বৈশ্বিক উষ্ণতার বলি হচ্ছে যেসব পর্যটনকেন্দ্র।। ০১
২১ আগস্ট ২০২০ ১৬:৩১
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার ফলে একদিকে যেমন গলে যাচ্ছে হাজার বছর ধরে জমে থাকা আইস ক্যাপ আর অন্যদিকে দাবানলে ছাই হয়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল বনাঞ্চল। এর ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে কমে যাচ্ছে স্থলভাগের পরিমাণ। এমন অবস্থায় বদলে যাচ্ছে বিশ্বের ভূপ্রকৃতির গড়ন ও গঠন। অতিরিক্ত বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে পানির শহর ভেনিসে দেখা দিচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, আল্পসে কমে যাচ্ছে বরফপাত, ফলন কমছে ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত আঙুরক্ষেতগুলোতে। এমনকি পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাড়িয়েছে বিখ্যাত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। আসুন দেখে নেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে কোন কোন বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র বদলে যাচ্ছে বা বিলীন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আজ প্রথম পর্বে রইলো এমন নয়টি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রের কথা।
১. দ্য গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ, অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্ব সমুদ্র তীরে প্রায় চৌদ্দশ মাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই কোরাল রিফ। প্রতিবছর কয়েক মিলিয়ন ডুবসাঁতারু আর স্কুবা ডাইভার ভ্রমণ করে বিখ্যাত এই পর্যটনকেন্দ্র।
কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে মরে যাচ্ছে এখানকার কোরাল। তারা দিনে দিনে সাদা হয়ে যাচ্ছে। এভাবে বদলে যাচ্ছে ওই এলাকার ভূ-প্রকৃতির স্বাভাবিক গঠন। চলতি বছর গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ ফাউন্ডেশন এই জরিপ পরিচালনার পর জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে প্রায় এক তৃতীয়াংশ কোরাল মারা গেছে এই এলাকায়। এভাবে চলতে থাকলে খুব দ্রুতই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে চমৎকার এই পর্যটনকেন্দ্র।
২. ভেনিস, ইতালি
খালের শহর ভেনিস। বিশ্বের অন্যতম রোমান্টিক এই শহরজুড়ে একেবেকে জড়িয়ে থাকা খালে বয়ে চলে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের জল। এইসব খালে গন্ডোলায় ভেসে বেড়ানো অন্যতম চমৎকার অভিজ্ঞতা।
কিন্তু সম্পতি এই শহরের পিয়াজ্জা, স্যান মার্কোসহ অন্যান্য নিম্নাঞ্চলে দেখা যাচ্ছে বন্যা। আর সাগরের জল বেড়ে যাওয়ায় ভেনিসের উপরও পড়ছে বিরূপ আর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাধসহ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে স্বর্গীয় ভেনিসকে রক্ষার জন্য।
৩. গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক, মন্টানা
আমেরিকা ও কানাডার সীমান্ত এলাকার কয়েক মিলিয়ন এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে এই গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক। নানারকম জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই পার্কে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ ঘুরতে যায়। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই এই পার্কে তিরিশ লাখ পর্যটন ভ্রমণ করে।
কিন্তু বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে বিরূপ প্রভাব পড়ছে এখানকার বিপুল প্রাণজগতে। কয়েক হাজার রকমের গাছ ও কয়েকশ প্রজাতির প্রাণির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। তবে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে এই পার্কের বিশাল বিশাল গ্লেসিয়ার বা হিমবাহগুলো। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে গলতে শুরু করেছে এইসব হিমবাহ। ১৯৬৬ সালের পর অন্তত ৮৫ শতাংশ গ্লেসিয়াররের পরিমাণ কমে গেছে যা কমার কোন লক্ষণ নাই। এভাবে গলতে থাকলে এই শতক শেষ হতে না হতেই পুরো পার্কের ইকোসিস্টেম পুরোপুরি বদলে যাবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে অপূর্ব সুন্দর গ্লেসিয়ার পার্ক।
৪. দ্য ডেড সি
সাগরপৃষ্ঠ থেকে ৪৩০ মিটার নিচে অবস্থিত লবণাক্ত এই সাগর পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নতম ভূমি। এতটাই লবণাক্ত এই সাগরের পানি যে এখানে কোন প্রাণী বা উদ্ভিদ বাঁচে না। এই কারণেই একে ডেড সি বা মৃতসাগর বলে। এই সাগরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ- এখানে কিছু ডোবে না। লবণের কারণে এর ঘনত্ব এতটাই বেশি যে মানুষ ইচ্ছামত ভেসে থাকতে পারে। পর্যটকদের কাছে এটিই এর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
কিন্তু এই সহস্রাব্দের শুরুর দিকে উন্নয়ন কাজ শুরু হওয়ার ফলে বছরে তিন ফিট করে কমে যাচ্ছে এর আকার। বাঁধ গড়া, জলাধার তৈরি এবং পাইপলাইন বসানোর জন্য কয়েক বছরে এর পানির লেভেল অন্তত পাঁচ শতাংশ নেমে গেছে। এছাড়াও ধারণা করা হয়, মৃতসাগরের জলে নিরাময় গুণ আছে। ফলে প্রসাধন প্রতিষ্ঠানগুলোও এখান থেকে জল আরোহন করে। এভাবে শুকিয়ে যেতে থাকলে ২০৫০ নাগাদ ডেল্টা সি পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
৫. দ্য অ্যামাজন
পৃথিবীর ফুসফুস বলে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্ট ব্রাজিলের বিখ্যাত অ্যামাজন। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৪০ শতাংশ ভূখণ্ডজুড়ে বিস্তৃত এই বন স্থলজ ও জলজ জীববৈচিত্র্যের আঁধার। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র এটি।
কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবে বদলে যাচ্ছে এর ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। দুর্লভ সব প্রাণের নিরাপদ এই আশ্রয়স্থল হারিয়ে ফেলছে তার বৈচিত্র্য। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষরা কমিয়ে দিচ্ছে জঙ্গলের আকার। সেই সঙ্গে প্রায়ই দেখা দিচ্ছে ভয়ানক সব দাবানল।
৬. ইয়ামাল পেনিনসুলা, রাশিয়া
রাশিয়ার একদম উত্তরে অবস্থিত ইয়ামাল পেনিনসুলার আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে দ্রুত। কমে যাচ্ছে এই বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলের শীতকালের দৈর্ঘ্য। ফলে গলতে আরম্ভ করেছে বরফ। এর ফলে সেখানকার জীববৈচিত্রেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
২০১৩ সালের শীতকালে এখানে এতটাই গরম পড়ে যে এখানে বৃষ্টি নামে ও পরে সেই পানি জমে পুরু বরফের শক্ত স্তর গঠন করে। এর ফলে খাদ্যসংকটে পড়ে ওই এলাকার রেইনডিয়ার। পুরু বরফ খুড়ে খাবার খোঁজা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাদের জন্য। ফলে প্রায় দশ হাজার জন্তু না খেয়ে মারা যায়। বিজ্ঞানীরা হুশিয়ারি দিয়েছেন বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্যে ভয়ানক প্রভাব পড়বে। ফলে মারা যাবে আরও প্রাণী। সংকটে পড়বে স্থানীয় আদিবাসিরা।
৭. মালদ্বীপ
ভারত মহাসাগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দক্ষিন এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্র। মূলত কোরাল গঠিত ছোট ছোট দ্বীপের সমষ্টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। সারাবছরই এখানে ৮১ থেকে ৮৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকে যা একে করে তুলেছে অত্যন্ত মনোরম।
এটিই বিশ্বের সবচেয়ে নিচু দেশ যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১.৩ মিটার উচ্চে অবস্থিত। সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার ফলে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে এদেশের অনেকটা অংশ। ইতোমধ্যেই স্থানীয় অধিবাসিদের অনেকের বাসস্থান ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এখনই বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমাতে যথাযত উদ্যোগ না নেওয়া হলে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাবে চমৎকার এই দ্বীপরাষ্ট্র।
৮. কি ওয়েস্ট, ফ্লোরিডা
আর্নেস্ট হেমিংওয়ের জন্মস্থান ফ্লোরিডার এই ছোট্ট শহরটি তার প্যাস্টেলরঙা সারবাধা বাড়ির জন্য বিখ্যাত।
২০১৭ সালে হারিকেন ইরমার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় চমৎকার এই শহরটি। তবে তার আগে থেকেই বৈশ্বিক আবহাওয়া বদলের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল এই শহরে। আগামি ৩০ বছরের মধ্যে ফ্লোরিডার সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাবে অন্তত ১৫ ইঞ্চি যার ফলে দেখা দেবে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। ফলে হারিয়ে যেতে পারে সুন্দর এই শহর।
৯. দ্য রোন ভ্যালি, ফ্রান্স
ফ্রান্সের দক্ষিণে অবস্থিত এই উপত্যকায় বিশ্বের সবচেয়ে ভালো মানের ওয়াইন তৈরি হয়। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত অপূর্ব এই ভূখণ্ডে ১২০ মাইল দৈর্ঘ্য বিস্তৃত করে রয়েছে আঙুরক্ষেত। পর্যটকরা ইচ্ছামত ঘুরতে ও নানারকম ওয়াইনের স্বাদ নিতে পারেন এই এলাকায়।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এই এলাকায় আঙুরের উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে যা কমিয়ে দিচ্ছে ফলন। এতে ওয়াইন উৎপাদকেরা বিপদে পড়ছেন। বাধ্য হচ্ছেন তুলনামূলক ঠাণ্ডা এলাকায় যেতে। এভাবে হারিয়ে যাওয়ার মুখে চমৎকার এক পর্যটনকেন্দ্র।
সূত্র- কন নাস্ট (Conde Naste Traveler)
বৈশ্বিক উষ্ণতার বলি হচ্ছে যেসব পর্যটনকেন্দ্র।। ০২
আরও পড়ুন,
বিশ্বের সেরা ১০ বইয়ের শহর (১ম পর্ব)
বিশ্বের সেরা ১০ বইয়ের শহর (২য় পর্ব)
ইয়ামাল পেনিনসুলা কি ওয়েস্ট গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক টপ নিউজ দ্য অ্যামাজন দ্য গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ দ্য ডেড সি দ্য রোন ভ্যালি পর্যটনকেন্দ্র ফ্লোরিডা বৈশ্বিক উষ্ণতা ভেনিস মালদ্বীপ রাজনীন ফারজানা সারাবাংলা বেড়ানো