আমার প্রথম…
৮ মে ২০১৮ ১৮:৫০
আমি যখন সেভেন/এইটে পড়ি তখন আমার হাড়ের উপর চামড়া ছাড়া শরীরে কিছুই ছিলনা। অপরিপক্ক বক্ষদেশের এই আমাকে ছেলেরা খুব বেশি পছন্দ করত না। সারামুখে বড় বড় দুটো চোখ আর সুন্দর সিল্কি চুল বাদে আকর্ষণ করার মতো বেশি কিছু সৌন্দর্য ছিলনা। তবে আমি গর্ব করে বলতে পারি ভেতরের সব সৌন্দর্য নিয়েই আমার জন্ম হয়েছে, যা আমাকে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায়না।
মানুষের পছন্দ বা ভালোলাগার শেষ নেই, এ এক রহস্যময় অনুভূতি।
আমি খুব শুকনা পাতলা ছিলাম বলে কৈশোরে আমাকে খুব বেশি ছেলেদের উদ্ধত আচরণের সম্মুখীন হতে হয়নি। তবে পুর্ব গুপ্তপাড়ার ছেলেরা আমাকে ‘টিকটিকি’ বলে টিজ করতো। জানিনা- কেন? অনেকে বলতো, তুই শুকনা পাতলা, সারামুখে চোখ ছাড়া কিছুই দেখা যায়না, হয়তো সেজন্য। আবার কেউ বলতো তুই সারাপাড়া টিকটিকির মত ঘুরে বেড়াস, সেটাই মূল কারণ। তবে যে কারণেই হোক আমি টিকটিকি শুনলেই খুব রেগে যেতাম। রেগে গিয়ে ওই বড় বড় ছেলেদের কাছে গিয়ে মাস্তানি করে আসতাম। পাড়ায় আমার মাস্তানি করার অনেক গল্প আছে। যাই হোক ফিরে আসার সময় পিছন থেকে আরো হাসাহাসি করে আবারো চিৎকার করে ‘টিকটিকি’ বলে ডাকতো।
উত্তরবঙ্গের মধ্যে রংপুর মনে হতো টিজ করার জন্য বিশেষ পরিচিত। আবার অদ্ভুত একটা সাইকোলজি কাজ করে মেয়েদের মধ্যেও যে, টিজ করলে মেয়েরা নিজেদের গুরুত্ব সম্পর্কে অভিহিত হন। নারী সৌন্দর্যের আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায়। পুরোটাই ভীষণ সিনেম্যাটিক।
আমাদের শহরে দুটো গুপ্তপাড়া- পুর্বগুপ্তপাড়া ও দক্ষিণ গুপ্তপাড়া। মারামারির জন্য এই দুই গুপ্তপাড়ার ছেলেরা বিখ্যাত ছিলো। কাজেই কোন মেয়েকে যদি এই দুই পাড়ার ছেলেরা পছন্দ করে ফেলত তো আর তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় থাকতোনা বরং সারাজীবনের জন্য নিন্দিতজীবন বহন করতে হতো। বেচারা গুপ্তপাড়ার ছেলেরা! এতো প্রেমিক হয়েও তাঁরা অভিভাবকের কাছে জামাই হিসেবে ছিলো অযোগ্য। সেকারণে প্রেমে বা টিজে রেসপন্স করা কখনো হয়ে তো ওঠেইনি বরং তাদের এড়িয়ে চলা ছিল মঙ্গল।
আমি যে স্কুলে পড়তাম সে স্কুলটি ছিলো দক্ষিণ গুপ্তপাড়ায়। আমাদের স্কুল যাওয়া আসার পথটা খুব মনে পড়ে। ছুটির পর পুরো রাস্তা নীল হয়ে যেতো। দলে দলে নীল পোশাকের মেয়েরা হাসাহাসি আনন্দ করে বা ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরত। আর অতটুকু সময়ের মধ্যেই প্রেমিক ছেলেরা সাইকেল নিয়ে দ্রুত পাশ কেটে যেত কিংবা চক্কর দিত ঘন ঘন; এরই মাঝে কখন যেন প্রেমিকাদের হাতে চিঠি দেয়ার কাজটা সেরে ফেলতো। এগুলো আবার অন্য মেয়েরা দেখলেই দারুণ আনন্দ পেত বা সমালোচনার ভঙ্গিতে বলাবলি- হাসাহাসি করত।
এসব থেকে আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতাম বটে কিন্তু মনের মধ্যে একটা দুটো চিঠি পাওয়ার ব্যাকুলতা যে কাজ করেনি, তা নয়। মাত্র বয়ঃসন্ধি ঘটছে, শরীরে সিনেমার মত প্রেম জাগে। বিয়ে ব্যাপারটা তো কিছুটা বুঝি, তাইনা! একজন পুরুষের সান্নিধ্যলাভ মানেই বিবাহ। বউ সাজবো, শাড়ি ব্লাউজ পড়বো। স্বামীর সাথে বেড়াতে যাবো, বাসা থেকে কোন নিষেধ থাকবেনা। শ্বশুর শাশুড়ীর মন জয় করবো আমিই, টুকটাক রান্না শেখার আগ্রহ মানে স্বামীকে খাওয়াবো, কত কত চিন্তা মাথায় ওফফ! আর কতদিন ভালো লাগে এই নীল রঙের স্কুল পোশাক। কেন যে দ্রুত বড় হচ্ছিনা! আমি তো ভেতরে ভেতরে অনেক বুঝি, বড় হচ্ছি আপনালয়ে কিন্তু আমার শীর্ণ শরীর বাহ্যিক রূপ বুঝাতে ব্যর্থ। সেসব সময়ে সুস্বাস্থ্যের উন্নতবক্ষা মেয়েদের ভীষণ চাহিদা ছিলো প্রেমবাজারে। এক্ষেত্রে আমি বিষয় বহির্ভূতে পড়ি।
আমার সুস্বাস্থ্যের সহপাঠীরা তখন অনেকেই সেমিজের নিচে বক্ষবন্ধনী পড়া শুরু করে। তাদের বাসা থেকেই নাকি এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমি তো এই কথা বাসায় বলার জন্য ভাবতেও পারিনা, ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা!
আর আমার শরীর এমন কোন দৃষ্টিকটু না যে, আমাকে বক্ষবন্ধনী গ্রহণ করতে হবে। সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় বাজারে আমার সাইজের কিছুই মিলবেনা। বডি ত্রিশ থেকেই শুরু, তারও উপযোগী নই আমি।
আমাদের জুম্মাপাড়ার নাজনীন ছিলো আমার প্রিয় বান্ধবী। ও দেখতে ভারতীয় নায়িকা পদ্মিনীর মত ছিল বলে ওকে পদ্মিনী বলেও ডাকতাম। ওরা বিহারী ছিলো। ওর সাথে আমার সখ্য সালেমা উচ্চ বালিকা বিদ্যলয়ের ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই গড়ে উঠে। আমাকে ও খুব পড়াশুনায় সাহায্য করতো। বাড়ির কাজ না করে গেলে ক্লাশের ফাঁকে ও’র খাতা দেখে লিখে ফেলতাম। আমাদের সময় লেখাপড়া নিয়ে এক ধরনের গোপনীয়তা ছিলো। কেউ কারো খাতা অন্যকে দেখাতাম না। এখন আছে কিনা জানিনা। নাজনীন জ্যামিতি, অংক, গ্রামার সব আমাকে দেখাতো। ওর সাথে আমার মনের অনেক মিল ছিল। আমি ওদের বাসায় ছিলাম দারুণ প্রিয়ভাজন একজন মানুষ। আমি খুব কমিকস করতাম বলে তারা আমার দারুণ ভক্ত ছিল। ওর ভাইবোনেরা আমাকে অনেক আদর করতো। সব বড়বড় বোন ছিলো আর ছোট দুটো ভাই। ওদের বাসাটা বেশ সাজানো গুছানো ছিলো আর সারাবাড়ির দেয়ালজুড়ে পাকিস্তানী খেলোয়ার ইমরান খানের ছোটবড় অনেক পোস্টার।
নাজনীনের সাথে আমার একটা বিষয়ে অমিল ছিল। আমি মোটেও ইমরান খানকে পছন্দ করতাম না। আমি ছিলাম ওয়াসিম আকরামের ভক্ত। ও বলতো খেলার কথা। আমি বলতাম, চেহারার কথা। ওই বয়সে যার মধ্যে হিরোইজম আছে আমরা তারই প্রেমে পড়তাম। ওকে অনেক পচাতে পচাতে তখনই রাগাতে পারতাম। ওর একটা ভাঙা ভাঙা বাংলা টোনে বাজে দুই একটি গালি শুনতেও খুব মজা পেতাম।
আমাদের বয়ঃসন্ধির অনেক গোপন গল্প বেঞ্চের পিছনে বা বইয়ের উপর মাথা রেখে ফিসফিস করে আলাপ করতাম। আমাদের দুজনের কেউ প্রেম নিয়ে মাথা ঘামতাম না বরং অন্য যে বান্ধবীরা এসব চিঠিপত্র নিয়ে ফিসফাস করতো আমরা দুজন একদম দুই চক্ষে দেখতে পারতাম না। আমরা খুব ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠান আর সিনেমার গল্প করতাম। ভিসিআর এ ছবি দেখার একটা বিশাল স্ট্যাটাস তখন ছিল। ওরা উর্দু পারতো বলে খুব ভালো হিন্দি বুঝতো। ছবির গল্প ও পড়া মুখস্থের মত বলতে পারত। বেশি মজা পাইতাম পরিবারের সবাই একসাথে ছবি দেখার সময় “চুমুর দৃশ্যে” কে কখন ঘর ছেড়ে বাইরে যেত এটা শুনতে। কেউ পানি খেতে, কেউ টয়লেটে নিজের কাজে যেত। ভূতের ছবিগুলো একটু বেশি অ্যাডাল্ট ছিলো কিন্তু খুব মজা পেতাম। কে আগে নতুন মুভি দেখে ক্লাশে ‘পার্ট’ নিতে পারে এটাও ফ্যাশন ছিলো।
একদিন নাজনীন এসে বলল, ‘আমি ব্রেসিয়ার পড়েছি’।
আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। দেখি দেখি বলে বিপুল উৎসাহ নিয়ে জামার ঘাড়ের কাপড় সরিয়ে সত্যি ফিতার অস্তিত্ব দেখতে পেলাম।
আমি বললাম, ‘তোর বাসায় জানলে মারবেনা’! আমি শুনেই অবাক, ওর বড় বোনেরা নাকি পড়তে দিয়েছে। ইসস! আমার বোনেরা তো শুনলেই মারবে।
তখন ক্লাশ এইটে পড়ি। একদিন নাজনীন এসে বলল, ওদের বাসায় বোনদের ছোট কাপড়ের মাঝে একটা ছোট খুঁজে পাওয়া গেছে। আমার জন্য নাকি একটা ‘ব্রেসিয়ার’ আনবে কাল। আমি যখন আমার শীর্ণ শরীরের অক্ষমতা বর্নণা করি তখন সে নিশ্চিত করে সাইজের কথা বলে যে, ওটাই নাকি আমার জন্য সঠিক।
কী এক উত্তেজনা বুকে, মনে প্রাণে! কালকের দিনটা যখন এলো, তখন আমরা টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের নোংরা টয়লেট গিয়ে ব্রা পড়ার রিহার্সেল করি। আমাদের টয়লেটের দেয়ালে খুব পচা পচা কথা লেখা থাকত। শুনতাম এগুলো স্কুল ছুটির পর ছেলেরা বল খেলতে যখন আমাদের ইস্কুলে আসত তখন লিখে রেখে যেত। আমরা সেসব লেখার দিকে লজ্জায় তাকাতাম না। মেয়েরা ভীষণ বলাবলি করত, ভয়ে সেসব টয়লেটে যেতাম না। সিনিয়র আপাদের সামনে যেন চোখে না পড়ে তাই অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু বললেই কি চোখ এড়ানো যায়? ঠিক চোখ পড়ে যায় দেয়ালে। সেদিন দেয়ালের দিকে তাকাতে যেন আরও লজ্জায় শরীর অবশ হয়ে আসছে।
চোখ ফিরিয়ে একে একে ভাঁজ করা ওড়না খুলে নাজনীনের হাতে দিলাম, দিলাম বেল্ট ও স্ক্রাপ। এবার জামা খুলে হাঁটুতে রেখে পরে ফেললাম ছোট সুতির ঘিয়া রঙের ব্রা। মা বোনেরা যেভাবে পরে তা আমার জানা ছিলো। নাজনীন বলেছিল তার সাহায্য লাগবে কিনা! আমি নিজস্ব পারদশির্তায় কার্য সম্পন্ন করে টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলাম।
জীবনের অদ্ভুত এক অনুভূতি আমার সারা শরীরে। এক অজানা সত্য আমার দেহের ভেতর নতুন রক্ত সঞ্চালন শুরু করেছে। লজ্জা, ভয় আর শরীর নব দিগন্তে হাতছানি দেয়। ক্ষণে ক্ষণে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে কী এক ভাবনায়।
টিফিন ক্লাশের পরে আমরা দু’জন সেকেন্ড কিংবা থার্ড বেঞ্চে বসে ক্লাশ করছি। ও আমাকে বার বার নানান জিজ্ঞাসায় সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছিলো। আমি এক পর্যায় আর সইতে না পেরে বললাম, আমি এইটা খুলে ফেলব এখনি, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ও বলল, প্রথমদিন একটু খারাপ লাগবে। পরে অভ্যাস হয়ে যাবে। আমি ওকে বললাম, চল টয়লেটে যাই। ও বলল দুজনকে একসাথে যেতে দেবেনা, ক্লাশ শেষ হোক।
তাহলে এক এক করে চল।
বলল, অন্য মেয়েরা টের পেয়ে যাবে দুজন এক সাথে গেলে।
আমার তখন দম যায় যায়। আমার প্রকাণ্ড ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে মনে, কীসের জন্য এমন মন খারাপ লাগছে আমি জানিনা! বুকের ভেতর ধুক ধুক শব্দ আমাকে গ্রাস করছে। ইতিহাস ক্লাশের প্রতি অমনোযোগী ছাত্রী। মনে হচ্ছে আমি হঠাৎ এক সেকেন্ডে বড় হয়ে গেলাম। পরিবারের সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছি। আমার বিয়ে হয়ে যাবে। আমি কেন বড় হচ্ছি?
আমি বড় হব না। ছোট থাকব। খুলে দে নাজনীন!
কী মুশকিল! আমি ওকে অস্থির করে তুলি। আমার অস্থিরতা দেখে নাজনীন এ পর্যায় আমাকে বেল্ট খুলে ফেলতে বলে। তারপর জামার পিছন দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ব্রা’র বেল্ট খুলে দেয়। আমি কিছুটা স্বস্তিবোধ করি বটে তবে গা থেকে ঐ বস্তুটা পুরোপুরি সরিয়ে না ফেললে আমি অজানা দেশ থেকে ফিরে আসতে পারছিনা।
ক্লাস চলছে। আমরা অন্য মেয়েদের আড়ালে বেঞ্চে বসেই শুরু করি। আমার উসখুস দেখে সে অন্য মেয়েদের উপর নজর রাখছে গোয়েন্দা চোখে যাতে কেউ টের না পায় যে আমি আজ স্বর্গীয় পোশাকে নিজেকে আবদ্ধ করেছিলাম।
এবার ওরই পরিচালনায় আমি আমার হাত দিয়ে বেল্ট টেনে টেনে খুলে ফেলি।
আহ! শান্তি। জামার তলা থেকে দ্রুত ওটা বের করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখি। ভাগ্যিস ক্লাশে আপা সেদিন আমার এই বক্ষবন্ধনী পরার ইতিহাস জানতে পারেননি। তাহলে হয়তো ক্লাশে নতুন ইতিহাস পড়ানো ঘটে যেত ব্রা পরহিতা এই নারী যোদ্ধার শরীর, দেহ ও অবকাঠামো নিয়ে। টিপু সুলতানের ধার তলোয়ারের বদলে দ্য ব্রা অফ শাহনেওয়াজ কাকলী।
এবার ওটা বাড়ি নিয়ে কোথায় রাখবো? যদি বোনেরা টের পেয়ে যায় তো কানের মধ্যে একটা জোরে লাগিয়ে দিয়ে বলবে, বেশি পাকনা হইছিস নাহ!
অনেকদিন সেটা গোপনে গোপনে রেখেছিলাম। এরপর সময়ের প্রয়োজনে কবে থেকে ব্রা পড়া শুরু করি মনে নেই।
এই গল্পটা হঠাৎ যেদিন আমার বরকে বলি। ও হাসতে হাসতে বলল, লিখে ফেল। জীবনের এমন মজার স্মৃতি তো রোজ মনে পড়বেনা।
গল্প যাই হোক না কেন, সেটা মনে করে সুন্দর করে লিখতে পারাটাই আসল। প্রাণের (আমার বন্ধু) উৎসাহে সত্যি আমার এই স্মৃতিলেখা।
সারাবাংলা/এসএস