Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ব যোগ দিবস মানবতার, সুস্থতার, সুন্দরের

ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার
২১ জুন ২০২৩ ১১:২৭

সারা পৃথিবীতে বর্তমানে সৌন্দর্য এবং তারুণ্য ধরে রাখার জন্য নারী পুরুষ সবাই যেমন যোগ ব্যয়াম করছে তেমনি শরীরকে অসুখ বিসুখ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও যোগ ব্যয়াম করছে অনেকে। এমনকি নানা রকম রোগ থেকে যোগ ব্যয়াম করে সুস্থ হয়েছেন অনেকেই, এমন প্রমাণও বিশ্বের বিভিন্ন স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থা ইতোমধ্যে তাদের গবেষণায় প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। যোগ ব্যয়াম রোগ প্রতিরোধ করে, করে রোগ নিরাময়। তাই যোগ ব্যয়াম মানুষকে শুধু সুন্দর আর ফিটই রাখে না, করে রোগমুক্তও।

বিজ্ঞাপন

২১ জুন বিশ্ব যোগ দিবস _

প্রতিবছর ২১ জুন সারা পৃথিবীতে পালিত হয় ‘বিশ্ব যোগ দিবস’। যোগ দিবস ২০২৩ এর প্রতিপাদ্য হলো ‘The World is One Family’। নিয়মিত যোগ অনুশীলন করলে মানুষের মন পবিত্র হয়, শরীর সুস্থ থাকে। পবিত্র মন এবং সুস্থ শরীর সমাজ, পরিবার এবং প্রকৃতির জন্য মানবিক হয়ে ওঠে। ইয়োগা শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘যূজ’ থেকে। যূজ মানে হলো যোগ দেওয়া বা মিলন হওয়া। যোগের আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য হলো প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে যোগ করা। প্রকৃতি সর্বজনীন। প্রকৃতির সকল নিয়মের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলা মানে যোগ, প্রকৃতির সকল সৃষ্টিকে সম্মান এবং ভালোবাসা মানে যোগ।

যোগ বিজ্ঞান আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয় নিয়মিত যোগ ব্যয়াম করলে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারার ক্ষমতা তৈরি হয়। যোগ বিজ্ঞান কোন নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের নয় বরং সৃষ্টির সকলের জন্য যোগ।

যোগের আদি নিবাস _

যোগ ব্যয়াম বা ইয়োগা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান চর্চা। ভারতীয়দের বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ যেমন বেদ, ঊপনিষদ, মহাভারত, গীতা ইত্যাদি গ্রন্থে যোগ ব্যয়ামের কথা বলা হয়েছে। যোগ ব্যয়ামের ইতিহাস প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে আজ পর্যন্ত যোগ ব্যয়াম চর্চা হয়ে আসছে। সময়ের সাথে সাথে এর অনুশীলন এবং চর্চা বিভিন্ন রকম রুপ নিয়েছে। যেমন, প্রাচীনকালে যোগ ব্যয়াম মূলত ধর্মীয় গুরুর তত্ত্বাবধানে থেকে শিখতে হতো এবং ধর্মীয় অনুশীলন হিসেবেই যোগ ব্যয়াম চর্চা করা হতো। কিন্তু বর্তমানে ধর্মীয় গন্ডির বাইরে সাধারণ মানুষজনও তাদের জীবনের প্রয়োজনে যোগ ব্যয়াম অনুশীলন করছে।

বিজ্ঞাপন

যোগ বা ইয়োগার বিশ্বভ্রমণ _

প্রাচীন মুনী ঋষিরা যোগ ব্যয়াম সংস্কৃত ভাষায় চর্চা করতো এবং তাদের বিশেষ বিধান অনুযায়ী চর্চা করাতো। ভারতীয় সাধক স্বামী বিবেকানন্দ এর হাত ধরেই প্রথম আধুনিক বিশ্বে যোগ ব্যয়াম পরিচিত হয়ে ওঠে এবং সকলের জন্য ধীরে ধীরে অনুশীলনের উপযোগি হতে থাকে । তিনি ১৮৯৩ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রথম যোগ ব্যয়ামের বিষয়ে কথা বলেন এবং যোগ বিজ্ঞানের ব্যবহারিক এবং ধর্মীয় উপযোগিতা তুলে ধরেন। পশ্চিমা বিশ্ব স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে ইয়োগা বা যোগ বিষয়ে জানার পর এর দিকে ঝুঁকতে থাকে। যোগ ব্যয়াম বিষয়ে পড়াশুনা, গবেষণা এবং অনুশীলন করার জন্য পশ্চিমা বিশে^র জনগণ ভারতের বিভিন্ন যোগ আশ্রমে এসে মাসের পর মাস গুরুর তত্ত্বাবধানে থেকে যোগকে জানেন এবং গবেষণা করেন। এভাবেই যোগ বা ইয়োগা ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।

যোগের আধুনিকায়ন_

গবেষণা পিপাসু পশ্চিমারাই যোগের বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষন প্রথম জনসম্মুখে প্রচার করে। তবে যোগ বিজ্ঞান নিয়ে বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণাগারে প্রচুর গবেষণা চলছে। ভারতে যোগ বা ইয়োগা বিষয়ে রয়েছে সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল এবং পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে। ভারতীয় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ বিষয়ে উচ্চতর পড়াশুনা করছে।

যোগ ব্যয়াম একটি বিশাল বিজ্ঞান। এর ব্যপকতা অনেক। যোগ ব্যয়াম এর আধ্যাত্মিক অনুশীলন করতে হলে ধাপে ধাপে এগুতে হয়। এর জন্য আধ্যাত্মিক গুরুর সহযোগিতা এবং নির্দেশনা লাগে। তবে যোগ ব্যায়ামের রয়েছে বিভিন্ন ধারা। বর্তমান বিশে^ আমরা সচরাচর যোগ বা ইয়োগার যে অনুশীলনগুলো দেখি সেগুলো মূলত শরীর সুন্দর, ফিট আর তারুণ্য ধরে রাখার পাশাপাশি সুস্থ থাকার জন্য করা হয়। বর্তমান অনুশীলনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আসন, প্রাণায়াম, মুদ্রা, বন্ধা, ক্রিয়া, ধ্যান। এই অনুশীলনগুলোর কয়েকটি তুলে ধরছি।

আসন_ শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমন-মাথা, হাত, পা, পেট, পিঠ ইত্যাদি বিশেষ পদ্ধতিতে নড়াচড়া করা। এই বিশেষ নড়াচড়া শরীরের বাহির এবং ভিতরে সূক্ষ পর্যায়ে কাজ করে। এতে শরীরের মাংসপেশী, হাঁড়, লিগামেন্ট, স্নায়ু, রক্তনালী এমনকি ডিএনএ লেভেলে পর্যন্ত প্রভাব ফেলে। নিয়ম মেনে এই বিশেষ শারীরিক নড়াচড়াকে যোগ ব্যায়ামে আসন বলে।

যোগ ব্যয়ামে রয়েছে হাজার হাজার আসন। এক একটি আসন শরীরের একাধিক রোগ সারাতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ করতে পারে।

প্রাণায়াম_ বিশেষ নিয়ম এবং পদ্ধতি মেনে শ্বাস গ্রহণ করা এবং শ্বাস ছাড়া। শ্বাস-প্রশ্বাসের এই অনুশীলনকে যোগ ব্যয়ামে বলে প্রাণায়াম। প্রাণায়াম মানুষের প্রাণ বায়ু অর্থাৎ আয়ু বাড়ায়। শুধু প্রাণায়াম করলেও শরীর রোগ মুক্ত থাকে এবং দীর্ঘদিন তরুণ থাকা যায়।

ক্রিয়া_ ক্রিয়া মূলত শরীরের ভিতরকে পরিষ্কার করে শরীরকে যোগ ব্যয়াম করার উপযোগি করে তোলে। ক্রিয়ার বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। কোন ক্রিয়ায় লবন পানি খেয়ে যোগাসন করতে হয় আবার কোন ক্রিয়ায় নাক দিয়ে লবন পানি নিতে হয় আর ছাড়তে হয়। ক্রিয়া ইয়োগা ইনস্ট্রাকটরের তত্ত্বাবধানে থেকে করতে হয়।

ধ্যান_ ধ্যান ইয়োগার সর্বোচ্চ স্তর। ধ্যানের মাধ্যমে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অবস্থার পরিবর্তন করে মানুষকে শান্ত, স্থির এবং প্রশান্তময় অবস্থায় নিয়ে আসা হয়।

বিশ্বের সকল সৃষ্টির জন্য যোগ, জানেন কি?

যোগ শুধু মানব জাতির জন্যই নয়, প্রাণীকুলের অন্যান্য প্রাণীর জন্যও যোগ। মজার ব্যপার হচ্ছে, মানুষ ছাড়া প্রাণীকূলের অন্যান্য সকল প্রাণীই নিয়মিত যোগ অনুশীলন করে থাকে। যোগ ব্যয়ামের আসনগুলোর নামের দিকে খেয়াল করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন- মারজারি আসন। সংস্কৃত মারজারি শব্দের বাংলা অর্থ বিড়াল আর আসনা মানে আসন, অর্থাৎ বিড়ালের ভঙ্গি। বিড়াল ঘুম থেকে উঠে বা অনেকক্ষণ বসা থেকে উঠে শরীর উপরে নীচে যে টান টান করে সেই ভঙ্গিমাটাই হলো মারজারি আসনা। এই মারজারি আসন নিয়মিত করলে হজমের সমস্যা ভালো হয়, পেটের গ্যাস দূর হয়, পেটের মেদ কমে পেট স্লিম হয়ে যায় এবং আরো অনেক উপকারিতা আছে। যোগ বিজ্ঞানের প্রতিটি অনুশীলনই জীব জগতের কোন না কোন প্রাণীর করা ভঙ্গিমা এবং অনুশীলন থেকে এসেছে যেগুলো আমরা করলে উপকার পাই।

২১ জুন যোগ দিবস কেন_

২১ জুন দিনটি বছরের সবচেয়ে বড় দিন। এই দিন সূর্য তাড়াতাড়ি ওঠে এবং দেরিতে অস্ত যায়। যোগ বিজ্ঞানে সূর্যকে শক্তি এবং জীবনের প্রতীক বলা হয়। যেহেতু, নিয়মিত যোগ অভ্যাস মানুষকে দীর্ঘ জীবন দেয়, তাই এই দর্শন থেকেই বছরের দীর্ঘতম দিনটিকে যোগ দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। তাই প্রতিবছর ২১ জুন ’আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’ পালিত হয়।

পেশা হিসেবে যোগ বা ইয়োগা, বাংলাদেশ বাস্তবতা_

যোগ বিজ্ঞানের স্বাস্থ্য উপকারিতা আজ এতটাই প্রমাণিত যে, বিশ্বব্যাপি ঘরে ঘরে মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় আজ যোগ ব্যয়ামের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ রোগিদের পরামর্শ দিচ্ছেন যে, সব স্বাস্থ্য সমস্যায় ওষধ না খেয়ে বরং কোন কোন রোগ সারাতে যোগ ব্যয়াম করার জন্য।

বাংলাদেশের বাস্তবতাও ভিন্ন নয়। বাংলাদেশে এখন ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে যোগ ব্যয়ামের সেন্টার রয়েছে। অনেক মানুষ যোগ ব্যয়ামের উপর ভারত থেকে বিভিন্ন শর্ট কোর্স করে এসে সেন্টার দিয়ে মানুষকে যোগ ব্যয়াম অনুশীলন করাচ্ছে। কেউ কেউ তাদের মূল ধারার পেশার পাশাপাশি যোগ ব্যয়াম নিয়ে কাজ করছেন। অনেকেই অনলাইনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যোগ প্রশিক্ষক থেকে যোগ ব্যয়াম শিখছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে বাংলাদেশে যোগ ব্যয়ামের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী প্রশিক্ষিত যোগি রয়েছেন। কেউ কেউ করছেন যোগ ব্যয়ামের উপর পিএইচডি ডিগ্রি।

ইয়োগা সেন্টারগুলোতে এসে মানুষজন যেমন ইয়োগা করছে তেমনি অনেক তরুন নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পক্ষাঘাতগ্রস্থ এবং বয়স্ক রোগিদের বাড়ি গিয়ে যোগ অভ্যাস করাচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলোতে ক্লিনিক্যাল ইয়োগা প্র্যাকটিস হচ্ছে। কাজেই আমাদের দেশের কর্মসংস্থানে যোগ বিজ্ঞান ভূমিকা রাখছে।

যোগ সারায় রোগ। মূল ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সহায়ক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে যোগ বা ইয়োগা বর্তমানে সারা বিশে^র মানুষের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা কাটিয়ে মানুষকে সুস্থ করে তোলার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে। সৃষ্টির কল্যাণে যোগ বিজ্ঞানের রয়েছে বড় ভূমিকা, আজ এটা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত। আর তাই ২০১৫ সাল থেকে সারা বিশে^ প্রতিবছর আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালিত হয়ে আসছে। আসুন নিয়মিত ইয়োগা করি, সুস্থ, সুন্দর, মানবিক জীবন যাপন করি। সবাইকে যোগ দিবসের শুভেচ্ছা।

লেখক: কনসালটেন্ট এন্ড ট্রেইনার অব ন্যাচারোপ্যাথি এন্ড ইয়োগা তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা

সারাবাংলা/এসবিডিই

ডা. ঐন্দ্রিলা আক্তার বিশ্ব যোগ দিবস মানবতার সুস্থতার সুন্দরের

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর