Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইতিহাসের অনবদ্য দলিল ‘একাত্তরের জলপুত্র’

রহিম উদ্দিন
১৮ মার্চ ২০২৩ ২০:৫১

‘জেলে পাড়ার ক্রন্দন ধ্বনি কখনো থামে না, ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে, এইখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না’ কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবেই কথাগুলো লিখেছেন ‘পদ্ম নদীর মাঝি’ উপন্যাসে। সে এক জেলে পাড়ার করুণ কাহিনি, যা আমাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে আমৃত্যু। এরপর আরও কত অমাবস্যা পেরিয়ে গেছে; আজ অবধি কেউ সেই জেলে পাড়ার নতুন কোনো গল্প আমাদের বলেনি।

সদ্য সমাপ্ত একুশে গ্রন্থমেলা-২৩ থেকে সংগ্রহ করলাম, একজন জেলে মুক্তিযোদ্ধার জীবনভিত্তিক বই, ‘একাত্তরের জলপুত্র মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস।’

বিজ্ঞাপন

লেখক রশীদ এনামের এ বইটি হাজার বছরে অস্পর্শ্য যে জেলে, জেলে জীবন, জেলে পাড়া ও সমাজ; তাদেরই এক জলপুত্রের মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণ ও জীবনবৃত্তান্ত এবং পরিবারের আর্থিক টানপোড়নের বই। মুক্তিযোদ্ধা জলপুত্রের এ জীবনী, কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের মতো পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে থাকতে না পারলেও একবার যে অবলীলায় ছুঁয়ে যাবে এতে সন্দেহ নেই।

মুক্তিযোদ্ধা সুনীল জলদাসের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়, এ বাংলাদেশেই! চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা সদরের পাশে, গ্রামটির নাম করল গ্রাম। ওদের বাড়ির পথে যেতে যেতে দেখবে, রাস্তার পাশে শত বছরের বটবৃক্ষটি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছের চারিদিকে লালবর্ণের কাপড়, লাল সুতা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সবুজ যে লতাপাতা চারপাশে জড়িয়ে আছে, তারা যেন লাস্যময়ী বালিকা। বটগাছের পাশে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মন্দির। একটু দূরেই পাকুর গাছ, গাছের ডালে রশি দিয়ে বানানো দোলনায় দুলছে দুজন ষোড়শী জলকন্যা। এমনই অপরূপ করল গ্রামের মেঠোপথের বর্ণনা দিয়ে শুরু হয়েছে জলপুত্র সুনীল এর গ্রামের পরিচয় ও জীবনগাথা।

বিজ্ঞাপন

গ্রামের গাছ-গাছালি, পথঘাট ও শৈশবের অন্যান্য দৃশ্যের মনোমুগ্ধকর চিত্রপট আবারও ছবির মতো দেখতে হলে বইটি পড়ার বিকল্প নেই। বইটি যেমন জলপুত্র সুনীলের জীবনী একইভাবে টেগরপুনি বুড়ো গোসাঁই বৌদ্ধ মন্দির ও বাকখালীসহ অসংখ্যা নদীর ইতিহাস বয়ানে ভরপুর।

করল গ্রামের জেলেপুত্র সুনীলের মুক্তিযুদ্ধ যতটা সংগ্রামী তার চেয়েও বেশি সংগ্রাম করতে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য। এ যুদ্ধে জেলে পাড়ার সবার। যা আজও বন্ধ হয়নি, কান্নার ধ্বনির মতো। সুনীলের ছোটো বেলার যে সংগ্রামী জীবন বইটিতে ফুটে উঠেছে, সেখানে দেখা যায়; পয়সাওয়ালা উঁচু শ্রেণির মানুষের ঘৃণ্য এক চরিত্র। সুনীলসহ ওর বাবা যামিনি একদিন বাজারে মাছ বিক্রি করতে গেলে দেখে, সেখানে এক লোক তার বাবাকে বলছে,  ‘অই যামিনি, ওডা বড় মাচছো থইলেত ভরি দে, নইলে তোর ফোয়ারে দি বাড়িত পাডাই দিস।’

এমনকি সুনীলের ছেলের বয়ানে উঠে এসেছে, স্বাধীন দেশেই মুক্তিযোদ্ধা সুনীল মাছের টাকার জন্য চট্টগ্রামের বিবির হাটে আরেক আড়তদার মাছ বিক্রেতার হাতে মার পর্যন্ত খেয়েছে। জেলেদের সঙ্গে এ আচরণ এ দেশ স্বাধীনের আগেও ছিল; এখনও আছে। যামিনির, দাদা, বাপ, যামিনী, সুনীল, সুনীলের ছেলে নিখিল, এরপর সুনীলের নাতি বংশ পরম্পরায় তারা আজও সমাজের নিচুস্তরেই পড়ে আছে, মার খাওয়ার দলে। ছলে-বলে কৌশলে মহাজনদের বংশধরেরা তাদের শোষণ ও নির্যাতন করে যাচ্ছে।

এমন এক সংগ্রামী জেলে জীবনই সুনীলকে করেছে একাত্তরের জলপুত্র মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস। বইয়ের পাতায় পাতায় সুনীলের পরিবারের সদস্য ও সহপাঠীদের বয়ানে বার বার উঠে এসেছে হৃদয়বিদারক ঘটনা। বইটা এখানেই সর্বজনীন পাঠ্য হয়ে উঠেছে, সামাজিক কষাঘাত ও সংগ্রামে।

নির্যাতিত নিপীড়িত সুনীলের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মূলমন্ত্র ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্সের ভাষণ। সে ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে সুনীল কান্তি মা-মাটির টানে, ভারতের দেমাগী গিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করে।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার, জাফর আলী হিরুর মতে, সুনীল ১নং সেক্টরের ৩ নং গ্রুপ, অর্থাৎ আবু তাহের খান তথা ১৫৪ নং দোহাজারি গ্রুপের অধীনে যুদ্ধ করে। যুদ্ধের সময় তিনি ও তার দল চন্দনাইশ থানার হাসিমপুর গ্রামের পুর্ব সীমান্তে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালায়। পরবর্তীতে তারা একইসঙ্গে ১১ নং সেক্টরেও যুদ্ধ করে। সুনীল জলদাসের এসব সাহসী কর্মকাণ্ডের বয়ান উঠে আসে তার সহযোদ্ধাদের মুখে। এমন অসংখ্য যুদ্ধকালীল অপারেশন ও স্বাধীন দেশে সুনীলের ফিরে আসার বিভিন্ন ঘটনাকে তুলে ধরেছেন লেখক রশীদ এনাম। তা না হলেই, আমাদের আর কখনোই জানা হতো না; এমন এক জলপুত্রের কথা; যে অভাব অনটন পিছনে ফেলে যুদ্ধ করেছে নিজের দেশমাতৃকার জন্য।

বিনিময়ে তিনি কী পেয়েছেন, সে বিষয়েও লেখক আলোকপাত করেছেন। সে সব বয়ান আর নিদারুণ কষ্টের। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও অভাব অনটনের সংসারে চিকিৎসাভাবেই বিদায় নিয়েছেন, ইতিহাসের এ উজ্জ্বল বরপুত্র।

পাঠান্তে বইটির লেখকের সঙ্গে এটিই আশাকরি, গৃহহীন, ভুমিহীন সুনীলের পরিবারও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত একটা ঘর পাবে। সুনীল জলদাসের জীবনভিত্তিক বইটি এসব বিষয় বিবেচনায় হয়ে উঠতে পারে ইতিহাসের দলিল, যা আমাদের অবশ্যই পড়া উচিত।

‘একাত্তরের জলপুত্র মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস’ বইটি কোন ঘরানার- তা লেখক কোথাও উল্লেখ না করলেও এটা যে, জীবনভিত্তিক উপন্যাস তাতে সন্দেহ নেই। বইটিতে উঠে এসেছে, ইতিহাস ও মিথের পাশাপাশি জেলে জীবনের করুণ পরিণতি ও বাস্তবতা। জেলেদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জাল, যেমন বিহিন্দি জাল, বেদ জাল, ঝাঁকি জাল, ডুগ জাল ও জোঁইর সহ বিভিন্ন লোকজ উপকরণের কথা; যা আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে। বইটির যেমন জীবনভিত্তিক বর্ণনা তেমন সাহিত্যরস-সম্বৃদ্ধ করতে লেখকের আপ্রাণ প্রচেষ্টা ছিলো, তবে দুয়েক জায়গায় আঞ্চলিকতার বয়ান তুলে ধরতে গিয়ে স্বাভাবিক লেখার মধ্যেও বানান বিভ্রাট সৃষ্টি হয়েছে।

মোমিন উদ্দীন খালেদ অংকিত দারুণ প্রচ্ছদ ও জীবনভিত্তিক ছবি সংবলিত বইটি প্রকাশ করেছেন শৈলী প্রকাশন, যার মুদ্রিত মূল্য ২৮০ টাকা। পাঠক, বইটি কিনুন, পড়ুন। বইটি এমন যে, আপনি পড়া শুরু করলে; শেষ না করে থামবেন না!

সারাবাংলা/একে

একাত্তরের জলপুত্র একুশে বইমেলা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর