রবীন্দ্র কাব্যে বর্ষা
৬ আগস্ট ২০২২ ১৯:১৭
“বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।”
হ্যাঁ, ভালোবাসার কবি রবীন্দ্রনাথ আমাদের শ্রাবণের গান দিতে এসেছিলেন এবং দিয়েছেনও উজাড় করে। সাপ যেমন সাপুড়ের বীণে মোহাবিষ্ট হয়ে যায়, ঠিক তেমন করে বাঙালিও রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে মোহাবিষ্ট হয়ে আছে। থাকবে অনন্তকাল।
পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে বর্ষা ঋতু স্বাতন্ত্র্য মর্যাদা না পেলেও, এই বঙ্গভূমিতে পেয়েছে। আর বর্ষাকে মোহনীয় করেছেন কবিগুরু তার কাব্যসুধায়। বর্ষা প্রেমের ঋতু। বর্ষার বৃষ্টি ধারা যতটা তীব্র হয়, বাঙালির মনে প্রেমের বীণ ততটাই ঝংকার তুলে। প্রেমে পাগল বাঙালি তখন ছুটে যায় কবিগুরুর নীপবনে। নবধারা জলে স্নান করে বাঙালি খুঁজে পায় প্রেমের সার্থকতা।
বাংলার কাব্য আকাশে কবিগুরুর ছোঁয়া সর্বত্র বিস্তৃত। কিন্তু বর্ষায় কবিগুরুর ছোঁয়া অনেক বেশী সজীব, অনেক বেশী প্রাণবন্ত। বর্ষার বৃষ্টির রিনিঝিনি ছন্দ অথবা স্রোতস্বিনীর পাক খাওয়া তীব্র স্রোত, সবকিছুকেই কবি তার কবিতার ছন্দে এঁকেছেন অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী এবং প্রাঞ্জল করে। এজন্য অনেকেই আভিভূত হয়ে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ মূলত বর্ষা এবং নদীর কবি। যেমন মেঘদূত কবিতায় কবি ফুটিয়ে তুলেছেন বর্ষার মাতাল বাতাসের দুরন্তপনা আর বিজলীর তীক্ষ্ণ রশ্মিকে:
“আজি অন্ধকার দিবা বৃষ্টি ঝরঝর,
দুরন্ত পবন অতি,
আক্রমণে তার বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি, ছিড়ি মেঘ ভার,
খরতর বক্রহাসি শূন্যে বরষিয়া।”
বরষার বৃষ্টি ধারা যখন উচাটন মনকে দোলা দিয়ে যায়। তখন সকল বাঙালিই ফিয়ে যায় কবি গুরুর কাব্য আকাশে। সুর-অসুরের দন্দ্ব ঘুচিয়ে সবাই গেয়ে ওঠে:
“আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে
কিছুতেই কেন যে মন লাগে না…”
অথবা-
“এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়,
এমন মেঘস্বর বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়…”
বর্ষার দিনে সব কেমন যেন স্থবির হয়ে পড়ে। সে কথা বলেছেন, ‘অপেক্ষা’ কবিতায়-
“মেঘেতে দিন জড়ায়ে থাকে মিলায়ে থাক মাঠে,
পড়িয়া থাকে তরুর শিরে,
কাঁপিতে থাকে নদীর নীড়ে,
দাঁড়ায়ে থাকে দীর্ঘ ছায়া মেলিয়া ঘাটে বাটে।”
মোদ্দা কথা, পদ্মা-যমুনার জল যেমন এক হয়ে মেঘনা ধারা নামে বয়ে চলে, ঠিক তেমনই বর্ষা আর রবীন্দ্রনাথের কবিতাও একই ধারায় প্রবাহিত হয়। বর্ষার বৃষ্টিতে শরীর জুড়ায় আর কবিগুরুর বর্ষার কবিতায় মন জুড়ায়।
শুধু কি কবিতায়! কবিগুরু তার গদ্য লেখায়ও বর্ষায় বর্ণনা দিয়েছেন অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহীভাবে। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ বর্ষায় নিস্পন্দ বাংলাদেশের থমকে দাঁড়ানো রূপটি এঁকেছেন এভাবে:
“বন্যার সময়ে গোরুগুলি যেমন জলবেষ্টিত মলিন পঙ্কি সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠ প্রাঙ্গণে মধ্যে ভিড় করিয়া করুণ নেত্রে সহিষ্ণুভাবে দাঁড়াইয়া শ্রাবণের ধারা বর্ষণে ভিজিতে থাকে, বাংলাদেশ আপনার কর্দম-পিচ্ছিল ঘনসিক্ত রুদ্ধ জঙ্গলের মধ্যে মূকবিষণ্ণমুখ সেইরূপ পীড়িতভাবে অবিশ্রাম ভিজিতে লাগল। চাষিরা টোকা মাথায় দিয়া বাহির হইয়াছে; স্ত্রীলোকেরা ভিজিতে ভিজিতে বাদলার শীতল বায়ুতে সঙ্কুচিত হইয়া কুটির হইতে কুটিরান্তরে গৃহকার্যে যাতায়াত করিতেছে ও পিছল ঘাটে অত্যন্ত সাবধানে পা ফেলিয়া সিক্তবস্ত্রে জল তুলিতেছে এবং গৃহস্থ থাকিলে কোমরে চাদর জড়াইয়া, জড়ো হস্তে, ছাতি মাথায় বাহির হইতেছে অবলা রমণীর মস্তকে ছাতি এই রৌদ্রদগ্ধ বর্ষাপ্লাবিত বঙ্গদেশের সনাতন পবিত্র প্রথার মধ্যে নাই।”
এসব অমর সাহিত্য কবি রচনা করেছেন বর্ষাকে ভালোবেসে। বর্ষাও তার প্রতিদান দিয়েছে কবিকে ভালোবাসার মাধ্যমে। সে ভালোবাসার প্রকাশ হয়েছে বর্ষার দিনে কবির পরলোক গমনের মাধ্যমে। ২২শে শ্রাবণের আনন্দ অশ্রুতেই কবির বিদায় হয়েছে। কিন্তু বর্ষা নিয়ে আমাদের মনের সকল অনুভূতিই তিনি রচনা করে রেখে গেছেন। আর এই সাহিত্য সম্পদ নিয়েই প্রজন্মের পর প্রজন্ম কবিকে রোমন্থন করছে। এ ধারা চলমান থাকবে অনন্তকাল। কারণ কবিগুরুর সাহিত্য বাদ দিলে তো বাঙালির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি