পর্ব- ১০ শিউলিতলার পাশে পাশে !
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৫:৫৬
ঝিম ধরা হালকা কুয়াশা। ভোরবেলার পড়া শেষ করবার পর স্কুলে যাওয়ার আগেই শিউলি কুড়ানোর দিনগুলো, ঘুরে ঘুরে আসে মনে। আমার বয়সী যারা, তাদের বেশিরভাগই জীবনের মধ্যবর্তী বয়সে এসে স্মৃতিচারণে ডুব দিতে ভালোবাসেন। যত বয়স বাড়ে ততই বাড়তে থাকে ডুব দেয়ার সময়। বিশেষ করে যে মূহুর্তগুলো আর ফিরে আসবার নয়, সেগুলোর স্মৃতি হানা দেয় বারবার।
শহরেই জন্ম, বেড়ে ওঠা। জীবন পার করছি। তারপরও শিউলি গাছ নেই তেমন বাসা ছিল না এই বেড়ে উঠবার সময়ে। তখন ঢাকায় একতলা বাড়ির আধিক্য ছিল। দোতলা কম। সামনে ছোট হলেও উঠান নাহলে ঘাসে ঢাকা লন থাকতো। রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে গেলে কিছু দূর পরপরই শিউলি গাছ দেখা যেতো বাড়ির আঙিনায় অথবা কখনও দেয়াল ঘেসে। শিউলি ফোঁটার দিনগুলোতে ভোর সকালে ফুলের বিছানা হয়ে থাকতো গাছের গোড়ার আশপাশ। রোদ উঠবার আগেই ফুল কুড়ানোর পাল্লা লাগতো আমাদের। ফ্রকের কোচড় ভরে শিউলি নিয়ে যখন বাসায় ফিরতাম, সাদা জামাগুলোতে ফুলের ডাঁটির কমলা রঙের ছোপ দেখতেই বকা খেতাম খুব।
শেফালী নাম হলেও শিউলি নামেই পরিচিত সবার কাছে এই ফুল। উঠোনের কোনো এক কোণে নীরবে নিভৃতে শরৎ শিশিরের ভোরে সাদাফুল আর কমলা ডাঁটা নিয়ে ঝরে পড়তে পড়তে নিজস্ব অবস্থানের কথা জানান দেয় শিউলি গাছ।
অত্যন্ত কোমল ফুল শিউলি, তাই রোদ উঠবার সাথে সাথে নেতিয়ে যায়। প্রায় আড়াই বছর হয়েছে নার্সারি থেকে একখানা শিশু শিউলি গাছ দত্তক এনেছিলাম ছাদবাগান পরিবারে। মোটে দুটো ডাল নিয়ে এসেছিল সে। মাঝারি ড্রামে দুইভাগ জৈবসার আর দুইভাগ মাটি মিলিয়ে তার বাসস্থানের জায়গা করা হয়েছিল। দেড় থেকে দু’মাসের মাঝেই তরতরিয়ে সবুজ পাতা ভরা ডালাপালা মেলে লম্বা হয়ে গিয়েছিল সে। একজন বলেছিল, এটা তো হাইব্রিড শিউলি, দেশি নয়। আমি উত্তর দিয়েছিলাম, এগারো তলার ছাদে ড্রামের মাটিতে বোনা শিউলি গাছে ফুল ফুটবে তাতেই খুশি।
ঠিক শরৎ আসবার আগেই সবুজ কুঁড়ির এক থোকা থেকে ভোরসকালে প্রথম একজনের সাথে দেখা হয়ে যায় আমার। অপরূপ স্নিগ্ধতা গায়ে জড়িয়ে মৃদু ঘ্রাণ ছড়িয়ে দুলছিল। সে বছর একটা দুটো করে শিউলি ফুটেছিল তিন চার মাস। অপেক্ষায় ছিলাম কবে কোঁচড় ভরে শিউলি কুড়াবো তাই। শিউলি গাছের বাড়তি ডালপালা বছরে দুই থেকে তিনবার ছেটে দেয়া ভালো। বিশেষ করে যে ডালগুলোতে ফুল ফোটা শেষ হয়ে বীজ শুকনো হতে আরম্ভ করে। খেয়াল করে করে যত ছেটে ফেলে দিবেন তত নতুন ডাল গজাবে, ফুলের কুঁড়িসহ। আর হাইব্রিড হওয়াতে সারা বছরই টুকটুক করে শিউলি ফুটে থাকে।
শিউলি গাছে যত্ন বলতে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় খাবার তার- জল। প্রতিদিন একবার জল দিতে হলে টইটুম্বুর করে দেয়া লাগবে। বছরে একবার ড্রামের আধ হাত মাটি সরিয়ে নিয়ে, সেটুকুতে জৈবসার দিয়ে ভরে দিলে শক্তি পায় ভালো। পোকামাকড় তো হবেই। তবে এ গাছে ছাই হিসেবে কীটনাশক কাজে লাগে না। কখনও যদি মনে হয় গাছে পোকা হচ্ছে তখন যথার্থ কীটনাশক দরকার হয়ে পরে। আমার শিউলি গাছে এখন পর্যন্ত কোন পোকার আক্রমণ হয়নি। হয়তো জল দেয়ার সময় তাকে আমি খুব ভালো করে স্নান করিয়ে দেই, তাই।
এ বছরে পরিপূর্ণ মনে ছাদ থেকে শিউলি কুড়ানোর আনন্দ উপভোগ করেছি। ছেলেবেলার মতন আঁজলা ভরা শিউলি সামনে নিয়ে সাথে এক কাপ কফিতে দিনের শুরু, আর কিছু দরকার? একেবারেই না। তবে ফুলের কমলা বোঁটাগুলো দিয়ে সেই ছোট্টবেলার মতন সাদা রুমাল রাঙানো হয়নি এখনও। হয়ে যাবে আগামীবার। আপনার ছাদবাগানে একটা কোনা হয়তো খালি পড়ে আছে। হয়ে যাক শিউলি ফুলের চাষ। আগামী বছরের মাঝে দুই হাত হাত ভরতি শিউলি ফুলের সাথে আমার কথা মনে হবে নিশ্চিত। চাষী পরিবার, সুখী পরিবার।
সারাবাংলা/এসএস