বৈশ্বিক উষ্ণতার বলি হচ্ছে যেসব পর্যটনকেন্দ্র।। ০২
২৮ আগস্ট ২০২০ ২২:১৩
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে একদিকে যেমন গলে যাচ্ছে হাজার বছর ধরে জমে থাকা আইস ক্যাপ, অন্যদিকে দাবানলে ছাই হয়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল বনাঞ্চল। ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে, কমে যাচ্ছে স্থলভাগ। এমন অবস্থায় বদলে যাচ্ছে বিশ্বের ভূপ্রকৃতির গড়ন ও গঠন।
অতিরিক্ত বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে পানির শহর ভেনিসে দেখা দিচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, আল্পসে কমে যাচ্ছে বরফপাত, ফলন কমছে ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত আঙুরক্ষেতগুলোতে। এমনকি পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাড়িয়েছে বিখ্যাত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। আসুন দেখে নেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে কোন কোন বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র বদলে যাচ্ছে বা বিলীন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। প্রথম পর্বের পর আজ রইল বাকি নয়টি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রের কথা।
১০. মুম্বাই, ইন্ডিয়া
প্রায় দুই কোটি বাসিন্দার শহর মুম্বাই, বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর। ভারতের পশ্চিম উপকূলে আরব সাগরর তীরবর্তী এই শহর ভারতের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।
এখানেই অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান বলিউড। তবে শহরের একটা বড় অংশের বাসিন্দা বস্তিবাসী যারা শহরের উপকূলবর্তী নিচু এলাকায় বাস করে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। ধরা হচ্ছে এই গতিতে উষ্ণতা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ পানির উচ্চতা বেড়ে অন্তত দুই ইঞ্চি। ফলে মুম্বাইর উপকূলবর্তী অঞ্চল বছরের একটি বড় সময় ধরে বন্যার মুখোমুখি হবে।
১১. দ্য আল্পস
ইউরোপের প্রায় আটটি দেশজুড়ে বিস্তৃত দ্য আল্পস পর্বতমালা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। সাদা বরফে ঢাকা পর্বশৃঙ্গে স্কি করার জন্য প্রতি বছর কয়েক কোটি পর্যটক এখানে ভ্রমণ করে।
কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে বরফে আচ্ছাদিত এই পর্বতমালায়। কমে যাচ্ছে এখানকার শীতকালের ব্যপ্তি। ২০১৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনের এক রিপোর্টে দেখা যায় ১৯৬০ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে এখানে শীতকালের ব্যপ্তি কমেছে ৩৮ দিন। এমনকি বিজ্ঞানিরা সতর্ক করেছেন, এই শতক শেষ হতে হতে আল্পসের বরফ দেখতে হলে দশ হাজার পদক্ষেপ উপরে উঠতে হবে। ইতোমধ্যে অনেক রিসোর্টে স্পা, টেনিস ও ঘোড়ার পিঠে চড়ার মত গ্রীষ্মকালীন বিনোদন চালু করেছে।
১২. নাপা ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়া
ফ্রান্সের রোন ভ্যালির মতই ওয়াইন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ক্যালিফোর্নিয়ার নাপা ভ্যালি। ১৮৫৯ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ওয়াইন উৎপাদন শুরু হয় এখানে।
তারপর থেকেই পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষন এই এলাকা। অন্তত হাজারখানেক বাণিজ্যিকভাবে ওয়াইন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে এখানে। সেইন্ট হেলেনা পর্বতের উপত্যকায় বিস্তৃত আঙুরক্ষেত আর ওয়াইনারি মিলিয়ে অপরূপ এখানকার দৃশ্যপট। বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার ফলে এখানকার আঙুর উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অতিরিক্ত গরমের কারণে প্রভাব পড়েছে ভালো মানের ওয়াইন প্রস্তুতকরণেও।
১৩. রিও ডি জেনিরো, ব্রাজিল
পরিবেশবিদদের মতে দক্ষিণ আমেরিকার শহরগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এভাবে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে এই শহর ঘিরে থাকা অপূর্ব সব সি বিচ, বিমানবন্দর ও আশাপাশের কিছু ছোট ছোট দ্বীপ তলিয়ে যাবে।
২১০০ সাল নাগাদ এখানকার সাগরের পানির উচ্চতা অন্তত ৩২ ইঞ্চি বাড়বে বলে সতর্ক করেছে পরিবেশবিদরা। দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পাশাপাশি মাটিধ্বস, সুপেয় পানির অভাব ও নানারকম রোগব্যাধিও দেখা দেবে। শহরটির নেতারা ইতোমধ্যে নাসার সঙ্গে পার্টনারশিপ গড়ে এই শহরকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। নাসার স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে তাপমাত্রা কমানোর ও শহর রক্ষার সমাধান বের করার উপায় খুঁজছেন তারা।
১৪. আলাস্কা
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের চেয়ে অন্তত দুইগুণ বড় আলাস্কার বনভূমি প্রকৃতিপ্রেমীদের অন্যতম আকর্ষণ। কেনাই নদীতে কায়াক চালানো অথবা ডেনালি ন্যাশনাল পার্কে পাহাড়ে ওঠার মত উপভোগ্য অনেককিছুই আছে এখানে।
কিন্তু ক্রম অগ্রসরমান আর্কটিক সাগরের কারণে ইতোমধ্যে আলাস্কা পরিবেশগত নানা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। উপকূল মুছে যাওয়ার পাশাপাশি সাগর ও জঙ্গলে জমা বরফ গলে যাচ্ছে। এর ফলে বেড়েছে মাটিধ্বস ও তীব্র ভূমিকম্পের আশঙ্কা। একইসঙ্গে বেড়েছে দাবানলের পরিমাণ। গত এক দশকে বড় বড় কিছু দাবানলে ধ্বংস হয়ে গেছে আলাস্কার বনাঞ্চলের অনেকটাই যা ২০৫০ নাগাদ বাড়বে বহুগুণ।
১৫. ওসাকা
টোকিও ও হিরোশিমার মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত জাপানের কানসাই এলাকার বিখ্যাত শহর ওসাকা। জাপানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক এই শহরে চোখ ধাঁধানো আধুনিক ডিজাইনের সব ভবনের পাশাপাশি দেখা যায় তৃতীয় শতাব্দীতে গড়ে ওঠা কিছু প্রাচীন স্থাপত্যশৈলি।
ব্যস্ত এই শহরের আরও একটি আকর্ষণ এখানকার ঐতিহ্যবাহী স্ট্রিটফুড। কিন্তু জাপানের আরও কিছু শহরের মত সাগরের কাছাকাছি অবস্থিত ওসাকাও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ইতোমধ্যেই টাইফুন ও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও তিন ডিগ্রি বাড়লে এই শহরের অনেকাংশই চিরতরে পানির নিচে তলিয়ে যাবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা।
১৬. নিউ অর্লিন্স
যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের নিউ অর্লিন্স পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণকেন্দ্র। নানা জাতি ও ভাষার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই নিউ অর্লিন্স যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ইউনিক শহর।
পপ কালচার, ভিন্নতর উচ্চারণ, ক্রেওল কুইজিন, মার্দি গ্রাসের মত বাৎসরিক উৎসব এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। ফরাসি ঐতিহ্য ধারণ করা ঐতিহাসিক ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের ফরাসি ও স্প্যানিশ ধারার ক্রেওল স্থাপত্য আর ঠিক বিপরীতধর্মী বার্বন স্ট্রিটের রঙিন রাত্রিজীবন নিউ অর্লিন্সকে দিয়েছে বৈচিত্র। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ঝুঁকির মুখে রয়েছে এই শহর। ২০০৫ সালে হারিকেন ক্যাটরিনা এসে লণ্ডভণ্ড করে যায় এখানকার অনেক স্থাপত্য। মেক্সিকো উপকূলে অবস্থিত এই শহর সবসময়ই ছোটবড় ঝড়ের মুখোমুখি হয়। তার উপর আছে মিসিসিপি নদীর বন্যা ও অতিবৃষ্টি।
১৭. মাদাগাস্কার
আফ্রিকার দক্ষিণে অবস্থিত মাদাগাস্কার দ্বীপ প্রায় ২২ লাখ ৯ হাজার মাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। বৈচিত্র্যময় জীবজগৎ এখানকার বৈশিষ্ট্য।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এখানকার বৈচিত্রময় প্রাণীজগতে। ধ্বংসের মুখে এখানকার ইকোসিস্টেম। শুকনোর মৌসুম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যসংকটে পড়েছে এখানকার প্রাণিরা। আবার সাগর অঞ্চলের কোরাল ব্লিচিং অর্থাৎ কোরাল মরে সাদা হয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে এখানকার জলজ প্রাণিজগতেও। বিলুপ্তির মুখে অনেক বিরল স্থলজ ও জলজ প্রাণী।
১৮. লাগোস, নাইজেরিয়া
গায়ানা উপসাগরের তীরে অবস্থিত নাইজেরিয়ার সবচেয়ে অধিক ঘনবসতির শহর লাগোস। একের অধিক সাদা বালির চমৎকার সব সি বিচ একে করেছে অন্যতম আকর্ষনীয় পর্যটনকেন্দ্র।
কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য সমুদ্র শহরের মত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকির মুখে রয়েছে লাগোসও। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ইতোমধ্যেই ঝুঁকিতে ফেলেছে এখানকার স্থাপত্যকে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা ক্রমেই তলিয়ে যাবে শহরের কিছু অংশ।
বৈশ্বিক উষ্ণতার বলি হচ্ছে যেসব পর্যটনকেন্দ্র।। ০১
সূত্র- কন নাস্ট (Conde Naste Traveler)
আরও পড়ুন,
বিশ্বের সেরা ১০ বইয়ের শহর (১ম পর্ব)
বিশ্বের সেরা ১০ বইয়ের শহর (২য় পর্ব)
আলাস্কা ওসাকা দ্য আল্পস নাপা ভ্যালি নিউ অর্লিন্স পর্যটনকেন্দ্র বৈশ্বিক উষ্ণতা মাদাগাস্কার মুম্বাই রিও ডি জেনিরো লাগোস