Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফেসবুকে দেখে বা প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ভয়াবহতা


৩ জুন ২০২০ ১৪:৪৫

মনে রাখতে হবে, যেকোনো রোগেরই বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা আছে। আর বিজ্ঞান নির্ভর করে গবেষণার উপর। কোনো গবেষণার ফলাফল ছাড়া যেকোনো ধরনের চিকিৎসাকে উৎসাহিত করা যেকোনো পর্যায়ে তো বটেই মহামারির সময় ভীষণ অনৈতিক।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে সিফিলিসের চিকিৎসায় আর্সেনিকের ব্যবহার, এরপর তিরিশের দশকে সুকেজি ট্রায়ালে পেনিসিলিন আবিষ্কারের পরও সিফিলিসের চিকিৎসায় সেটা না দেওয়া ছিল এধরনের অনৈতিক কাজ।

বিজ্ঞাপন

১৯৯৭ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন সেই সুকেজি ট্রায়ালে বেঁচে যাওয়া একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের কাছে এই অনৈতিক গবেষণার জন্য প্রায় ৭৫ বছর পর আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আর কেবল নিজের ধারণার উপর বিশ্বাস করে দেওয়া আর্সেনিক যে বিষ তা আজ সবাই জানে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি ‘গবেষক’ (?) গণ উচু জায়গায় মানুষ কতটুকু শ্বাস নিতে পারে, চোখের ভেতর ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে রঙ পুশ করে চোখের রঙ পরিবর্তন করা যায় কিনা, একজনের দেহের সঙ্গে আরেকজনকে সেলাই করে দেওয়া যায় কিনা; জাতীয় অমানবিক গবেষণা করে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মুখোমুখি হয়েছিলেন।

একশ বছর পরেও হেলসিংকি ডিক্লারেশন, মেডিকেল এথিকস ইত্যাদি না মেনে কেবল ব্যবসায়ি স্বার্থে নিজের প্রচার আর প্রসারের জন্য বিভিন্ন ধরনের অপ্রমাণিত চিকিৎসার ডামাডোল বাজানো বিশ্বজুড়ে চলছেই কমবেশি। আর যত বড় বাজার ততবেশি অনৈতিক প্রচার। এই করোনা মহামারিতে বিশ্বের ষাট লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত। তাই এর বাজারটাও বড়। আর তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ওষুধ কোম্পানির অর্থায়নে একটি ওষুধের তথাকথিত সফল গবেষণা এখন নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মহামারি পর্যায়ে এই ধরনের অপ্রমাণিত ওষুধের প্রচারণা বেশি করলে প্রথমত যেটা হয় সেটা হলো- ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কারও কোন ক্ষতি হলেও সেটা মহামারি সৃষ্ট ক্ষতির সঙ্গে আলাদা করা যায় না। আর মূল ধারার গণমাধ্যম নিজেদের অজ্ঞতার জন্য আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেবল সস্তা প্রচারের জন্য “অবিস্মরণীয়”, “অবিশ্বাস্য” বা “শূণ্যে নামিয়ে আনার” বিজ্ঞাপন দেওয়া হলে সাধারণ মানুষ তো বিভ্রান্ত হবেই সঙ্গে সঙ্গে তরুণ আর নবীন চিকিৎসকরাও বিভ্রান্ত হবেন। আর অনেক মানুষ যখন একসঙ্গে একটি ভুল কাজ করতে থাকেন সেটাতে আরও বহু মানুষ সংযুক্ত হয়ে সেটাকে সমর্থন করে। মনোবিজ্ঞানে এটিকে বলা হয় কনফরমিটি। এই কারণে বহু চিকিৎসকও এই অপ্রমাণিত ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন যেটা এখনো কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় প্রমাণিত নয়।

‘ট্রায়াল’ একটি বৈজ্ঞানিক শব্দ। আমার মনে হয়, আমি দেখেছি- সেটা ক্লিনিকাল অবজারভেশন। সেটা ট্রায়াল নয়। ট্রায়ালের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলতে হয়। মহামারী পর্যায়ে আবার এত ‘নীতি ফিতি’ কি; যারা বলেন তারা কিন্তু জানেন না ক্ষতি কোথায় কোথায় হচ্ছে। একটা হচ্ছে ওষুধের যদি কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে সেটার ক্ষতি, আরেকটা হচ্ছে এই ওষুধ ভালো কাজ করে এরকম একটি ভুল ধারণা তৈরি হয়ে গেলে সত্যিকারের ভালো কাজ করার ওষুধ তৈরির উৎসাহ, আগ্রহ হারিয়ে যাবে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় মনোজগতে।

মানুষ কিছু চিকিৎসকের ব্যক্তিগত প্রচার আর প্রসারের লালসা আর কিছু চিকিৎসকের নৈর্ব্যক্তিক ভূমিকার কারণে অপ্রমাণিত ওষুধের পেছনে মরিয়া হয়ে ছুটছে। ফলে কোভিড-১৯ এর প্রমাণিত কার্যকরী চিকিৎসা- অক্সিজেন আর লো মলিকুলার হেপারিন থেকে যাচ্ছে পাদপ্রদীপের অন্তরালে। সহস্র কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০ হাজার টাকা দামের ওষুধের বদলে ঐ টাকায় যদি কিছু জেলা পর্যায়ের হাসপাতালেও অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানো যেত তবে সম্ভবত উপকার আরও বেশি হতো।

পাঁচ তারকা হোটেলে ওষুধ কোম্পানির স্পন্সরে সাকসেস স্টোরি আর ওষুধের গুণ গরিমা গেয়ে সংক্রমণ শূণ্যে নামিয়ে আনার ক্যানভাস না করে যদি সত্যিকারের পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশ করতেন তাহলে বিশ্ববাসী তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকতো।

সত্যিকারের পিয়ার রিভিউড বলছি কারণ, আমি বিগত কয়েক বছর বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের রিসার্চ একটিভিটি কমিটির সদস্য হিসেবে জানি বিশ্বজুড়ে দুষ্টু পিয়ারেরা কিছু দুষ্টু জার্নাল বের করেন যেগুলো আসলে গবেষক-পাঠক সকলকে প্রতারিত করে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে কোভিড-১৯ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই মোটেই, নই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে শুধু এটুকু জানি যে, যেকোনো চিকিৎসায় কোনো স্বীকৃত গবেষণালব্ধ প্রমাণিত বিষয়কে অনুসরণ করতে হবে। মহামারির সময় আরও বেশি। কারণ, এখন গবেষক-চিকিৎসক-রোগী সবাই আতংকিত, হতবিহ্বল। তাই “আমার মনে হয়” “আমি দেখেছি” জাতীয় আত্মগরিমা থেকে বের হয়ে এসে যেকোনো প্রমাণিত সত্যকে অনুসরণ করার বিকল্প নাই।

আপনি বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থাকে অপছন্দ করেন তাহলে সিডিসি’র গাইডলাইন মানুন, সিডিসিকে পছন্দ করেন না, এফডিএকে মানুন, এফডিএকে মানেন না, যুক্তরাজ্যের এনএইচএসকে অনুসরণ করুন। কিছুই মানেন না তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় গাইডলাইন মানুন। জাতীয় গাইডলাইনে নাই সেটার ক্যানভাস করলে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হবে, বিভ্রান্ত হবে। আর যদি সত্যিই প্রকৃত গবেষণা আর ট্রায়াল করে প্রমাণ করা যায় যে ওমুক ওষুধ, তমুক ওষুধ ভালো কাজ করে তবে তা যথাযথভাবে বিজ্ঞানসম্মত সাময়িকীতে প্রকাশ করে জাতীয় গাইডলাইনকে পরিবর্তন করুন, সমৃদ্ধ করুন। দেশবাসী আর বিশ্ববাসীকে কৃতজ্ঞ করুন।

এন্টিবায়োটিক ব্যবহার এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ভয়াবহতা করোনা মাহামারি মহামারি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর