Friday 06 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারার ৯ শহীদের কথা

মাহবুব আহমেদ
১১ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:১০

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির এক অনন্য ইতিহাস। একটি দেশকে স্বাধীন করার জন্য ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর ২ লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, কোটি কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা মুক্তির সংগ্রামের এক গৌরবময় অধ্যায়ের কথা বলে যায় কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা নামের স্থানটি। একাত্তরের ১১ নভেম্বর ভারত থেকে ট্রেনিং পাওয়া একটি গেরিলা দল বাংলাদেশে প্রবেশের সময় কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশের মুখে পড়ে। সেদিন নয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

বিজ্ঞাপন

কী ঘটেছিল সেদিন বেতিয়ারায়?

আগরতলা থেকে ট্রেনিং পাওয়া একদল মুক্তিযোদ্ধারা এদিন দেশের ভেতরে ঢুকছিলেন সীমান্তবর্তী বেতিয়ারা দিয়ে। দলটির নেতা ছিলেন তৎকালীন বুয়েটের ভিপি ও প্রথিতযশা কবি, কালজয়ী কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের পুত্র ইয়াফেস ওসমান। ডেপুটি কমান্ডার নিয়োগ করা হয়েছিল তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা নিজামুদ্দিন আজাদকে।

দুপুরের খাবার খেয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রাকে করে গেরিলারা রওনা দিলেন সীমান্তের দিকে। সন্ধ্যার দিকে সীমান্তের খুব কাছাকাছি এসে জঙ্গলের ভেতর সাময়িক অবস্থান নিলেন তারা। কিছুক্ষণ পর মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের শেষ সীমান্ত ভৈরব টিলায় এসে অবস্থান নিলেন; এটি বাংলাদেশের সীমান্ত গ্রাম বেতিয়ারার খুব নিকটেই অবস্থিত। এখানে অবস্থান নিয়ে টিম লিডার ইয়াফেস ওসমান প্রফেশনাল গাইডকে পাঠালেন রেকি করতে। ভৈরব টিলা থেকে নেমেই বেতিয়ারা গ্রাম। সেই গ্রাম ভেদ করে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। মহাসড়কের একপাশে জগন্নাথ দীঘি আর অন্যপাশে শর্শাদি নামক স্থান। পাকিস্তান বাহিনী এই দুই স্থানেই ঘাঁটি গেড়ে আছে। রাতের বেলা দুটো ঘাঁটি থেকে হানাদার বাহিনী জিপযোগে টহল দিয়ে থাকে। দুই টহল দলের মাঝে ৪৫ মিনিট সময় পাওয়া যায়। এই সুযোগেই গেরিলাদের মহাসড়ক পার হতে হবে।

গেরিলাদের লক্ষ্য হলো গুণবতী-নোয়াখালী ও চাঁদপুর হয়ে ঢাকায় পৌঁছানো। ইতোমধ্যে রেকি টিম থেকে খবর চলে এলো মহাসড়ক ফাঁকা, টহল টিমের অস্তিত্ব নেই; তৎক্ষণাৎ ইয়াফেস ওসমান ভৈরব টিলা থেকে গেরিলাদের মুভ করার সবুজ সঙ্কেত দিলেন। সতর্কতা হিসেবে দুটি অ্যাসল্ট পার্টি মোতায়েন করা হলো যেন আঘাত আসলে প্রত্যুত্তর দেয়া যায়। ভৈরবটিলা থেকে নেমে মুক্তিযোদ্ধারা সমতলের ক্ষেত-খামারের আইলের পথ ধরে এগুতে থাকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে সিঙ্গেল ফাইলে এগিয়ে যেতে থাকে গেরিলা দল। সবচেয়ে সামনে লোডেড স্টেনগান নিয়ে এগিয়ে চলেছেন ডেপুটি লিডার নিজাম উদ্দিন আজাদ। তার পরপরই অস্ত্র রেডি পজিশন নিয়ে কয়েকজন যোদ্ধা তাকে অনুসরণ করছে। তাদের পেছনে প্যাকিং করে অস্ত্রের বোঝা কাঁধে নিয়ে বাকি যোদ্ধারা সন্তর্পনে এগিয়ে চলেছেন। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে তখন নিজ মাতৃভূমি হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

বিজ্ঞাপন

কৃষক গেরিলা গ্রুপের লিডার নিজাম উদ্দিন আজাদ আবার পুরো টিমের ডেপুটি লিডার। তার নেতৃত্বে অগ্রগামী দলের সম্মুখে আছে এক স্কাউট বাহিনী। নিজাম উদ্দিন আজাদ সিভিলিয়ান গাইডকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলছেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। গ্রামের মেঠো পথ ধরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার বেতিয়ারা গ্রামের পাশ দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিএন্ডবি রোড পার হয়ে যাবে গেরিলারা- এটাই ছিল পরিকল্পনা। প্রফেশনাল গাইড ও রেকি টিমের ভাষ্য অনুসারে, তখন মহাসড়ক নির্বিঘ্ন থাকার কথা। অন্ধকারের জন্য সামনের পথ দেখা যায় না এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলছে গেরিলাদের দলটি। সতর্কতাস্বরূপ দলের চৌকস ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মহাসড়কের পূর্ব পাশে দুটি অ্যাসল্ট পার্টিতে বিভক্ত করা হলো। দুটি পার্টি ডানদিক ও বামদিকে কভার করবে। মাঝে সরু রাস্তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে গিয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবে। ডানদিকের বাহিনী ডানদিকের টহল জিপের আক্রমণ ঠেকাবে; বামদিকের বাহিনী ঠেকাবে বামদিকের আক্রমণ।

গেরিলারা গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরে পায়ে পা টিপে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাঁশঝাড় ও গাছগাছালীতে ভরপুর গ্রামের ভেতরটা মনে হচ্ছে রাতের অন্ধকার গিলে খাবে। জোনাকিরা আলো জ্বেলে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তাদের। প্রায় মূল রাস্তার কাছে চলে এসেছে মুক্তিযোদ্ধারা। আর মাত্র ২০ গজের মতো বাকি। অদূরে একটি কালভার্ট। এটা পার হলেই পাকা রাস্তা। পাকা রাস্তা পার হলেই গ্রামের পথ ধরে পূর্ব নির্ধারিত নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া যাবে।

মুক্তিযোদ্ধা দলটির সম্মুখে দুজন সিভিলিয়ান গাইড পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পেছনে কমরেড নিজাম উদ্দিন আজাদ এবং তার পেছনে বিশাল গেরিলা বাহিনী চোখ-কান খোলা রেখে এগিয়ে চলছে। গাইড দুজন গ্রামের পথ দেখিয়ে নির্ধারিত স্থানে নিরাপদে নিয়ে যাবে। যখনই গেরিলা দলের সামনের দুজন কালভার্টের উপর পা রাখলো, তখনই গর্জে উঠলো হানাদার বাহিনীর অস্ত্র। অ্যামবুশ বাহিনী ‘হল্ট’ বলে চিৎকার দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে পুরো দলের উপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। সর্বনাশ! পাকবাহিনী তাদের ইন্ডাকশনের আগাম খবর পেয়ে গেছে!

সামনে থাকা কমরেড আজাদ সঙ্গে সঙ্গে তার স্টেনগান থেকে পাল্টা ফায়ার ওপেন করলেন। তার স্টেনগান গর্জে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খোলা অস্ত্র বহনকারী অন্য গেরিলারাও ফায়ারিং শুরু করে দিল। বিভ্রান্ত হয়ে গেল দুই দিকে মুখ করা দুটি অ্যাসল্ট বাহিনীর সদস্যরা। উপায় না দেখে যোদ্ধারা বুদ্ধি করে গুলির উৎসের দিকে এলএমজির ব্রাশফায়ার শুরু করে দিল। গেরিলারা অন্ধকারের মধ্যে ক্ষেতের আইলের পেছনে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করতে থাকে। পাক হানাদার বাহিনীর দূরে জগন্নাথ দীঘি এলাকা থেকে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর উপর্যুপরি হামলা করতে থাকে। প্রচন্ডভাবে গুলি আসতে থাকে তিন দিক থেকে। এই অবস্থায় কোনো রকমে ‘রিট্রিট’ বলে চিৎকার দিয়ে সবাইকে ক্রল করে পেছনে ফিরে আসতে বলা হলো। পেছনের সহযোদ্ধা, কমরেড, সাথীরা যেন নিরাপদে পিছু হটতে পারে সেজন্য সম্মুখের অস্ত্র বহনকারীরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুলি চালিয়ে যেতে লাগল।

সবার সামনে অবস্থান নেয়া নিজামুদ্দিনের স্টেনগান একসময় থেমে যায়। পাকিস্তানি মিলিটারি নিজামুদ্দিনকে ধরে ফেলে। হানাদার অফিসারদের সাথে নিজামুদ্দিনের ইংরেজিতে তর্ক-বিতর্ক হয় এবং পাকসেনারা তাকে হত্যা করে। শত্রুর প্রচন্ড আঘাতের পরও পেছনের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা ক্রলিং করে প্রাণ নিয়ে পিছু হটতে সক্ষম হয়। এরকম অ্যামবুশে দলের প্রায় সকলেরই প্রাণ হারানোর কথা। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলে সেদিন।

গোলাগুলি একপর্যায়ে থেমে যাওয়ার পর পাকবাহিনী পাশের ধানক্ষেতে অবস্থান নেয়। টর্চ লাইট জ্বালিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে আনে যুদ্ধাহত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের। সেদিন বেতিয়ারার ঘটনাস্থলেই ছয়জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, এবং তিনজনকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে পরবর্তীতে নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানি আর্মির ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানা যায়নি।

১১ নভেম্বর ১৯৭১ বেতিয়ারায় পাক-হানাদার বাহিনীর অ্যামবুশের পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এপার-ওপার প্রচন্ড শেলিং শুরু হয়। উভয়পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে জীবিত ও আহত যোদ্ধারা পিছু হটতে থাকেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা একে একে ফিরে আসতে থাকেন তাদের সীমান্তের মিটিং পয়েন্টে। একজন গেরিলাও তার অস্ত্র ফেলে আসেননি। প্রত্যেকেই বিধ্বস্ত, কিন্তু মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় অমিত তেজে দীপ্ত। এ ধরনের ঘটনায় দল থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রচুর ঘটে থাকে। কিন্তু বেতিয়ারায় এমন ঘটনা ঘটেনি। অপরিচিত ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আচমকা হামলার মুখেও কীভাবে এত সংখ্যক গেরিলা যোদ্ধা আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন এবং কীভাবে মিটিং পয়েন্টে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, তা ছিল সত্যিই এক বিস্ময়। পরবর্তীতে কয়েক সপ্তাহ পর গেরিলাদের দলটি পুনরায় সাহস ও শক্তি সঞ্চয় করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

বেতিয়ারা যুদ্ধে শহীদদের পরিচিতি —

০১) শহীদ নিজাম উদ্দিন আজাদ

শহীদ নিজাম উদ্দিন আজাদ, ঢাকাস্থ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি একসময় ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। কলেজ ছাত্রাবস্থায় নিজ মেধা ও যোগ্যতায় অল্পদিনেই সংগঠনের নেতৃত্বের প্রথম সারিতে উঠে আসেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি সংগঠনের ঢাকা জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।

সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রাবস্থায় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক আসে। সব কিছু পেছনে ফেলে তিনি এগিয়ে যান সামনে। যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা বাহিনীতে। যৌথ গেরিলা দলের যোদ্ধাদের রক্ষার জন্য বেতিয়ারায় অস্ত্র হাতে সবার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। অসীম সাহসী এই বীরের রক্তে বাংলার মাটি সেদিন রঞ্জিত হয়েছিল।

০২) শহীদ বশির মাস্টার

মো. বশিরুল ইসলামের জন্ম ১৯৪৯ সালে। শহীদ বশির ১৯৬৪ সালে ঢাকা গভ. মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএসসি পাশ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি সেন্ট্রাল ল কলেজে আইনের প্রথম পর্বের ছাত্র ছিলেন। তিনিও বেতিয়ারায় পাকসেনাদের সাথে গেরিলা বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।

০৩) শহীদ সিরাজুম মুনীর জাহাঙ্গীর

শহীদ মো. সিরাজুম মুনীর জাহাঙ্গীর ১৯৭১ সালে এমএ শেষ পর্বের ছাত্র ছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা মহানগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরে ঢাকা জেলা কৃষক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেশমাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্বে বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন। শহীদ মো. সিরাজুম মুনীর জাহাঙ্গীর সাহিত্য চর্চা করতেন। ১৯৭১ সালে তার ছোট গল্প ‘শিল্পী’ প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সিরাজুম মুনীরের দাদী, ফুপা. ফুপু এবং ফুপাতো ভাইবোনসহ মোট ৯ জন সৈয়দপুরে শহীদ হন।

০৪) শহীদ শহীদুল্লাহ্ সাউদ

২ নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলের কর্মচারী মো. জাবেদ আলী সাউদ ও মোসাম্মৎ জাবেদা খাতুনের চার সন্তানের মধ্যে শহীদুল্লাহ সাউদ ছিলেন তৃতীয়। গোদানাইল প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ভর্তি হন গোদানাইল হাই স্কুলে। এরই মধ্যে তিনি জড়িয়ে যান ঝিলিমিলি খেলাঘর আসরের সাথে। স্কুলজীবন থেকেই তিনি ছাত্র ইউনিয়ন শুরু করেন। শহীদুল্লাহ সাউদ যখন ক্লাস নাইনের ছাত্র তখন শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মাত্র ১৪ বছর বয়সে দেশকে ভালোবেসে তিনি যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধে যাওয়ার পরেও বাড়ির সাথে তার যোগাযোগ ছিল। তিনি বাড়ির সবাইকে কেবলই জানাতেন, ভাল আছি, কাজ শেষ হলেই ফিরব। অসীম সাহসে লড়াই করতে করতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারায় আরো ৮ জন সহযোদ্ধার সাথে তিনিও শহীদ হন।

০৫) শহীদ আব্দুল কাইউম

শহীদ আব্দুল কাইউম, পিতা- মৃত ছানাউল্লাহ মিয়া, মাতা- মৃত হালিমা খাতুন, গ্রাম- চর শোলাদি, থানা- হাইম চর, জেলা- চাঁদপুর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ শিক্ষার্থী ছিলেন। দেশমাতৃকার ডাকে তিনি গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন। বেতিয়ারার অন্যান্য শহীদের সাথে তিনিও পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন।

০৬) শহীদ আওলাদ হোসেন

শহীদ আওলাদ হোসেনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনাচড়া গ্রামে। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এসসির ছাত্র। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ১৯৭১ সালে বেতিয়ারায় সম্মুখ সমরে শহীদ হন।

০৭) শহীদ আব্দুল কাদের

কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী স্টেশনের নিকটবর্তী সাতবাড়িয়া গ্রামের সন্তান আব্দুল কাদের। ১৯৭১ সালে তিনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এসময় তিনি ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের অভ্যন্তরে রণক্ষেত্রে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীকে স্বদেশে পৌঁছে দেয়ার সময় কুমিল্লার বেতিয়ারায় পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ সমরে শহীদ হন।

০৮) শহীদ মোহাম্মদ শফিউল্লাহ

নোয়াখালীর সাহসী সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শফিউল্লাহ, প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি প্রতিরোধ সংগ্রমে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসেন এবং নিজ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলেন। মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য তিনি গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে এই বীর দেশপ্রেমিক বেতিয়ারায় শহীদ হন।

০৯) শহীদ জহিরুল হক ভুঁইয়া (দুদু মিয়া)

কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়া শহীদ জহিরুল হক ভুঁইয়া (দুদু মিয়া) অল্প বয়সেই তার বাবাকে হারান। জীবিকার্জনের তাগিদে তিনি শৈশব থেকেই কৃষিকাজ করতেন। কিছুদিন কোহিনুর জুট মিলে কাজ করার সময় তিনি শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন। পশ্চিমা শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের কথা, শ্রমিক নেতাদের বক্তব্যে শুনে তার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তাই পরবর্তীতে রায়পুরা থানার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতেন।

জহিরুল হক ভুঁইয়া অত্যন্ত পেশিবহুল এবং সুঠামদেহী ছিলেন। তিনি বেতিয়ারায় বিশেষ গেরিলা বাহিনীর অগ্রগামী গেরিলা দলের সদস্য ছিলেন। পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে তিনিও শহীদ নিজামউদ্দিন আজাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর বিপক্ষে প্রতিরোধ ব্যূহ রচনা করে নিজের সহযোদ্ধাদের নিরাপদে পশ্চাদপসরণের সুযোগ করে দেন। শত্রুবাহিনীর সাথে হাতাহাতি যুদ্ধের একপর্যায়ে শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যান। শত্রুরা তাকে উর্দুতে বলতে বলেছিলেন, “বোলো, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’।” দুদু মিয়া উচ্চস্বরে বলেছিলেন, “জয় বাংলা।”

সূত্র:
১. বেতিয়ারা সংকলন প্রকাশ: ১১ই নভেম্বর ২০১১; সম্পাদক: মো: জিয়াউল হোসেন
২. বেতিয়ারা শহীদ স্মৃতি; লেখক: শেখর দত্ত
৩. বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে

সারাবাংলা/এসবিডিই

চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারার ৯ শহীদ