ক্ষমতার আবর্তে বাঙালির পোশাক
৩১ মে ২০২০ ২১:০৩
নববর্ষ, নবান্ন, বসন্ত- এই ধরনের উৎসবে আজকের বাংলা ভূখণ্ডের বাংলা ভাষাভাষী সব ধর্মের নারী-পুরুষ চেষ্টা করেন বাংলা সংস্কৃতিকে ধারণ করতে। খাবারে, পোশাকে, সাজসজ্জায় বাঙালিয়ানাকে তুলে ধরতে। কেউ কেউ মাটির বাসনে খাবার সাজায়। ধর্ম, বর্ণের উর্ধ্বে এ যেন এক মহামিলন। আজকের বাঙালি নারী সাজে শাড়ি ও সালোয়ার-কামিজে আর পুরুষ পরে পাজামা-পাঞ্জাবি, ধুতি ইত্যাদি। আরও মাটির কাছাকাছি যেতে কেউ পরে লুঙ্গি।
১৮৭৪ সালে রাজনারায়ন বসু তার ‘সেকাল আর একাল’ গ্রন্থে বলেছেন, “বাঙালির কোন নিজস্ব পোশাক নেই।” ১৮৮৫ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিলেত থেকে এসে বলেছেন, “গুটিকতক শিক্ষিত যুবক মেটে বাঙালি না হয়ে অশিক্ষিত লক্ষ লক্ষ কৃষক ও ব্যবসায়ী জাতির মূল হয়, তাহা হইলে দুঃখের সহিত বলিতে হইবে, বাঙালির কোনই পোষাক নাই।”
কথাটি তিনি বাঙালির পোশাকের দৈন্যতা অর্থে বলেছেন কিন্তু আমার এই প্রসঙ্গে কিছু বলার আছে। পোশাকও যে ক্ষমতার হাতে পড়ে, আমরা এই বিষয়টি কি কখনো ভেবে দেখেছি? দ্বিজেন্দ্রলাল রায়সহ প্রায় সব ভারতবর্ষীয় পন্ডিতগণ যাদের বিলেত বা অন্য দেশ দেখার সুযোগ হয়েছিল তারা বাঙালির পোশাক নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। আর তাদের সকলকেই আমার কাছে মনে হয়েছে তারা অন্য দেশের প্রভাবশালী সংস্কৃতি দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন। কারন শাড়ির মতো একটি বস্ত্র আদিমকাল থেকেই বাঙালি নারী পুরুষ উভয়েই পরে আসছে। যুগে যুগে তার পরার ধরণে ও নামে পরিবর্তন আসলেও শাড়ির পরিচয়টি আদি ও অকৃত্তিম থেকে গেছে।
কিভাবে? আসছি সেই ব্যাখায়। বাংলা ভূখণ্ডের পোশাকের আদি রূপ খুজঁতে গেলে যেতে হবে মুসলিম শাসনের আগের সময়টাতে। বাংলায় মুসলিম শাসনের অব্যবহিত পূর্বে শাসক ছিল সেন বংশ। সে যুগে পুরুষের পোষাক ছিল ধুতি, উর্দ্ধাঙ্গে উত্তরীয়। নারীর ছিল শাড়ি। নারীর উর্দ্ধাঙ্গে তখনও কোন পোশাক চালু হয়নি। শাড়ি শব্দটির উৎস শাট বা শাটক থেকে শাটিকা শব্দ থেকে। এর অর্থ হল সরু দৈর্ঘ্যের জোড়া দেয়া কাপড়। আচার্য সুকুমার সেনের মতে, বাংলায় তাঁত যন্ত্রের আবির্ভাবের আগে এই জোড়া দেয়া কাপড়ের প্রচলন ছিল। মলয় রায় “বাঙালির বেশবাস” গ্রন্থে লিখেছেন, সুকুমার সেনের বক্তব্য অনুসারে আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় ধুতি ও শাড়ির মধ্যে কোন গুরুতর লিঙ্গভেদ সেকালে মানা হত না।মুসলমান শাসন আমলে শাড়ির সাথে কাঁচুলির চল পাওয়া যায়।
ধুতিই ছিল বাংলার পুরুষের একমাত্র পোশাক। মুসলমান শাসন আমলে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের পোশাকে যোগ হয় পাজামা। প্রতিষ্ঠাবান পুরুষরা ঘরে ধুতি পরতো কিন্তু শিষ্টমন্ডলীতে আসার সময়ে পাজামা পরেই আসতেন। নিম্নবর্গের মুসলমান পুরুষরা ধুতিই পরতো। পোশাকের সঙ্গে যে ক্ষমতার একটা সরাসরি যোগাযোগ আছে তা আমরা মুসলিম শাসন আমলের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পোশাক দেখলেই ধারনা পাই। রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) বিশিষ্ট হিন্দু পরিবারের শিক্ষিত ও সন্মানিত সন্তান। ততদিনে মুসলিম শাসনের প্রভাব সংস্কৃতিতে পোক্ত অবস্থান নিয়েছে। পাগড়ি, জোববা সদৃশ জামা, পাজামা- এগুলো সরকারী শিষ্টজনের পোশাক। কালক্রমে ইংরেজরা যখন মসনদে বসলো তখন থেকে শিষ্টমন্ডলীতে যাওয়ার পোশাকে শার্ট, প্যান্ট, কোট যোগ হয়। রবীন্দ্রনাথকেও বিলেত যাওয়ার জন্য সভ্য পোশাক বানাতে হয়েছিল।
নারীরা যখন ঘর ছেড়ে বাইরের সমাজে পুরুষের সঙ্গে আসতে লাগলো তখন তো আর উর্দ্ধাঙ্গ খালি রেখে বের হওয়া চলে না। পোশাকে যোগ হলো পেটিকোট ও উপরে পরার জামা, জ্যাকেট যা পরবর্তীতে ব্লাউজে রূপ নিল। বাঙালির লুঙ্গি পরার ইতিহাস কিন্তু খুব বেশিদিনের নয়। এমনকি এই পোশাকটি আদৌ বাংলা ভাষাভাষীর পোশাক ছিল না। শ্রীলঙ্কা, তামিল ও বার্মায় এর ব্যবহার ছিল। সেই সাথে আরবীয়রা এদেশে লুঙ্গি সদৃশ সেলাই ছাড়া তমুদ্দন আনে যা এদেশের মুসলমান পুরুষরা গ্রহন করে। সেই থেকেই লুঙ্গির বাংলা ভুখণ্ডে প্রবেশ।
কোন একটি এলাকার পোশাক তার আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। কোন কিছুর আদি ও অকৃত্তিমতাকে খুঁজতে গেলে তার স্থানিক ইতিহাসটা জানা জরুরি। এই বাংলায় আবহাওয়া গরম ও উষ্ণ। তাই এই এলাকার মানুষের পোশাক ছিল হালকা সুতিবস্ত্র। পৃথিবীর যে দেশগুলো শীতপ্রধান বা চরম উষ্ণ (জাপান, লন্ডন, ইরান, তুরান) তাদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখাই ছিল চল। আজ যখন সেই সব দেশ পৃথিবীময় কর্তৃত্ত্ব করে যাচ্ছে তখন তাদের পোশাকই আমাদের কাছে সভ্য মনে হচ্ছে। আমাদের দেশে এভাবেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শাসকদের কারণে দেশে পোশাকের বৈচিত্র্য ঢুকেছে। একারনেই ইতিহাসবিদদের বাঙালির পোশাক নিয়ে আক্ষেপ।
কিন্তু বাঙালির পোশাক যে বারে বারে ক্ষমতার যাতাকলে লন্ডভন্ড হয়েছে সেকথা কি আমরা একবারও ভেবেছি! ভাবার সময় কখনো ফুরায় না। ভাবার দরকার আছে বটে!
লেখক: নৃবিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মী