার পক্ষপাতী। ৩১ শতাংশ মানুষ মনে করেন একজন নারীর অবশ্যই স্বামীর নাম নেয়া উচিত। অন্যদিকে ১১ শতাংশ অংশগ্রহণকারী স্বামীর নাম ব্যবহার করার বিপক্ষে মত দেন। দেখা যাচ্ছে এখনো অধিকাংশ মানুষই স্বামীর নামের অংশ ব্যবহার করার পক্ষেই মত দেয়।
ইসলাম ধর্মে স্বামীর নামের অংশ ব্যবহারের বিষয়ে কোন বাধ্যবাধকতা আছে কি না এই বিষয়ে জানতে চাইলে মুফতি এনায়েত জানান, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী বিয়ের পরে স্বামীর নামের অংশ নেয়ার কোন সুযোগ নেই। যেহেতু ইসলাম ধর্মে জন্মের পরেই আকিকা দিয়ে নাম রাখা হয় তাই এক্ষেত্রে বিয়ের পর নতুন নাম রাখা একদমই জায়েজ নয়।
কিন্তু মজার বিষয় হল, আমাদের দেশের অনেক মুসলিম মেয়েই কোন রকম ধর্মীয় আর সামাজিক বাধা বিপত্তি ছাড়াই বিয়ের পরে তাদের নামের পেছনে স্বামীর নামের অংশ যোগ করেন। ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী মনিরা আহমেদ বিয়ের পর তার নাম পালটানোর বিষয়ে বলেন, আসলে তার সব অফিসিয়াল কাগজে আগের নামই আছে। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি স্বামীর নামের অংশ ব্যবহার করছেন। এটা তিনি যে খুব ভাবনা চিন্তা করে করেছেন তা না। তবে তার নিজের নামের শেষ অংশটা তার তেমন ভালো লাগেনা বলে সামাজিকভাবে স্বামীর নামের সাথে মিলিয়ে পরিচিত হতে পেরে তিনি খুশি।
বিয়ের পর নামের শেষ অংশে স্বামীর নাম ব্যবহার করেছেন এমন একজন হলেন তাসরিন রশীদ ইসলাম। তিনি জানান, নামের শেষের অংশ এক না হওয়ায় একবার বিদেশে বেড়াতে গিয়ে তার বোন এবং দুলাভাই বেশ সমস্যায় পড়েছিলেন । তাদের হাতের কাছে তখন বিয়ের সার্টিফিকেটও ছিলোনা। আর সেই কথা মাথায় রেখেই তিনি ন্যাশনাল আইডি কার্ডে তার নামের শেষে স্বামীর নাম রেখেছেন। এছাড়াও তার নিজের পরিবারে তারা সবাই তাদের বাবার নামের শেষ অংশ ব্যবহার করেন। একটা পরিবারের সবার নামের শেষ অংশ এক, এই বিষয়টা দেখতে তার খুব ভালো লাগে। তবে তাসরিনের শিক্ষা সনদে আগের নামই আছে। দুই নামের কারনে পরবর্তীতে তার তেমন কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি বলে জানালেন তাসরিন।
তবে বিয়ের পরে নিজের নাম পাল্টাননি এমন একজন প্রবাসী বাঙালি মেয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস। তিনি জানান তিনি কখনোই তার স্বামীর সাথে সারনেম এক না হওয়ার কারনে কোথাও তেমন কোন সমস্যার মুখোমুখি হননি। তিনি বলেন, যারা নামের শেষে স্বামী বা বাবার নাম যুক্ত করে তাদের নামের শেষের অংশ দেখলে হঠাৎ করে বোঝা যায়না যে এটা তার স্বামীর নাম না কি বাবার নাম। এই জিনিসটা তার কাছে বেশ বিরক্তিকর মনে হয়। বিখ্যাত ইংরেজ গায়িকা শেরিলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেরিল সহ আরো বেশ কিছু বিখ্যাত সেলিব্রেটির ক্ষেত্রে দেখেছেন এরা যে সময়ে পরিচিত এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন সে সময় হয়তো তাদের নামের শেষ অংশ ছিল স্বামীর নামে। শেষে দেখা গিয়েছে সে স্বামীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও আগের নামে পরিচিত হবার কারণে তারা সেই পুরনো নাম সারা জীবন ঘাড়ে করে বহন করে যাচ্ছেন অথবা বিব্রতকর সব সমস্যায় পড়ছেন। তাই বিয়ের পর নাম পাল্টানোর পুরো ধারণাটাই ফেরদাউসের কাছে খুবই হাস্যকর মনে হয়। তিনি বলেন,তার শিক্ষা সনদ থেকে শুরু করে প্রতিটি কাগজেই এক নাম হওয়ায় তাকে কোন জটিলতায় পড়তে হয়নি। তিনি আরো জানান, সন্তানেরা যখন বাবার নামের শেষের অংশ ব্যবহার করে তাহলে অনেক সময় মাকে দলছুট মনে হয়। তাই তার দুই সন্তানের নামের শেষেও কোন পারিবারিক পদবি বা নাম ব্যবহার করেন নি। সন্তানের নামের সাথে বাবার নাম না মেলায় অফিসিয়াল কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি ফর্ম ফিলাপ করতে হয়েছে। তবে সন্তানদেরকে আলাদা নামে পরিচিত করার আনন্দের কাছে এই বাড়তি কয়েকটা ফর্ম পূরণের ঝামেলাকে তিনি ঝামেলা মনে করেন না। তিনি জানান, কানাডায় বেশিরভাগ মানুষকেই তার নামের শেষ অংশ ধরে ডাকা হয়। সুতরাং নামের শেষ অংশ তার নিজের হওয়াই যুক্তিযুক্ত। কেন একজন মানুষ সারাজীবন ধরে বাবা বা স্বামীর নামে পরিচিত হবেন, এর কোন যুক্তিই খুঁজে পাননা ফেরদাউস।
বিয়ের পরে নাম পাল্টানোর পর দেখা যায় বিয়ের আগের সব অফিসিয়াল কাগজে এক নাম এবং বিয়ের পরে বাচ্চাদের আইডি কার্ড থেকে শুরু করে বাকি সব অফিসিয়াল কাগজে আরেক নাম। এই কারনেও অনেক নারী নানান ঝামেলায় পড়ে যান অনেক সময়। অফিসিয়ালি বা স্বেচ্ছায় নাম পরিবর্তন করা ছাড়াও আমাদের উচ্চশিক্ষিত সমাজে অনেক সময় ইওরোপ আমেরিকার অনুকরণে নারীদেরকে বিয়ের পরে স্বামীর নামের শেষ অংশ দিয়ে পরিচিত করানোর একটা প্রবণতা দেখা যায়। স্বামীর অফিসিয়াল গন্ডিতে মেয়েদের কোন নাম থাকেই না বলতে গেলে। সবাই মিসেস মকবুল, মিসেস রফিক হয়ে হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে বেড়ান। আশেপাশের ভাবিরা তখন সিদ্দিক ভাবি, সুনীল ভাবি হয়ে যান। বিপরীতে স্ত্রীর নাম ব্যবহার করে স্বামীকে পরিচয় করানোর প্রবণতা দেখা যায়না। স্ত্রী যদি অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিও হন তবুও স্বামীকে কেও সুলতানা ভাই বা কাকলি ভাই বলে ডাকেনা।
অনেক নারী স্বামীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে নিজের নামের শেষে স্বামীর নাম যোগ করলেও কখনও কোন স্বামীকে দেখা যায়না ভালবেসে স্ত্রীর নামের শেষের অংশ যোগ করতে। ২০১৩ সালের একটি জরিপে দেখা যায় আমেরিকায় ৬৩ শতাংশ পুরুষ খুব মন খারাপ করে যদি স্ত্রীরা বিয়ের পরে স্বামীর নামের শেষ অংশ ব্যবহার না করে। অন্যদিকে ৯৬ শতাংশ পুরুষ জানান তারা কখনোই চাইবেন না তাদের স্ত্রীদের নামের শেষ অংশ নিজের নামের সাথে জুড়ে দেয়া হোক! কিন্তু স্ত্রীদের ক্ষেত্রে এই প্রেজুডিসগুলো অনেক সময় কাজ করেনা।
বিখ্যাত স্বামীদের স্ত্রীরা খুব আনন্দের সাথে স্বামীর নাম ব্যবহার করেন। যেমন আমাদের দেশের সেলিব্রিটি ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের স্ত্রী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের নাম রেখেছেন শাকিব উম্মে আল হাসান। অর্থাৎ তিনি তার বিখ্যাত স্বামীর নামে পরিচিত হতে মোটেই কুণ্ঠাবোধ করেননি। অন্যদিকে আজ পর্যন্ত কোন বিখ্যাত স্ত্রীর স্বামীকেই তার স্ত্রীর নামে পরিচিত হতে দেখা যায়নি। এর পেছনে সমাজের প্রচলিত প্রথা, স্ত্রীদের আত্মমর্যাদার অভাব,স্বামীদের ইগো- এই তিনটি বিষয়ের ঠিক কোনটি যে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে সেটি একটি গবেষণার বিষয় বটে।
নাম একজন মানুষের মৌলিক পরিচয়ের অন্যতম অংশ। বিয়ের মাধ্যমে একজন নারীর সেই পরিচয়টিও পালটে যাবার মত একটি সামাজিক প্রথাকে প্রায় সব নারী-পুরুষই খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার বলে ধরে নিয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনের নতুন নিয়মটি এদেশের মেয়েদেরকে বিয়ের পর তাদের নাম পাল্টাতে নিরুৎসাহিত করবে বলে আশা করা যায়।
অলঙ্করণ- আবু হাসান
সারাবাংলা/জেএম/এসএস