Monday 28 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রোজায় পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করবেন যেভাবে

ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার
১৭ এপ্রিল ২০২১ ১৫:৫৯

মিসেস ফারজানা একজন গৃহিনী। বলছিলেন রোজার সময় সারাদিন কাজ, বাচ্চাদের সময় দেওয়া আর রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। এতে করে ওনার সবসময় মেজাজ খিটখিটে থাকে, মাথাব্যথা করে আর খুব ক্লান্ত লাগে। রোজা রেখে খুব খারাপ লাগছে। জানালেন, করোনার ভয়াবহতার জন্য বাসায় বুয়া আসতে নিষেধ করেছেন। ফলে সারাদিনের সব কাজ সামলাতে সামলাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। আবার সেহরিতেও সবার আগে উঠে খাবার গুছাতে হয়, ফলে কিছুতেই ঘুমের সময় ম্যানেজ করতে পারছেন না। উনি জানতে চাচ্ছিলেন কিভাবে সব কাজ ম্যানেজ করেও পর্যাপ্ত ঘুমানো যায়। মিসেস ফারজানার মত অনেকেই রোজার মাসে ঘুমের সমস্যায় পড়েন। ইবাদতের মাস রমজানে আমাদের জীবনযাপন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। রমজান মাসে সেহরি খেতে ভোর রাতে উঠতে হয় বলে রাতে একটানা ঘুমানো যায় না। ফলে ঘুমের স্বাভাবিক সাইকেলে পরিবর্তন আসে। তবে রোজার সময় সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মতই পর্যাপ্ত গভীর ঘুমও গুরুত্বপূর্ণ।

বিজ্ঞাপন

রোজায় বদলে যাওয়া বায়োলজিক্যাল ক্লক বা দেহঘড়ি
সুস্বাস্থ্যের জন্য, সারাদিনের কাজকর্ম সঠিকভাবে করার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি। আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে বায়োলজিক্যাল ক্লক নামে এক প্রাকৃতিক ঘড়ি রয়েছে যাকে আমরা দেহঘড়ি বলে থাকি। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে সার্কাডিয়ান রিদম। এই সার্কাডিয়ান রিদম আমাদের ঘুমানো এবং ঘুম থেকে জেগে ওঠার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বায়োলজিক্যাল ক্লক আমাদের ঘুমের সাধারণ নিয়মের সাথে পরিচিত। যেমন আমরা রাতে একটানা সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুমাই আবার সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠি। ঘুমের সাইকেলে কোন ধরনের পরিবর্তন এই সার্কাডিয়ান রিদমের উপর প্রভাব ফেলে। যার ফলে মুড সুইং মানে হঠাৎ মন ভালো হওয়া আবার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, মাথাব্যথা, মাইগ্রেনসহ নানা ধরনের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। যার ফলে স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থা এবং পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সাধারণত রোজার সময় আমাদের ঘুমের স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে।

বিজ্ঞাপন

রোজায় আমরা ভোররাতে সেহরি খাওয়ার জন্য জেগে উঠি তারপর ফজর নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাই। এসময় দুই থেকে আড়াই ঘন্টার বেশি ঘুমানো যায় না কারণ দিনের কাজকর্ম এবং অফিসে যাবার তাড়া থাকে। অন্যদিকে আবার তারাবি নামাজ পড়ে, রাতের খাবার খেয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে গল্প আড্ডা দিয়ে অনেকেই বেশ রাত করে ঘুমাতে যাই। ফলে সাত থেকে আট ঘন্টার যে পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন সেটা পূরণ হয় না। ফলে নানা ধরনের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এতে করে রোজার সময় স্বাস্থ্য উপকারিতা বাধাগ্রস্থ হয়।

রোজার সময় সঠিক এবং পর্যাপ্ত ঘুমের পরিকল্পনা যেভাবে করবেন
সঠিক ঘুম আমাদের মস্তিষ্ক সংক্রান্ত কাজগুলো যেমন, চিন্তা করা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, স্মৃতি ধরে রাখা এবং প্রয়োজনে তা পুনরায় মনে করা, মনোসংযোগ করা ইত্যাদি সুষ্ঠূভাবে পালন করতে সাহায্য করে। কিন্তু ঘুম কম হলে বা ঘুমের সাইকেলে ব্যঘাত ঘটলে আমাদের মস্তিষ্ক দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায়। ফলে কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া যায় না, কোন সমস্যার সমাধান করতে অসুবিধা হয়, ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি হয়, সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, সৃষ্টিশীল কাজ করা যায় না। সব মিলিয়ে শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়। জেনে নেই কিভাবে রোজার সময়েও সঠিক এবং পর্যাপ্ত ঘুমিয়ে শরীর সুস্থ রাখা যায়।

১. ঘুমের নতুন সময় এবং পরিমাণ ঠিক করা
রোজার পরিবর্তিত সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঘুমের জন্য একটি নতুন সময় তালিকা করে নিতে হবে। এই তালিকায় ঘুমের জন্য তিনটি আলাদা আলাদা সময় সেট করে নিতে হবে। এবং সে অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে এবং ঘুম থেকে উঠতে হবে।

২. রাতে খাবার পর ঘুমানো
তারাবি নামাজ শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে নিতে হবে। এরপর দুই ঘন্টা সময়ের মধ্যে জরুরি কাজগুলো শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে হবে। রাত এগারোটায় শুয়ে পড়তে হবে যাতে সেহরি পর্যন্ত চার ঘন্টা ঘুমানো যায়।

৩. সেহরি খেয়ে ঘুমানো
ভোররাতে তিনটা ত্রিশ মিনিটে উঠে সেহরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে ভোর পাঁচটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে সাতটা পর্যন্ত দুইঘন্টা ঘুমানো যায়। ফলে রাতের চারঘন্টা আর ভোরের দুইঘন্টা মোট ছয় ঘন্টা ঘুম হবে।

৪. বাড়তি ঘুম এবং পাওয়ার ন্যাপ
বর্তমানে লকডাউন চলার কারণে অফিসে যাবার তাড়া নেই। তাই সকালে একঘন্টা বেশি ঘুমিয়ে নিলেও সারাদিনের কাজের কোন ক্ষতি হবে না। লকডাউন খুলে গেলে সকালে দুই ঘন্টা ঘুমিয়ে নিয়ে পরে দিনে কাজের ফাঁকে সুবিধামতো সময়ে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট পাওয়ার ন্যাপ নিয়ে নিলে দুই ঘন্টার সমান ঘুম পূরণ হয়। ফলে সারাদিনের ঘুমের চাহিদা সহজেই পূরণ হয়ে যায়।

রোজার সময় এভাবে তিনভাগে ঘুমের সময়কে সেট করে নিলে শরীরের সার্কাডিয়ান রিদম অর্থাৎ বায়োলজিক্যাল ক্লক ঘুমের নতুন সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এবং নতুন সেট করা সময়েও পর্যাপ্ত গভীর ঘুম হয়। ফলে শরীরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না এবং ক্লান্ত বা অসুস্থ হবার ঝুঁকি কমে যায়।

ঘুমের গুণগত মান নিশ্চিত করা
শারীরিক এবং মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য রোজার সময় যেমন প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো এবং ঘুম থেকে ওঠা জরুরি ঠিক তেমনি এসময় ঘুমের গুণগত মান অর্থাৎ গভীর ঘুম নিশ্চিত হওয়াও জরুরি। নিচে আলোচিত নিয়মগুলো মেনে চললে ঘুমের গুণগত মান নিশ্চিত হবে।

১. ঘুমের পরিবেশ
রোজা রাখা অবস্থায় আমাদের শরীরে ইনসুলিন লেভেল কমে যায় এবং মেলাটোনিন লেভেল বেড়ে যায়। মেলাটোনিন হরমোন আমাদের ঘুম আসতে সাহায্য করে। এই হরমোন অন্ধকারে নিঃসরণ হয়। রোজা রাখা অবস্থায় শরীরে গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণও বাড়ে। এই হরমোন ঘুমন্ত অবস্থায় শরীরকে রিপেয়ার হতে সাহায্য করে। তাই ঘুমের জন্য নির্ধারিত ঘর হতে হবে কোলাহলমুক্ত নিরব। ঘুমের সময় ঘরের বাতি নিভিয়ে দিতে হবে। ঘুমের বিছানায় বসে খাওয়া দাওয়া করা যাবে না।

২. বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি দূরে রাখা
ঘুমানোর আগে বৈদ্যুতিক যন্ত্র যেমন মোবাইল, ল্যাপটপ এসব চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, এসব যন্ত্র থেকে বিচ্ছুরিত আলো ঘুম নষ্ট করে।

৩. খাবারে সচেতনতা
ইফতার এবং সেহরিতে ভাজাপোড়া, গুরুপাক, অতিরিক্ত মিষ্টি এবং ঝাল খাবার খেলে রাতের ঘুমে সমস্যা হয়। কারণ এ ধরনের খাবার থেকে পেটে গ্যাস হয় এবং বুক জ্বালা করে। এসব খাবার হজম হতেও বেশি সময় লাগে ফলে গভীর ঘুম বিঘ্নিত হয়। তাই গভীর ঘুম নিশ্চিত করার জন্য খাবার হতে হবে সহজপাচ্য এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন।

৪. ক্যাফেইন পান করা থেকে বিরত থাকা
ঘুমানোর আগে চা বা কফি খাওয়া যাবে না। কারন চা বা কফি খাওয়ার পর এগুলোতে থাকা ক্যাফেইনের প্রভাব শরীরে প্রায় সাত ঘন্টা পর্যন্ত থাকে। যা গভীর ঘুম হতে বাঁধা সৃষ্টি করে।

৫. খাবার হজম হতে সময় দেওয়া
ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে দুই ঘন্টা আগে খাবার খেয়ে নিতে হবে। যাতে ঘুমানোর সময় খাবার হজম হবার চাপে ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে।

৬. পর্যাপ্ত পানি পান
ইফতারের পর থেকে কিছু সময় পরপর পানি পান করে শরীরের সারাদিনের পানির চাহিদা পূরণ করতে হবে। কারণ ডিহাইড্রেশন হলে মাথাব্যথা, মাইগ্রেনের সমস্যা বেড়ে গিয়ে ঘুমের সমস্যা হয়।

৭. মেডিটেশন করা
রাতে ঘুমাতে যাবার আগে কমপক্ষে দশ মিনিট মেডিটেশন করলে গভীর প্রশান্তির ঘুম হয়।

অনেকেই বলে একমাস রোজা থেকেও ওজনতো কমলোই না বরং বাড়লো। যারা কম ঘুমাচ্ছেন তারা বেশি সময় জেগে থাকার ফলে শরীরে স্ট্রেস পড়ছে। ফলে স্ট্রেস হরমোন নিঃসরন হচ্ছে বেশি। আর তখন স্ট্রেস এড়াতে বাড়তি খাবার বিশেষ করে জাঙ্কফুড, মিষ্টি খাবারের দিকেই মানুষের ঝোঁক বেড়ে যায়। রোজার সময় কম ঘুমালে এভাবেই আমাদের ওজন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। রোজায় স্বাস্থ্য ও কাজের গতি স্বাভাবিক রাখতে নিজের ঘুমের চাহিদা মিটিয়ে নিতে হবে নতুন সময় ও তালিকার সাথে তাল মিলিয়ে।

এই নিয়মে প্রথম কয়েকদিন দিনে ঘুম ঘুম ভাব থাকবে কিন্তু তিন চার দিন পরই এই ভাব কেটে যাবে এবং স্বাভাবিক হয়ে যাবে জীবনপ্রবাহ। সাংসারিক কাজগুলো পরিবারের সকল সদস্যরা ভাগাভাগি করে করলে একজনের উপর কাজের চাপ কমে যায়। ফলে কাজগুলো সুষ্ঠূভাবে সম্পন্ন হওয়ার পাশপাশি সবার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হয়।

সারাবাংলা/আরএফ

টপ নিউজ ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার রমজান রোজা রোজায় ঘুম রোজায় পর্যাপ্ত ঘুম

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর