Monday 16 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বইমেলার মায়াধুলো 


২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১২:০০ | আপডেট: ১০ মে ২০২২ ১৫:১৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কিযী তাহনিন ।।

মনে পড়ছেনা। হঠাৎ করে পায়ের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের জন্য ভুলে গেলাম জুতো জোড়ার রং কি ছিল, কালো নাকি গাঢ় বাদামি? পা ভর্তি ধুলো। পা দুটো নেড়ে ধুলো ঝেড়ে দেখলাম জুতোর রং আসলে ফ্যাকাশে কালো ধরণের। আবার পায়ে ধুলো মাখিয়ে হাঁটি।

সবাই হাঁটছে।  তাড়া নেই কোনো।  কেউ ক্লান্ত নয়, শ্রান্ত নয়, ভ্রান্তও নয়।  সবাই খুব ধীর ও নয়।  চঞ্চল।  কিন্তু সে চঞ্চলতায় ছন্দ আছে। লক্ষ্য আছে। রাস্তার ধারের মূল ফটক থেকে ঢোকবার পর, সবার যাত্রা একই উদ্দেশ্যে, পথ একটাই।  মূল রাস্তায় ঢোকবার মুখে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। গেটের কোণায় সাজানো চাকাযুক্ত চেয়ার।  বাহ্। যে হাঁটবেন না, পারবেননা, সেও হাঁটবেন মনের পথে, চাকাযুক্ত চেয়ারে মেলায় মেলায়। কেউ থেমে নেই। সবাই তবে যুক্ত এই বসন্তপথে, বইমেলায়।

বিজ্ঞাপন

‘একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’, ‘আহা  আজি এ বসন্তে’র টুকরো সুর – যেন ফেব্রুয়ারির এক সরল সুরেলা কোলাজ। কানে ভেসে ভেসে আসে। দুটো পথ, এক মেলা, দুটো শাখা। শুরু করলেই হয় একখান থেকে। ছেলেমানুষি জাগে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা করি, কোন পথে আগে? ঢুকে পড়ি একটিতে।

নতুন বইয়ের গন্ধ। এ সুঘ্রাণের সাথে ভালোবাসা জন্মায়নি, পৃথিবীতে এমন কি কেউ আছে? এই সেই মেলা, হাত বাড়িয়ে পুরো পৃথিবী ছোঁয়া যায় যেখানে। রাজনীতি, অর্থনীতি, জীবননীতি, ভালোবাসা, সংসার, মহাকাশ, দেশ-মহাদেশ- সব ছোঁয়া যায় এখানে।  টুক করে আনকোরা নতুন বইটিকে সদ্য ফোঁটা বেলি ফুলের মতন, আলতো করে হাতে নিয়ে, মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেয়া যায় এখানে।

এমন কি কেউ আছে, হেঁটে যাবার পথে নতুন বইয়ে মুখ ডুবিয়ে সে ঘ্রাণ খুঁজেননি?  বইয়ের পাতার ফাঁক দিয়ে প্রিয় কবিকে হেঁটে যেতে দেখেননি? ধুলো ভরা পায়ে, হাঁটতে হাঁটতে, প্রিয় গল্প খুঁজে বেড়ান নি?

সেদিনও আমার পা’দুটো ধুলোয় ভরা ছিল। এখনের মতন তখন আমি এ শহরের এতো বড় রাস্তা ধরে কি করে মেলায় আসতে হয়, জানতাম না। এ শহরটি আমার কাছে তখন অনেক বড় ছিল। আমার এক হাত বাবার আঙ্গুল জাপ্টে ছিল। আমার জামার কোণ মুঠো করা ছিলো ছোট বোনের হাতে। আমরা তখন এমন করেই না হারিয়ে যেয়ে, সবাই মিলে মেলায় গল্প খুঁজতাম। এখনো যেমন খুঁজি।

মনে আছে, পেছন থেকে বাবার নাম ধরে কে ডাকছিলো। বাবা শুনতে পায়নি, আমি পেয়েছি। মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি, এলোমেলো চুলের একজন, হ্যাংলা পাতলা মানুষ।  আমি বাবা কে বললাম, ‘দেখো, তোমাকে ওই লোকটা ডাকে।’

আমি এখন জানি, বাবা কেন এতো উচ্ছ্বসিত ছিলেন ওই এলোমেলো চুলের মানুষটিকে দেখে। প্রিয় মানুষকে বহু বছর পর দেখলে, প্রথম প্রকাশিত অনুভূতি হলো উচ্ছ্বাস। তাই বাবা উচ্ছ্বসিত ছিলেন। আর এলোমেলো চুলের মানুষের এক গাল হাসিতে আমরা দু’বোন কি ভীষণ সম্মোহিত হয়েছিলাম, তা এখনো মনে আছে।

বাবা গল্প করছেন তাঁর সাথে।  আমরা অস্থির।  আমরা তো পেছনে দাঁড়িয়ে আছি।  কত দেরি হচ্ছে।

বাবা আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “উনাকে চেনো?”

আমরা তখন সহজ ছিলাম। কাউকে না চিনলে যে জীবনে কোনো সমস্যা হতে পারে, এটা আমরা জানতাম না। আমরা দুই বোন ছন্দ মিলিয়ে দু’পাশে মাথা নেড়ে জোর গলায় ‘না’ বলেছিলাম। ‘চিনিনা।’

বাবা হেসে দিয়েছিলেন। এলোমেলো চুলের সুন্দর হাসির মানুষটি ও।

বাবা বললেন, ‘এই যে তোমাদের হাতে যে বই, ইনি সেই বইয়ের লেখক।’

আমরা বইয়ের দিকে তাকাই। সেই মানুষটির দিকে আরেকবার। তখন আমাদের আনন্দের এক মাত্র প্রকাশ ছিল মাত্রাহীন চিৎকারে, ‘জাফর ইকবাল!!!’

এক মুহূর্ত দেরি করিনি, বই তাঁর দিকে বাড়িয়ে বলেছিলাম, ‘অটোগ্রাফ অটোগ্রাফ।’

সুন্দর হাসির মানুষটি আমাদের বলেছিলেন, ‘আমার বই কিনে টাকা খরচ করছো কেন? কি বই লাগবে আমাকে বলবে। আমি তোমাদের দিয়ে দিবো।’

ব্যাস। আর কি। আজ পর্যন্ত বইমেলার গল্পের আসর বসলে, ভান্ডার থেকে প্রিয় এসব গল্পকে বের করে এনে, ঝেড়ে মুছে নতুন করে গুছিয়ে রাখি।  হাত পা নেড়ে, কত প্রিয় মানুষকে সেই গল্প শুনিয়েছি।

তখন আর এখন।  বদলেছে কতকিছু।  সবকিছুই।  তারপরও তো। এখনো নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পাই, এখনো মেলায় গল্প খুঁজি। এখনো চোখের কোণ দিয়ে প্রিয় লেখকের দীপ্তময় হেঁটে যাওয়া দেখি। এখনো হাত ভরা বই, পা ভরা ধুলো। বইমেলার মায়াধুলো।

 

সারাবাংলা/পিএম

 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর