ডাস্ট এলার্জি থেকে বাঁচতে কী করবেন?
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১০:১৫
ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে নগরের মানুষের যন্ত্রণার অন্যতম অনুষঙ্গ ধুলাবালি। নগর সভ্যতা মানেই ইট-কাঠ- সিমেন্টের অট্টালিকা। এছাড়া এই অট্টালিকা, রাস্তাঘাটের গঠন প্রক্রিয়ায় ধুলাবালি উড়বে এটাই যেন আমাদের দেশের বাস্তবতায় সবচেয়ে সাধারণ কথা। এই বায়ু দূষণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডাস্ট অ্যালার্জিতে আক্রান্তের সংখ্যাও। ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ট্রান্সলেশনাল অ্যালার্জিতে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের ডাস্ট অ্যালার্জি রয়েছে। যাদের ধুলাবালিতে এলার্জি আছে তাদের কাছে এই সময়টা এক অদ্ভুত যন্ত্রণাময়। ধুলার কারণে হাঁচি কাশি তো রয়েছেই- একই সঙ্গে ক্রণিক সর্দি, মাথাব্যথা, চোখে ব্যথা এমনকি জ্বরেও ভোগেন অনেকেই। ডাস্ট এলার্জি নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালের চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক হোসেন। ডাস্ট এলার্জি বিষয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ থাকছে এই ফিচারে।
ডাস্ট এলার্জি কেন হয়?
ডাস্ট কী? বাতাসে যে ধুলাবালি, বালুকণা, বিভিন্ন ধোঁয়া, কেমিক্যাল, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া থাকে এগুলো ডাস্ট। শীতকালে, বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের সময় বাতাস অনেক বেশি শুষ্ক থাকে, বাতাসে ডাস্টের পরিমাণ বেড়ে যায়, ফুলের রেণু, বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এগুলো খালি চোখে সবসময় দেখা যায় না। এসব ডাস্ট যখন আমাদের নাক বা চোখের সংস্পর্শে আসে তখন অনেকের অ্যালার্জিক রি-অ্যাকশন হয়। প্রথমে সামান্য রি-অ্যাকশন হয়, এরপর যখন আবার নাক কিংবা চোখের সংস্পর্শে ডাস্ট আসে তখন অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন বেশি হয়। ডাস্ট মাইটস বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধুলার কণা বা পোকা বাতাসে ভেসে চলাচলের সময় নাকে ঢুকে জ্বালা সৃষ্টি করে। যার ফলে চুলকানি, হাঁচি, কাশি হতে পারে। ঘাস বা ফুলের রেণু নাকে ও গলায় ঢুকলে তা থেকেও অ্যালার্জিক রিয়েকশন হয়। ফুলের গন্ধ নিলেও অনেকের অ্যালার্জি হয়। যে কারণে শীত শুরুর এই সময়ে ডাস্ট অ্যালার্জির মাত্রাও বেড়ে যায় অন্য সময়ের তুলনায়।
এছাড়া, পরিবারের কারও আগে থেকে অ্যালার্জির সমস্যা থাকলে বাকি সদস্যদেরও হতে পারে। তবে ডাস্ট এলার্জি ছোঁয়াচে নয়। অল্প বয়স্ক শিশু, হাঁপানি রোগী এবং গর্ভবতী মহিলাদের ডাস্ট অ্যালার্জি হতে পারে। আর্দ্র পরিবেশে ডাস্ট মাইটস বেশি থাকে। তাই বাসা বাড়ির পরিবেশ ভ্যাপসা হয়ে থাকলে অ্যালার্জির সমস্যা হতে পারে। এছাড়া কুকুর, বিড়াল বা পোষা প্রাণীর চুল ও খুশকিতে ডাস্ট অ্যালার্জি হয়।
ডাস্ট এলার্জি হয়েছে বুঝবেন যেভাবে
ডাস্ট থেকে যে অ্যালার্জি হয় তাতে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়। ডাস্ট এলার্জির একটা কমন উপসর্গ হচ্ছে, অনবরত হাঁচি হতে থাকে। একইসঙ্গে নাক থেকে পানি ঝরে। চোখ চুলকায়, চোখ লাল হয়ে যায়। চোখের নিচে কালো দাগ হয় ও চোখ ফুলে যেতে পারে। সঙ্গে চোখ থেকে ক্রমাগত পানি ঝরতে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে নাক বন্ধ হয়ে থাকে। নাক, মুখ, গলা চুলকাতে পারে। এছাড়া মুখের ভেতর তালু এবং গলার ভেতরেও চুলকাতে পারে। একপর্যায়ে খুশখুশে কাশি হয়। খুব ঘন ঘন শ্বাস নিতে হয়, কাশি থাকলে রাতে ঘুমাতেও কষ্ট হয়ে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে বারবার নাক উপরের দিকে ঘষার প্রবণতা দেখা যায়। শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক- উভয়ের ক্ষেত্রে হাঁপানির মতো লক্ষণ হয়। শ্বাস ফেলার সময় বুক থেকে বাঁশির মত বা কখনও কখনও ঘড়ঘড় শব্দ হতে থাকে। বুকে চাপ ধরা ভাব বা ব্যথা থাকতে পারে। এছাড়া কান বন্ধ, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, চামড়ার ওপর ফুসকুড়ি ওঠা, র্যাশ ইত্যাদি নানাভাবে ডাস্ট অ্যালার্জি প্রকাশ পেতে পারে।
ডাস্টের সঙ্গে ছত্রাক, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া মিশে থাকে। ডাস্টে বিভিন্ন রোগের জীবাণু মিশে থাকার ফলে বিভিন্ন রোগ হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। যেমন- যক্ষ্মার জীবাণু থাকলে যক্ষ্মা হতে পারে, ভাইরাল ডিজিজ হতে পারে। যদি অ্যালার্জির সাথে সাথে কারো অ্যাজমা বা হাঁপানি রোগও থেকে থাকে, তবে সেক্ষেত্রে উপরে উল্লেখিত লক্ষণগুলোর সাথে আরও কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ডাস্ট এলার্জি হলে কী করবেন
অ্যালার্জির সমস্যা কখনও পুরোপুরি সেরে যায় না। তাই অ্যালার্জিকে প্রতিরোধ করাই সবচেয়ে ভালো উপায়। কিছু বিষয় মেনে চললে অ্যালার্জি প্রতিরোধ করা যেতে পারে। যেমন- যথাসম্ভব ধুলাবালি এড়িয়ে চলতে হবে। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর এবং ঘুমানোর আগে বিছানা ভালোভাবে ঝেড়ে নিতে হবে। প্রতিদিন ব্যবহৃত বালিশ, মশারি মাঝেমাঝে রোদে দিতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একবার বিছানার চাদর, বালিশের কভার পরিবর্তন করতে পারলে ভালো। বাসাবাড়ির ফার্নিচারের ধুলা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ঘরের বাইরে গেলে সবসময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বাইরে থেকে এসে মুখ, হাত-পা পানি দিয়ে ধুতে হবে। প্রতিদিনের ব্যবহৃত পোশাক ময়লা হলে নিয়মিত ধুতে হবে ভালোভাবে। সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে নিজেকে। ঘর ঝাড়ু দেওয়াসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিভিন্ন কারণে ধুলাবালির সংস্পর্শে যেতে হলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
শোবার ঘরে বইয়ের তাক, ম্যাগাজিন, পুরোনো খবরের কাগজ এসব ঘরে না রাখা ভালো; কেননা এগুলোর ওপর সহজেই ধুলা জমতে পারে। ডাস্ট অ্যালার্জি থাকলে বাসায় কার্পেট রাখা উচিত নয়। বাসায় লোমশ বা পালকযুক্ত প্রাণী না পোষা উত্তম, এসব প্রাণীর শরীরে অ্যালার্জি উদ্রেক করে এমন উপাদান থাকে। ঘরে যাতে আলোবাতাস ঢুকতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ডাস্ট এলার্জির চিকিৎসা
যাদের অ্যালার্জির মাত্রা বেশি থাকে তাদের বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। নাসারন্ধ্র থেকে হাঁচি, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট হলে বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। ত্বকে চুলকানি, চর্মরোগ হলে ত্বকের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। আর চোখ লাল, চুলকানি, পানি পড়লে, কনজাংটিভাইটিস হলে চোখের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। যাদের ডাস্ট অ্যালার্জি আছে প্রয়োজন অনুযায়ী তারা অ্যান্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন। তবে কী কারণে এবং কী থেকে অ্যালার্জি হচ্ছে এবং অ্যালার্জির মাত্রা কেমন সেটি নির্ণয় করতে হবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। অ্যালার্জির জন্য দায়ী ফ্যাক্টর কোনটি তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন। যেমন স্কিন অ্যালার্জি টেস্ট, ব্লাড টেস্ট ইত্যাদি। সমস্যা শনাক্ত করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে রোগীকে।
যাদের অ্যালার্জির মাত্রা বেশি, নাক দিয়ে অনবরত পানি পড়ে, অনেক বেশি কাশি, তারা নাকের ভেতরে স্টেরয়েড নেজাল স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন। কারো বুক চেপে আসলে, অ্যাজমার সমস্যা হলে বিভিন্ন ইনহেলার নিতে পারেন। অ্যালার্জির পরিমাণ বেশি থাকলে কৃমির ওষুধ নেওয়ার কথাও বলেন এই চিকিৎসক। মাত্রারিতিরিক্ত অ্যালার্জিতে প্রয়োজনে ইনজেকশনও দেওয়া হয় রোগীদের। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অ্যালার্জির ওষুধ খেতে হবে। যাদের শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমার সমস্যা রয়েছে, শারীরিকভাবে দুর্বল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, ডায়াবেটিস রোগী, ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছেন, কোমরবিডিটি আছে, অনেক বয়স্ক ব্যক্তি ও একেবারে ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে সবসময় বিশেষ সতর্কতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে।
চুলকানি, অনবরত হাঁচি, চোখ লাল হয়ে যাওয়া বা চোখ থেকে থেকে পানি ঝড়তে থাকলে অ্যান্টি হিস্টামিন জাতীয় ঔষধ খেলে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। রিল্যাক্সড থাকতে হবে, চোখ বন্ধ করে বিশ্রাম নিতে হবে। স্টেরয়েড জাতীয় নাকের স্প্রে ব্যবহার করে নাকের ভেতরের ফোলাভাব কমানো যায়। নাক বন্ধ হয়ে থাকলে স্যালাইন সল্যুশন দিয়ে নাক পরিষ্কার করা যায়। যে কোনও অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিলে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত অ্যালার্জি জাতীয় খাবার যেমন গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, চিংড়ি, পুইশাক, বেগুন ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। এতে অ্যালার্জির সমস্যা আরও বেড়ে যায়। হঠাৎ ত্বকের কোথাও লাল হয়ে গেলে, চুলকানি হলে ঠান্ডা পানির সেঁক দিলে বা ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করলে আরাম পাওয়া যায়।
এছাড়া নিয়মিত ডাস্ট এলার্জি হলে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নিতে হবে। এগুলো অ্যালার্জি কমাতে সরাসরি প্রভাব ফেলে না। কিন্তু শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এছাড়া এলার্জি প্রতিরোধে সুষম ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। পর্যাপ্ত সময় ঘুমাতে হবে। ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করতে হবে।
অ্যালার্জির সমস্যা যে কতটা কষ্টদায়ক এবং বিরক্তিকর, এটা শুধুমাত্র ভুক্তভোগীরাই ভালো বলতে পারবেন। অ্যালার্জির চিকিৎসা করেও এ সমস্যা থেকে একেবারে পরিত্রাণের উপায় নেই। তবে নিয়ম মেনে চললে এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো ঔষধ সেবন করলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সর্বোপরি, ডাস্ট অ্যালার্জি এর সমস্যা থেকে বাঁচতে বাইরে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। পরিচ্ছন্নতা মেনে সুস্থ থাকতে হবে।
সারাবাংলা/এসবিডিই