।। হাসনাত শাহীন ।।
অন্যান্য বছরের এই সময়টাতে গ্রন্থমেলা মোটামুটি ছিমছাম থাকে। ধীর গতিতেই এগিয়ে যায় বিকিকিনি। কিন্তু এ বছরের চিত্রটা একেবারে ভিন্ন। কেননা, এবছরের এ গ্রন্থমেলার শুরুতেই ছিলো প্রকাশকদের কাঙ্খিত সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার। তার পরে শনিবার এবং পরের সপ্তাহে পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, এর পরে শুক্র ও শনিবার দুইদিন সরকারি ছুটির দিন। এমনই ছুটির দিনগুলোতে উপচেপড়া ভিড় আর বিক্রি নিয়ে বেশ খোসমেজাজেই চলছিল প্রাণের মেলা বইমেলা।
সেই খোশমেজাজের মাঝখানে গত রোববার মেলার ১৭তম দিনে ঝড়-বৃষ্টি’র বাঁধা পেরিয়ে জমে ওঠা মেলা এবার অতিক্রম করলো তার ১৮তম দিন। এদিন বিকেল ৩টায় বইমেলার প্রবেশ পথ খুলে দিলে পাঠকদের উপস্থিতি আর স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরে ঘুরে বই কেনার দৃশ্যে মেলায় নতুন প্রাণের জোয়ার সৃষ্টি হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থেকে থেকে কোকিলের কুহুতানের ছন্দে বইকেনার এমন দৃশ্যে আশায় বুক বেঁধে আছেন প্রকাশকরা। বলতে গেলে এদিনের মেলায় প্রায় সবগুলো স্টলেই ছিল বইপ্রেমীদের ভিড়। বিকেল তিনটায় মেলার প্রবেশদ্বার খোলার পর থেকে রাত নয়টায় মেলা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত ছিল বইপ্রেমীদের উপচেপড়া ভিড়।
এমনই দিনে প্রকাশিত বেশ কিছু বইয়ের মধ্যে মোড়ক উন্মোচন হলো বেশ কয়েকটি বইয়ের। এর মধ্যে প্রকাশনা সংস্থা চারুলিপি থেকে প্রকাশিত সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ‘এক দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী অর্জন’ বইটি অন্যতম। সোমবার বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শহীদ সালাম চত্বরে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন-অর-রশিদ। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন লেখক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও প্রকাশকরা। মোড়ক উন্মোচন শেষে প্রকাশনা সংস্থা চারুলিপির সামনে ভক্তদের সাথে সেলফি তোলেন এবং তাদেরকে অটোগ্রাফ দেন সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রী।
শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৯ বছর পূর্বে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সকল শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা, ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে সমতা অর্জন ও তা ধরে রাখা, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া হ্রাস করা, নারী শিক্ষার প্রসার, প্রতি বছর যথা সময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি ও তাদের ক্লাস শুরু, বছরের নির্দিষ্ট তারিখে পরীক্ষা গ্রহণ, ষাটদিনের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ, আইসিটি শিক্ষা বাধ্যতামূলক, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ইত্যাদি নানা বিষয়গুলো বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
সোমবারের মেলার নতুন বই : বাংলা একাডেমির জনসংযোগ উপবিভাগের তথ্যমতে, গতকাল অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৮তম দিনে নতুন বই এসেছে ১৩৯টি। এর মধ্যে গল্প ২৫টি, উপন্যাস ১৯টি, প্রবন্ধ ৫টি, কবিতা ৪৭টি, গবেষণা ২টি, ছড়া ১টি, শিশুসাহিত্য ৫টি, জীবনী ৩টি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ১টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞান ৪টি, ভ্রমণ ১টি, ইতিহাস ৩টি, স্বাস্থ্য ১টি, রম্য ৩টি, ধর্মীয় ২ট, সায়েন্স ফিকশন ১টি এবং অন্যান্য ১৪টি। এদিনের উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে-আগামী প্রকাশনী থেকে হাসনাত আবদুল হাইয়ের শিল্পকলা বিষয়ক গ্রন্থ ‘শিল্পকলার নান্দনিকতা’, রাবেয়া বুক হাউজ থেকে সেলিনা হোসেনের ‘মেয়রের গাড়ি’, কথাপ্রকাশ থেকে মুস্তাফিজ শফির কিশোর উপন্যাস ‘ভূতকল্যান সমিতি’, জোনাকী প্রকাশনী থেকে সৌমিত্র শেখরের ‘একুশের সংকলন পরিচিতি ও গুরুত্ব’ ইত্যাদি।
সোমবারের গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চের আয়োজন:
এবারের গ্রন্থমেলার ১৮তম দিন সোমবার বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘কবি বেলাল চৌধুরী: শ্রদ্ধাঞ্জলি’ শীর্ষক আলোচনা। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি পিয়াস মজিদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি জাহিদুল হক, দিলারা হাফিজ এবং তারিক সুজাত। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি রবিউল হুসাইন।
প্রাবন্ধিক বলেন, বেলাল চৌধুরীর কবিতা অনুধাবন করতে হলে তার নাক্ষত্রিক জীবনের পরিচয় লাভও জরুরি; যিনি অতি অল্প বয়সে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাহিত্যধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্রমশ এক বিশাল শিল্পজগতের ক্ষুধা অনুভব করেছেন তার অন্তর্গত সত্তায়। ফলে পঁচিশ বছর বয়সে কলকাতা গমন করে অতি সহজেই সেখানকার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিবেশের অনিবার্য চরিত্র হয়ে ওঠেছেন। কবিতাচর্চা, কৃত্তিবাস পত্রিকা সম্পাদনা এবং আরও নানাবিধ কিংবদন্তির জন্ম দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেও তিনি নিজ সত্তার বিচিত্রমাত্রিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার কবিতায় আমরা খুঁজে পাই স্বগতোক্তির মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজের নিপুণ ময়নাতদন্ত। কবিতাকে তার আদিম ভৌতসত্তায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি কাজ করে গেছেন নিরন্তর। এছাড়া তার অসাধারণ গদ্যগুচ্ছ এবং অনুবাদকর্ম আমাদের সাহিত্যে এক স্বর্ণাভ সংযোজন হয়ে রয়েছে।
আলোচকবৃন্দ বলেন, বেলাল চৌধুরী সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব যিনি তার কবিতা ও জীবনকে করে তুলেছেন অদ্বৈত। তিনি বাংলা ভাষায় লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের একজন পুরোধা অনুবাদক। সাংগঠনিক দক্ষতায় এবং উদারহৃদয় মানসে তিনি ঋদ্ধ করেছেন ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্যভুবনকে। তারা বলেন, বেলাল চৌধুরীর সাহিত্যকর্মের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পেতে হলে তার রচনাবলি প্রকাশ অত্যন্ত জরুরি।
সভাপতির বক্তব্যে রবিউল হুসাইন বলেন, বেলাল চৌধুরী একজন কিংবদন্তির নাম। কবিতা, গদ্যচর্চা, সম্পাদনা, সাংগঠনিক দক্ষতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যসংস্কৃতিভুবনে তিনি পরিণত হয়েছেন একজন অনিবার্য নক্ষত্রে। তার জীবনের মতোই বিচিত্র-বর্ণিল-ব্যতিক্রম তার কবিতা ও সামগ্রিক শিল্পশস্য।
আলোচনা শেষে একই মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন কবি দিলারা হাফিজ, রেজাউদ্দিন স্টালিন, ফরিদ আহমেদ দুলাল, রহিমা আখতার কল্পনা এবং মতিন রায়হান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন ইকবাল খোরশেদ এবং সায়েরা হাবীব। পুথিপাঠ করেন জালাল খান ইউসুফী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ভাবনগর ফাউন্ডেশন। এছাড়া সায়িক সিদ্দিকীর পরিচালনায় পরিবেশিত হয় পালাগান ‘নোলকজানের পালা’।
‘লেখক বলছি…’ মঞ্চের আয়োজন:
এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমবারের মতো সংযুক্ত হওয়া ‘লেখক বলছি…’ মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়ে পাঁচ লেখকের নতুন বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নেন মুস্তাফিজ শফি, শোয়াইব জিবরান, মুহাম্মদ শামসুল হক, মলয় বালা।
শিশুকিশোর চিত্রপ্রদর্শনী:
অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রতিবছর শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। এ বছর প্রথমবারের মতো ২০০৮ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিগুলো নিয়ে বাংলা একাডেমির ড. মুহম্মদ এনামুল হক ভবনের দ্বিতীয় তলায় একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টায় প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। মেলার শেষ দিন পর্যন্ত চলবে এই প্রদর্শনী।
সারাবাংলা/এমআরপি