মা এবং কতিপয় কুকুর কাহিনি
২৪ মে ২০২৩ ১১:২১
অবশেষে বুধবার দুপুরে অত্যন্ত মর্মন্তুদ আর নৃশংস ঘটনা ঘটে গেল। এপ্রিলের তীব্র রোদ। আকাশ খাঁ-খাঁ করছে। সেখানে অনেক উঁচুতে একটি-দুটি চিল, এমনকি নিচে এই যে আশপাশের দেয়ালেও কোনো পাখি নেই, শুধুমাত্র একটি কাক নিমগাছের মধ্যভাগে বেছুট এগিয়ে যাওয়া এক শাখার ছায়া ছায়া অন্ধকারে বসে ব্রয়লারের নাড়িভুঁড়ি ধরে টানাটানি করছে। সেও বোধকরি কিছু দেখেনি। দোকানগুলো খোলা। কখনো আচমকা বাতাসে ধুলো ধেয়ে যায়। কিশোরী মেয়েটি তার অসম্ভব ক্লান্ত, কে জানে বড় অনিচ্ছুক-বেপরোয়া, মুনশিপাড়া মসজিদের সামনে দিয়ে দক্ষিণে এগিয়ে যেতে থাকে, তার পেছনে পেছনে তিন কিংবা আরও কিছু বেশি বয়সি শিশুটি পৃথিবীর সকল ঐশ্বর্য-হাসি-আনন্দের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষুধায় শ্লথ-কাতর, কৌতূহলি দৃষ্টি তুলে এপাশ-ওপাশ দেখতে দেখতে মাকে অনুসরণ করে হেঁটে যাচ্ছিল; তখনই ঘটে ঘটনা। কেউ কেউ না দেখলেও অথবা দেখে থাকলেও এগিয়ে আসেনি। ততক্ষণে সাদা-কালো আর ঘি রঙে মিশেল কুকুরটি শিশুটির কান ছিঁড়ে ফেলেছে। ছোট্ট বুকের ওপরটা পায়ের নখরের খামচানো গভীর ক্ষত। শিশুটির গাল বেয়ে রক্ত নেমে কাঁধ-পেট লালময় করে দিতে থাকে আর তীক্ষ্ণ চিৎকারে ঘুরে তাকায় তার মা। সে খুব অসহায় চোখে মুহূর্তমাত্র তাকিয়ে দেখে কী করবে বা কী করা উচিত দ্বন্দ্বে হতবিহ্বল; শিশুটি আচমকা আছড়ে পড়ে তপ্ত রাস্তায়। ইতোমধ্যে এদিক-ওদিক দোকান থেকে কিছু মানুষ ছুটে এসেছে। কেউ একজন শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়, কেউ কুকুরের দিকে কিছু ছুঁড়ে দেওয়ার মতো আগ্রাসী হাত তোলে, কারও মোবাইলের ফ্লাশ ঝলসে উঠতে উঠতে ম্লান হয়; আর এরই মধ্যে দু-একজন মেয়েটির অবেহলা নিয়ে বকাঝকা শুরু করে দেয়। এই ছোট্ট ঘটনাটির ব্যাপ্তী মিনিট দুই-তিনের বেশি হবে না। মানুষজন দেখে শিশুটির শুকনো ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে রক্তের ছোপ চুইয়ে পড়ছে আর কানের লতি ছাড়া উপরের অংশটুকু নেই। শিশুটি কোল থেকে নিচে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না; তার মা কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে। সে তখনো আকস্মিকতার ঘোর থেকে বেরোতে পারে না। এদিক-ওদিক অসহায় তাকাতে থাকে। কেউ একজন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ডেকে তাদের দু-জনকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে যেতে তাড়া দেয়। এরপর ধীরে ধীরে ভিড় কমে গেলে শুরু হয় গল্পের আলাপ। কেউ একজন বলে উঠে, ‘স্ট্রিট প্রস্টিটিউট। শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কোথাও আঁচল পেতে ভিক্ষে করে। রাত গভীর হলে অন্ধকার-নির্জন দোকান বারান্দা বা বড়মাঠের ওদিকে ব্যবসা।’
‘কী বলছিস তুই? তবে হ্যাঁ একে দেখেছি মনে হয়।’
‘সে তো বেশ ক-মাস আগের কথা। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নিচে ভিক্ষে করত।’
‘এই কি সেই মেয়ে?’
‘সেই মেয়েই…ওর নাম কপিলা।’
‘এসব তুই জানিস কীভাবে? একেবারে মানিক বন্ধোপাধ্যায়ের কপিলা!’
‘তেমনই তো বলত! দিনের বেলা ভিক্ষে, এর-ওর ফাইফরমাস; রাতে কেউ কেউ টেনে নিয়ে যেত না কে বলবে?’
‘আহা কি করুণ জীবন! কার বাচ্চা কে জানে!’
‘এসব মায়া দেখালে চলে না। এখন বাচ্চাটা বাঁচবে কিনা কে জানে! কুকুরের কামড়। কয়েকটি ভ্যাকসিন দিতে হয় শুনি। জলাতঙ্ক হলে শেষ।’
‘আহা রে!’
‘এসব শিশুর কোনো পরিচয় হয় না। জারজ।’
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এমন বিবিধ খবরাখবর আলাপের মধ্যেই রিকশা টার্ন নেয়। কিশোরী মেয়েটি যার পরিচিতি মা, কোলে ধরে থাকা শিশুটিকে নিয়ে খুব অসহায়ের মতো মানুষগুলোর দিকে, আবার আত্মজার দিকে তাকাতে তাকাতে দক্ষিণে ভেসে যায়। তার অস্থির-কাতর দৃষ্টিতে নতজানু দীর্ঘশ্বাসের ছবি আচমকা তপ্ত বাতাসের ঢেউয়ে দুলে উঠে। তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া নোনা জল শিশুটির গাল আর শরীর বেয়ে ছড়িয়ে পড়া রক্তে মিশে যায়। ফোঁটা ফোঁটা নিচে ঝরে পড়তে থাকে। অটোরিকশার পাদানির স্পেস খুঁজে নেয় অচেনা কোনো মানচিত্র আঁকবার পরিসর।
কিশোরী মেয়েটি আসলেই জানে না তার নাম কপিলা নাকি কী? তবে মনে হয়, অন্য এক নাম ছিল তার, ছোট্ট, সবাই খুব আদর করে ডাকত; সেই ডাক আর মনে পড়ে না। অনেককিছুই ঝাপসা ছায়া ছায়া আবছায়া ছবির মতো কখনো জেগে ওঠে আবার মুহূর্তে মিলিয়ে যায়। তার মা ছিল, বাবা ও কতক বোন। কোথায় ছিল বাড়িঘর জানা নেই। কখনো দমকা বাতাসের মতো ঝলক দিয়ে কিছু দৃশ্য শুধু মনে পড়ে। ভালো লাগে আবার বিষাদে ভরে যায় মন। শহরের চিৎকার-চেঁচামেচি আর অতিব্যস্ত বস্তি। চিকন গলির শেষদিকে দু-খানা ঘর। টিনের চার দেয়াল। গরম। বেশ উঁচু মেঝে। ঘুলঘুলির মতো দুটো জানালা মুখ উঁচিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। উত্তরে খোলামাঠের মতো একখণ্ড জমি। তার প্রায় সবটুকুজুড়ে আবর্জনার স্তূপ। সেই দক্ষিণ দুয়ারি ঘরের সামনে একটি মেহগনি গাছ ছিল। অনেক চকচকে আর ঝাঁকড়া সবুজ পাতা। সেই গাছে দোয়েল আর বুলবুলি পাখি এসে লেজ দোলাত। তারা চারবোন বসে বসে মুড়ি খেতে খেতে পাখিদের এই ডাল থেকে ওই ডালে নাচানাচি দেখে মজা পেত। সে ছিল চুপচাপ শান্ত। তারপরও তাকে কেন এক সকালে অচিন জায়গায় ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল একজন সেটি জানা নেই। অনেকদিন খুঁজে খুঁজে বুঝতে চেষ্টা করেছে, কেন তাকে পরিত্যাগ করেছিল বোরখায় আপাদমস্তক আবৃত খুব চেনা-অচেনা সেই মহিলা…যে ছিল তার মা। অসহ্য হয়ে উঠেছিল তার জীবন? বাবার? কে জানে সকলের।
কপিলা তখন কিছু বোঝে না। সেই স্মৃতির মধ্যে শুধু একটি দৃশ্য নিয়মের মতো বারবার হানা দিয়ে যায়। বাবা প্রতিদিন কাজ শেষে বাড়ি এসে হম্বিতম্বি-তর্জনগর্জন করে। জোরগলায় অশ্রাব্য চিৎকার। মা আর একে-ওকে মারধর। ধস্তাধস্তির আওয়াজ। কান্নার মিহি সুর। মা দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে কি গুটিশুটি লুকিয়ে নিশ্চুপ বসে চোখের পানি ফেলত। আর এভাবেই সন্ধের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পেটের ক্ষুধাও মরে যেত তাদের।
‘মাগি তোর কোলে ছেলি হবি নানে। তুই বাইরায়ে যা। আগের লাঙের কাছে যা। খানকি মাগি। তোর সবকটি মাই, তুই সবগুলাক লই বাইরায়ে যা। ফেলি আয়। কোন চোদ্না সামলাবে এত জঞ্জাল?’
এইসব চিৎকার জোরশোরের অপরদিকে কী কথা, জবাব অথবা নীরব নতজানু অসহায় সমর্পন কে জানে, কেউ জানে না; মা একদিন ভোর ভোর সকালে তাকে নিয়ে কোথাও রওয়ানা দেয়। তখন মানুষজন ঘুম থেকে তেমন ওঠেনি। বেশি দূরের পথ নয় কিংবা কে জানে অনেক দূর সে কথা মনে নেই। রেলগাড়ির গুড়গুড় গুঞ্জন বড় ভালো লাগে। সেখানে মানুষজনের ভিড় কোলাহল। হকারের হাঁকডাক। চা গরম, সেদ্ধ ডিম, ভাজাবাদাম, তাজা আমড়া কত কী আওয়াজ। সে ছিল অদ্ভুত শোরগোল ছন্দের সময়। এরপর আর মনে নেই। মা তাকে রেখে কোথায় চলে গেল, সেই দৃশ্যছবি মনের রেখায় অস্পষ্ট ঝাপসা; সেই একজন, তার মা, বোরখা আবৃত কাঠামো ক্রমশ দূরে মিশে যেতে যেতে অস্বচ্ছ অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন অন্যকোনো ট্রেন এসে সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। বিশাল পাহাড়ের মতো সর্পিল বাধা। সে আর তাকে দেখতে পায় না, যাকে সে খোঁজে; তবু তার কথামতো সিমেন্টের বেঞ্চে বসে থাকে। একলা। সে মানুষজনের ছুটোছুটি দেখে। বিবিধ কথাবার্তা-চিৎকার শোনে। অনেককিছু যা বোঝে অথবা বোধগম্যতার বাইরে। মা আসবে, আসবে মা; কিন্তু মা আর ফিরে আসে না। সেই ভিড় পেরিয়ে পশ্চিমের ছায়ায় দু-চোখ কোথায় ঝাপসা হারিয়ে গেল। কখনো সেই ছবি মনে আসে, কিন্তু চোখে আর জল আসে না।
এরপর অপেক্ষায় বসে থেকে থেকে কখন ছোট ছোট পা ফেলে এদিক-ওদিক যতদূর চোখ যায় ঘুরে ঘুরে খুঁজে দেখেছিল সে। ফেরার পথ হয়তো পেয়ে যাবে, কিন্তু সবকিছু ভয়ংকর গোলকধাঁধা লাগে আর ক্লান্ত করে দেয়। কতক্ষণ আর? আর কত দূর? যে ফেলে যায় সে কি আর ফিরে আসে? এই কথাটিও বিশ্বাস হয় না। তার ক্ষুধা পায়। মা বিস্কুটের প্যাকেট কিনে দিয়েছিল। সেটি খোলে। চোখের পানি গালের উপর শুকিয়ে আঠালো দাগ হয়ে আছে। সে মুখে বিস্কুট তোলে, কিন্তু খেতে পারে না; প্যাকেট হাত থেকে পায়ের নিচে পড়ে যায় আর কোত্থেকে এক কুকুর এসে ছোঁ মেরে নিয়ে দৌড় দেয়। সে কাঁদতে শুরু করে পুনরায়। আকাশে সূর্য অনেক উপরে উঠে গেছে। প্রচণ্ড রোদ ঢেলে দিতে শুরু করে। এরপর কী হয়েছিল মনে নেই। সে কাঁদতে কাঁদতে বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিল। কে জানে সবকিছু দুঃস্বপ্ন ভেবে পালাতে চেয়েছিল কি না। পালাতে চাইলে কি পালানো যায়? একসময় ঘুম ভেঙে যায়। সে কোথায়? এখানে কেন? নিজের কাছেই প্রশ্নের দ্বন্দ্বে কিছু ঠাহর করতে পারে না। স্টেশনের চারিদিক নিরিবিলি শুনশান। কোনো ট্রেন নেই। কোন্দিক থেকে এসেছিল? সে কিছু বুঝতে পারে না। কীভাবে ফিরে যাবে? মা কি আসবে? অনেক দূর দেখতে দেখতে সামনের সবকিছু আরও একবার বারবার অস্বচ্ছ ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে। তখন কেউ একজন চোখের উপর ছায়া ফেলে সামনে দাঁড়ায়। সেই অচেনা মানুষটি হাত ধরে। সে ঘরে ফেরে। নিজের ঘর নয়। সেখানে টিন দেয়ালের প্রচণ্ড গরম ছিল না। দরজার বাইরে কোনো গাছ নেই, যেখানে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাখিরা নাচানাচি করত। উত্তরের বাতাস থেকে থেকে বোটকা দুর্গন্ধ ভাসায় না, আর সে বোনদের সঙ্গে বসে বসে যা দেখত, তারা কেউ নেই; সেটা ছিল অন্য এক ঘর। অচেনা মানুষজন। একেবারে নতুন জায়গা।
অটোরিকশা বুটিবাবুর মোড় হাসপাতাল এলাকায় জমে থাকতে বাধ্য হয়। প্রচণ্ড জ্যাম। ট্রাফিক পুলিশের দু-জন অফিসার খুব কৌশলে যানজট সারানোয় ব্যস্ত। কপিলা বড় অস্থির এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে আরও দিশেহারা হতে থাকে। এরমধ্যে খুব আলগোছে বুক থেকে শিশুটিকে আলগা করে চোখে দেখে নেয়। বেঁচে আছে কি না পরখ করতে বুকের ধুকপুকানি হাতড়ায়। শিশুটির দু-চোখ অর্ধেক বুঁজে রয়েছে। চোখের পাতার সামান্যতম পরিসর দিয়ে দেখে নিতে থাকে পৃথিবীর বেঁচে থাকা মানুষের কোলাহল। অস্থির-চঞ্চল জীবনযাপন। কপিলা কী করে! সে কি সদর হাসপাতাল যাবে নাকি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল? তখন সেই জটলা মুনশিপাড়ার রাস্তায় এই বিতর্ক করেছিল। সেই কথার আওয়াজে নিমগাছের বেছুট শাখায় বসে থাকা কাকটি সব ভুলে সভয়ে উড়াল দেয়। সেই শাখায় ঝুলে থাকে মুরগির নাড়িভুঁড়ি। কেউ বলছিল, –
‘এই ভাই একে একেবারে মেডিকেল হাসপাতাল নিয়ে যান।’
‘কেন কাছেই তো সদর, সেখানেই প্রাইমারি এইড নিক।’
‘না না মেডিকেল যাবেন।’
‘আহা রে কানটা একেবারে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে! কুকুরটা খেয়ে ফেলেছে…শালা মাদারচোদ।’
‘শহরে এত কুত্তা! মেয়র করে কী?’
‘খেলা দেখে খেলা। রাস্তায় প্রকাশ্য গিট্টু লাগা দেখতে কার না মজা লাগে!’
‘সেদিন দেখি এক ছোকরা মোবাইলে ভিডিও করছে। এরা নিশ্চয়ই ফেসবুক নয় ইউটিউবে আপলোড দেয়।’
‘কি দিনকাল এলো! আমরা শালা ক্যামেরায় ছবি তুলেছি। একটা ফিল্মের দাম কি! সেটাতে আবার বারোটার বেশি স্ন্যাপ নেয়া যায় না। তারপর এলো থার্টি সিক্স এমএম। আর এখন দেখ, লাখে লাখে ছবি, ডার্করুমে প্রসেস করতে হয় না। কম্পিউটারে নাও আর প্রিন্ট করো।’
‘টেকনোলজি দাদা টেকনোলজি। এই যে বাচ্চটার কান চলে গেল, এটাও প্লাস্টিক সার্জারি করে অবিকল নতুন বানিয়ে দেয়া যায়।’
‘জি জি!’
‘শোনেন না এক সত্য ঘটনা। রিপ্লিস বিলিভ ইট-এর মতো আশ্চর্যজনক। রাশিয়ায় একবার হয়েছে কি, ঘাস কাটার মেশিনে এক বালকের হাতের কবজি দু-ফাঁক হয়ে গেল। অর্থশালী মানুষ। হেলিকপ্টারে ফ্লাই করল মস্কোর বিখ্যাত হাসপাতাল…।’
‘তারপর…তারপর?’
কপিলার সেই গল্প শোনা হয় না। তার মেয়ের কান নেই। কুকুরে খেয়ে ফেলেছে। সে-সময় অটোরিকশা রওয়ানা দেয়। তখনো কানের লতি বেয়ে টুপ টুপ রক্ত ঝরছে। সে খুব দ্রুত পরনের ত্যানা-ত্যানা ওড়না বুক থেকে টেনে তার কানের ওখানে চেপে ধরেছিল। কপিলার উদোম প্রায় বুকের দীঘলে তখন টলটল করে কারও কারও চোখ। রিকশা এগিয়ে যায়। কপিলার মন ভেসে যায় কোনো মেঘের খোঁজে। কোথাও কোনো মেঘ নেই। সেখানে কিংবা তারও হাজার হাজার মাইল উপরে কেউ কি একজন আছে? তার নাম ঈশ্বর। আজ কপিলা বড় কাতর হাতজোড় একটু করুণা প্রার্থনা করে বসে। কোনোদিন কোনোকিছু আবদার করেনি। এমন কি সেই সেদিনও, যেদিন একজন মা তাকে স্টেশনের প্লাটফরমে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। কোনো টিকিট আর কোন ট্রেনে চড়ে বসবে সে বলে দেয়নি। কেনই-বা তার বিসর্জন? অজানা অব্যাখ্যাত ছিল সেই কাহিনিও। সে তবে নতুন ঘর পেয়েছিল। নতুন বাবা আর মা। একটি নতুন নাম হয় তার। সে নাম মনে আছে। এখন ডাকার মানুষ কেউ নেই। পৃথিবীতে কত নামই তো হারিয়ে যায়। আকাশের তারা সারারাত জ্বলজ্বল করতে করতে কোথায় হারিয়ে যায় কেউ জানে না, বোধকরি এই নিয়ম; কেউ কাউকে মনে রাখে না। আজকাল এমনই মনে হয়। সে স্টেশনে বসেছিল।
তখন কে জানে কী বুঝে নেয় অথবা মন কিছু জানে না…বোঝে না; সেই ছায়ামানুষ খুব আদর করে কথা বলে উঠে। কপিলা খুব ভরসায় হাত ধরে। একজন মহিলা, মায়ের মতো, কিন্তু মা নয়; এসে কোলে তুলে নেয়। কপিলা কিছু বোঝে, অথবা বোঝে না, কিংবা জেনে নেয়, সে হারিয়ে গেছে, কেউ একজন তাকে ফেলে গেছে; সে তার মা। যে মানুষ দু-জন তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল তারা নতুন করে মা-বাবা হয়ে যায়। এরপর আরও একবার পথ হারায় কপিলা। সে তখন বড় হয়েছে। কত বছর হিসাব নেই। নিজের বয়সও জানে না। একরাতে নিজে থেকেই পথে বের হয়ে যায়। ভরসার জায়গা সরে গেছে। সেই স্টেশনে যে বাবা আর মা পেয়েছিল, কয়েক বছরেই সেখানে ক্লেদ জমে গিয়েছিল। তিনজনের ছোট্ট ঘর-সংসার। কপিলার তখন অন্য নাম হয়, যে নামে নিজেকে ডাকে সে, নিজের সঙ্গে কথা বলে; পিউ। পিউ স্কুলে পড়ে। বাড়ির সামনে স্কুল। মা তাকে সাজিয়ে দেয়। তার চুলে তেল মেখে আঁচড়ে বেণি করে। তার কাঁধের দু-পাশে নীল ফিতেয় লাল ফুল দোল খায়। টিফিনপটে মজাদার খাবার। সে তখন সব ভুলে নতুন পরিচয়ে জীবন ফিরে পেয়েছে। নতুন করে বাঁচতে শিখেছে। একদা ছায়া ছায়া অন্ধকারে বোরখায় মুখঢাকা একজন কেউ ফেলে গিয়েছিল, সে তার জন্মদায়িনী মা; তার অসহায় কোমল চেহারা ভুলে গিয়েছিল। অথচ যে মানুষটি তাকে কোলে তুলে এনেছিল, যাকে খুব আদর আর ভরসায় বাবা বলে ডেকে গেছে; এক দুপুরে দেখতে হয় বীভৎস কুৎসিত চেহারা। মা কোথাও গিয়েছিল। সেই দুপুরে আকস্মিক ফিরে আসে বাবা। তাকে কেমন অদ্ভুত লাগে। তার পা-দুটো কাঁপছিল। চোখের দৃষ্টিতে রহস্যময় অচেনা আগুন। পিউ নক শুনে পড়ার বই বন্ধ করে দরজা খুলে দেয়। বাবা একপলক তাকিয়ে কী যেন ভাবে। কোনো কথা নেই, তার হাত জোর কষে চেপে দুড়দাড় টেনে আনে ঘরে। তারপর কী কী হয় পিউ সব বোঝে, সে বাধা দেয়, পারে না, কান্না করে; কিন্তু…বোঝে না কেন, কেন তাকে এমন করা হলো। সে নিঃসাড় পড়ে থাকে। অসম্ভব যন্ত্রণায় বুঝে নেয় মরে গেছে সে। রক্তের বিস্রস্ত ছোপে অসহায় নিয়তির এলোমেলো নকশি এঁকে গেছে রঙিন বেডশিট। সেই দৃশ্য দেখে নেয় মা। বাইরের দরজা খোলা ছিল। আলগোছে হেঁটে এসে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কী করবে অথবা করা উচিত বোধ পায় না। অবশিষ্ট কী ছিল আর করার? অতঃপর পুনরায় সেই স্টেশন, দিনশেষে তুলে নেয় নিজেকে, আপন মায়ের চেহারা মনে নেই অথবা কে জানে ছায়া ছায়া ঝাপসা অবয়ব; তাকে আর জাগাতে চায় না। এই মায়ের অসহায় কিংবা ঘৃণা নাকি করুণার মুখখানি অদ্ভুত ধাঁধা হয়ে জেগে থাকে সারাজীবন।
জীবনের কতটুকু দেখেছে পিউ? যে ট্রেনে উঠেছিল, বুঝিবা অনন্তকাল ছুটে যায়, এক জায়গা থেকে অন্য অচেনা শহরে, কিন্তু সে কি হয়? এক ট্রেন থেকে নেমে আরেক স্টেশনে পা রাখে সে। একটি ব্যাগ ছিল। সেই মা, কয়েক বছরের মা বলেছিল, –
‘তুই এবার চলে যা পিউ। তোকে আর রাখা যায় না। তুই সব জ্বালিয়ে দিবি হারামজাদি। ছিনালের বেটি ছিনাল।’
‘মা!’
‘আর মা ডাকিস নি হতভাগী।’
‘কোথায় যাব মা? আমার কেউ নাই। ঠিকানা নাই।’
‘তুই যেখান থেকে এয়েছিস, সেখানে চলে যা…যা…দূর হ।’
পিউ আর কী কী বলে, কাতরকণ্ঠ গোঁধূলির লালিমায় অসহায় কেঁদে কেঁদে রক্তক্ষরণ, প্রত্যুত্তরে কোন্ জবাব শোনে? চোখের উপর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কাঠের দু-পাল্লায় ফুল-পাখি আঁকা আলপনা-নকশির সঙ্গে নামফলক ‘সুখের নীড়’। তারা মা-বাবা সুখে থাক। আনন্দে থাক। তার শুধু একলা পথের জীবন। কারও জন্য অশান্ত নরক হতে দিতে চায় না। একটি নীল রং আধছেঁড়া ব্যাগ সীমানার বাইরে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে কী আছে কী নেই জানা থাকার কথা নয়। ব্যতিব্যস্ত অস্থিরতায় ভাবনাও ছিল না। এখন কোথায় যাবে পিউ? কোনো ঠিকানা? আলোকিত দিনকাল? তার পৃথিবী অন্ধকার। কেউ তার কথা ভাবে না। কেউ শোনে না বুকের কান্না। সন্ধের বাতাস শুধু দীর্ঘশ্বাস তুলে যায়। সে তাই আর কাঁদেনি। চোখের কান্না শুকিয়ে কথা বলেনি। শরীরের প্রান্তসীমায় কষ্ট-ব্যথা আর ক্লান্ত-নিশ্চুপ জীর্ণ মন, সেই-ই বুঝি একলা নিজেকে ভাসিয়ে দেয় পথে। তার কোনো ঘর নেই, আপনজন নেই, কেউ একজন ছিল, সেই ছোট্টবেলায়, স্বার্থের পৃথিবীতে তাকে ফেলে বাঁচতে চেয়েছে, সেও ভালো; সে তার গর্ভধারিণী মা। দ্বিতীয়জন সেও মা, বুকে তুলে বড় করেছে, হাতের মুঠোয় খাবার তুলে মুখে দিয়েছে, স্কুলে পৌঁছানো, এমনই সুখের দিনকাল, সবকিছু ছিল রূপকথার কাহিনি; এক দুপুরে কাঁচের মতো ভেঙে খান খান হয়ে যায় দিগ্ভ্রান্ত মায়াভ্রম। জীবন তাকে পথ থেকে তুলে পুনরায় পথে ফেলে দিয়ে রেখে দেয় ইতিহাস স্মৃতি। কে বলে নিয়তির পরিহাস!
পিউ অনেক দূর ভেসে ভেসে পরদিন দুপুরে নেমে দাঁড়ায় দিনাজপুর স্টেশন। একবার পুবে অতীত, আরেকবার পশ্চিম কিংবা উত্তরে তাকিয়ে ভবিষ্যৎ দেখে নেওয়ার নতুন প্রত্যাশা। সে বাঁচতে চায়। হায়! সেও তো মায়া মরীচিকা কল্পলোক পৃথিবীর আলোছায়া খেলা। ঈশ্বর কোথায় লিখে রেখেছে ঠিকানা কে জানে? একটু থাকার জায়গা? আশ্রয়। সে কাঁধে ব্যাগ তুলে রাস্তায় নামে। পুব থেকে পশ্চিম কতগুলো বাড়ি ঘুরে ঘুরে কাজ খোঁজে। পরিবারের সকল কাজ জানে সে। আঙিনা আর ঘর ঝাড়ু দেওয়া, কাপড় আর বাসন ধোয়া, ফুলগাছে জলসিঞ্চন…সব কাজ, যখন-তখন রাতদিন; শুধু দু-মুঠো ভাত আর আশ্রয় চাই। অবশেষে বিফল মনোরথ পুনরায় স্টেশন প্লাটফরমে এসে বসে। ট্রেন আসে ট্রেন যায়। সে কোথায় যাবে? তার কোনো ঠিকানা নেই। গন্তব্য নেই। এভাবে বসে থাকতে থাকতে কখন ঢলে পড়েছে মনে নেই। সকালের রোদ এসে যখন চমকে দেয় চারিদিক, সেও আচমকা হতবাক হয়ে পড়ে; ব্যাগে কয়েকটি কাপড় আর কিছু টাকা দিয়েছিল মা, মা তো বটেই; সেই ব্যাগ হারিয়ে গেছে। তারপর এখানে-ওখানে ঘুরতে ঘুরতে আরও চেষ্টা। পরিশেষে একদিন কখন বুকের আঁচল ফুটপাতে ফেলে নতজানু দৃষ্টি মানুষের পায়ে পায়ে করুণা দেখে যেতে শুরু করে মনে নেই। কখনো দু-একটি টাকা এসে পড়ে সেই বস্ত্রখণ্ডে। পিউ লাজুক চোখে তুলে দেখে নেয় কোন্ সে মানব যার হৃদয় কোমলতায় ফুলের বাগান সাজিয়ে রেখেছে খুব গোপনে নিজের কাছে। এই তো জীবন! এভাবেই কেটে গেল কতগুলো দিন আর রাত। সপ্তাহ কি মাস। এরপর এক রাতে অন্য কতিপয় কুকুরের দেখা পেল। ব্যাংকের সিঁড়ি থেকে পুবে যে দশ-বারো ফুট প্রশস্ত জায়গা, তারই এককোণায় বসে থাকত সে। সেখানেই পড়ে থাকত রাতের কোণায় অন্ধকার গহ্বরে। কে জানে সেখানেও বন্য কুকুরের আগ্রাসী থাবা এসে পড়বে!
আশপাশে কতগুলো দোকান। নিয়ন আলোয় ঝলমল করে রোদের ম্লান দুপুর। শেষমাথায় দক্ষিণে মেকানিক সুমন ভাই। ইনডাকশন চুলা থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্রের মেরামত কাজ। পশ্চিমে পাশাপাশি টেলিভিশন-ফ্রিজের তিনটি দোকান। দিনরাত রঙিন ছবি ভেসে বেড়ায়। খোলামেলা নাচ হয়। সেই বারান্দায় ঝকঝকে গাড়ি ওঠে। মানুষজন আরও চকচকে। তারা কেনাকাটা করে। পিউ টেলিভিশন থেকে চোখ সরিয়ে অবাক-বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। তারা বুঝি পৃথিবীর কেউ নয়, স্বর্গ থেকে নেমে আসা জ্বিন-পরি-দেবদূত। তাদের শরীর থেকে বাতাসে ভেসে বেড়ায় খুসবু ঘ্রাণ। পিউয়ের গায়ে দুর্গন্ধ। মাথার চুলে প্রায় জট বেঁধেছে কখন জানা নেই। উকুনে খেয়ে ফেলেছে করোটির রক্ত-মগজ। একদিন দুপুরে ফায়ার ব্রিগেড পুকুরে নেমেছিল। অমন নির্জন-নিরিবিলি দুপুর কেমন করে যেন রং-তামাশার ভিড়ে জমে যায়। পিউর লজ্জা করে…পিউর শরম নেই। সে পুকুর থেকে খুব জড়সড় উঠে দাঁড়ায়। উত্তুঙ্গ স্তনরেখা দু-বাহুতে যতটুকু সম্ভব সামলায়। এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিনরাত। কখনো সুমন ভাই ডাক দেয়। কখনো আলতাফ পানঅলা ফরমায়েশ হাঁকে। জরদার গন্ধ তুলে একদলা পিক ফেলে সামনে। এটা-ওটা এনে দেওয়া কাজ। তারপর পুনরায় ওড়নার আঁচল বিছিয়ে পুরোনো দিন রূপকথা মনে মনে ভেবে নেয়। তার একজন মা ছিল। বোন ছিল। একজন বাবা ছিল। অসম্ভব বদরাগি। প্রতিদিন চিৎকার করত। মাকে আর বোনদের মারধর। তাদের টিনের দেয়াল উঁচু ঘর ছিল। ঘরের সামনে ফাঁকা জায়গায় আবর্জনার স্তূপ। সেখানে কতগুলো কুকুর আর দু-একজন মানুষ সারাদিন কী যেন খুঁজে চলত। ঘাটাঘাটি। দমকা বাতাসে ভেসে আসত বিবমিষার চাপ। ওদিকে একাকী একটি গাছ ছিল। সেই গাছে কখনো শালিক আর দোয়েল এসে এই ডাল আর ওই ডাল নেচে নেচে উড়ে যেত। তারা কোথায় ভেসে যেত আর আসতই বা কোথা থেকে জানা ছিল না। সহসা পুনরায় সেই কাহিনি, যা দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে যায়। একদিন সে স্কুলের বই পড়ছিল। পড়া শেষ হলে ফুল-পাখি আঁকবে। সেই দুপুরের বাতাস অসম্ভব খাপছাড়া গরম। সে দরজায় ঠক-ঠক ডাক শুনে এগিয়ে যায়। মা বুঝি এলো টেইলর্স থেকে, কিন্তু না, একটি বিশাল ছায়া, পিউ তাকে বাবা ডাকে; সে আর ভাবতে পারে না। মনে করতে চায় না বীভৎস কষ্টের কথা।
অটোরিকশা আবার থেমে আছে নিমনগর-বালুবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে। একটি বাস রাস্তার প্রায় মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে মানুষজন তুলছে। সেটি নিয়ে হুড়োহুড়ি জটলা চেঁচামেচি-মারামারি। অনেকগুলো অটোরিকশা-ভ্যান একটির পেছনে আরেকটি দাঁড়িয়ে আছে। পিউ…না না পিউ নাম হারিয়ে গেছে, সে আজ কপিলা। কপিলার বুকে কি কারও হৃৎস্পন্দন জেগে আছে? হায় সে তার সন্তান! তার আদরের মেয়ে। মেয়ের বাবা কে? বাবা আছে, কে সে জানা নেই। একরাতে তিনজন ডেকেছিল।
‘ওই ছেরি বিরানি খাবি তো আয়।’
‘খাব চাচা।’
‘শালি চাচা কয় রে। আমারে চিনতে পারিস না?’
‘ও সুমন ভাই। খুব আন্ধার যি। দেন প্যাকেট দেন।’
‘সিনেমা দেখবি? পদ্মা নদীর মাঝি।’
‘দেখুম। আগে বিরানি খামু।’
‘সে তো বটেই, আগে খা রে কপিলা। কপিলা…কপিলা রে।’
পিউ সেই আলোছায়া রাতে কপিলা হলো। অন্ধকারে ডুবে গেল সবকিছু। এখন কেউ কেউ মাগি ডাকে। খানকি ছেরি। কপিলা হাসে। কষ্টের হাসি। কারও কাছে ছিনালি মনে হলে কী করার আছে? এই তো জীবন! তারপর একসময় আকাশের চাঁদের মতো শুক্ল আর কৃষ্ণপক্ষের দিনরাতের হিসাবে কখন যে নিজের মধ্যে অন্য কাউকে আবিষ্কার করে ফেলে জানা নেই। একদিন কেউ বুঝি মাতৃসদন ফেলে রাখে। কপিলা মাগি থেকে মা হয়ে যায়। সে পালাতে চেয়েছিল। মাতৃসদনের দক্ষিণ গেট পর্যন্ত চুপি চুপি বেশ কষ্টে হেঁটেও আসে, কিন্তু শেষমেশ পারেনি; কোথায় যেন অচেনা টান লাগে। বুকের ভেতর অদ্ভুত মায়ায় খচখচ করে। কপিলা যে মা হয়ে গেছে। মা কষ্ট ফেলে দিতে পারে না। কোনো মা পেরেছিল। তার আপন মা। কপিলা সেই মায়ের মতো মা হবে না। তার মা কে? একজন জন্ম দিয়েছিল, সে পরিত্যাগ করেছে, আর একজন মা যে বুকে টেনে নিয়ে আবার পথে ছুড়ে দিয়েছে; কপিলা তেমন মা হবে না। উত্তপ্ত রোদের দুপুরে আলগোছে চোখ থেকে লোনা জল গড়িয়ে যায় তার। এতটুকুন শিশুকে বাঁচিয়ে রাখতে কতই না চেষ্টা আর সাধনা! হে খোদা মাকে আমার বাঁচিয়ে দাও মাবুদ। কপিলা সামনে কিছু দেখতে পায় না।
রিকশা অবশেষে চলতে শুরু করে। নিমনগর-বালুবাড়ি, ফুলবাড়ি বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে বেশকিছু দূর এলে কপিলা আরও একবার বুক থেকে নামিয়ে চোখের কাছে মেলে ধরে সেই সোনামুখ। কোত্থেকে মনের মধ্যে আত্মবিশ্বাস এসে যায় যেমনভাবে নিজের জীবন আর নিয়তির সকল মর্মদাহ মুছে যেতে থাকে।
অটোরিকশা চালক মানুষটি ভালো। একেবারে ইমারজেন্সি পেরিয়ে চার নম্বর কাউণ্টার পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে থাকে। সেখানে নাম লেখা হয়। কপিলা বুঝিবা এই প্রথম কিংবা শেষবার নিজের নাম জানিয়ে রাখে। রাস্তার মানুষের নাম থাকে না। তার মেয়ের যে নাম আছে। বিশাল গোলকধাঁধার মতো ভবনের এদিক-ওদিক ঘুরে অবশেষে শিশু ও মহিলা ওয়ার্ড পৌঁছে যায়।
‘এবার তুমি থাইকো বোন। আমি যাই। গাড়ি বাইরে রাখা ঠিক না।’
‘ঠিক আছে ভাইয়া।’
পথের মানুষ কি অদ্ভুতভাবে আপন হয়ে যায়, কখন কীভাবে জানা নেই; কপিলার বুকে সাহস আসে। অটোচালক লোকটি রোগী ভর্তির একশত কুড়ি টাকা পরিশোধ করে। পৃথিবীতে দু-একজন মানুষ আছে বলে কুকুরের সমাজে সবকিছু পচে যায়নি। কপিলার কি সামান্য স্বস্তি জেগে ওঠে? কে জানে হয়তো তাই। মেয়ের জ্ঞান আছে, পিটপিট চোখে একবার দু-বার তাকায়; কানে ড্রেসিং হয়েছে। অস্ফুটে ‘মা’ ডেকেছে। কপিলা এবার থেকে আর উদাসীন থাকবে না। মেয়ের হাত ধরে ধরে হেঁটে যাবে। পৃথিবীর পথ কত দূর? এই রাস্তার শেষ কোথায়? সে নিশ্চয়ই যেতে পারবে। জীবনের এতদূর পথ যখন যেতে পেরেছে, বাকিটুকুও সামলে নেবে। কপিলা রেলিং ঘেঁষে কবেকার কোন্ পচে যাওয়া তোশকের উপর একপাশে মেয়েকে বুকে টেনে চোখ বোঁজে। অপেক্ষা একটি রাত…অপেক্ষা একটি অপেক্ষার। শিগগির ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। আগামিকাল।
একটি রাত আর দিন, বুঝিবা হাজার বছরের চেয়েও প্রলম্বিত কাল; অবহেলা অপ্রাপ্তির। শিশুটির অনেক জ্বর। শরীরের তাপে অর্ধনিমীলিত চোখজোড়া। এককাতে শুয়ে আছে, সে কি জীবিত নাকি মৃত কিছু বোঝা যায় না। কপিলা কী করে? অস্থির এদিক-ওদিক ছুটোছুটি সার। বেশি দূর যেতে পারে না। একাকী ফেলে রাখতেও ভয় করে। হায় কেন সে দুপুরের রোদে হাঁটিয়ে বেড়ালো তাকে? কেন হাতে হাত ধরে রাখতে পারল না? কপিলার চোখ শুকিয়ে গেছে। শরীরে ক্ষুধা-তৃষা নেই। মাথা আউলা-বাউলা লাগে।
রাত নয়-দশটায় ডাক্তারের রাউন্ড। মনোযোগি কথা-পরামর্শ পাওয়া যায়। কিছু ওষুধ। যা যা আর দরকার কীভাবে জোগাড় করে? ভোর-ভোররাতে খুব আলগোছে মুছে গেল সকল মায়া। কপিলা বুঝতে পারেনি। মেয়েকে জড়িয়ে থাকতে থাকতে কোনসময় চোখ লেগে এসেছিল জানে না। একসময় মনে হয়, চারিদিক অসম্ভব নিস্তব্ধ-শব্দহীন। মানুষের হাঁটাচলা, রোগীদের আর্তস্বর-কাতরধ্বনি কিছু নেই; সময় বুঝি থমকে গেছে। তার বুকের খুব কাছে ধুকপুক…সেও নেই। হিমশীতল হয়ে আছে ছোট্ট শরীর। কপিলা অস্ফুটে কেঁদে ওঠে। সে কেমন মা? তাই প্রাণভরে কাঁদতেও পারে না। নিশ্চুপ বসে থাকে অনেকক্ষণ। তারপর মেয়ের নিষ্পলক চোখদুটো ডানহাতের আজলায় নিভিয়ে দেয় এই ভেবে যে, অনেক তো দেখা হলো; আর কেন? শিশুটির কানের পাশে রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে আছে, ব্যান্ডেজে কালচে দাগ; তারই একটি-দুটি মৃদু টুকরো নিচে খসে পড়ে। ছোট্ট বুকের শুকনো পাঁজরায় আঁচড়ের দাগগুলো কোনো ক্রিমে ভেজা দগদগে, সবকিছু আজ উন্মুক্ত-উদ্ভাসিত; বুকের অন্তর্লীন ক্ষত শুধু অদৃশ্য থেকে যায়। কপিলা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কত স্বাভাবিক, যেনবা এমনই হতে পারে বা হবে; সে আস্তে আস্তে তিনতলা থেকে নিচে নেমে আসে। মেডিকেল হাসপাতালের গেট পেরিয়ে হাউজিং মোড় আসতে আসতে হাঁপিয়ে যায়। মানুষ মরে গেলে শোকপাথরের মতো এত ভারী হয়! অবশেষে তাই কাঁধে ফেলে হেঁটে হেঁটে চলে যায় অনেকখানি পথ। রাস্তার ধুলোতে এলোমেলো বিস্রস্ত পদরেখায় মানব সভ্যতার বিমূর্ত স্থাপত্যের নকশি আঁকা হতে থাকে। এভাবে ঘুরে ঘুরে পুনরায় কাচারি মোড়। আমগাছের বিশাল ছায়ায় বসে পড়ে। মাটির মানুষ মাটিতে শুয়ে থাক। ছোপ ছোপ রক্তদাগের একটুকরো আঁচল ঢেকে রাখে ছোট্ট শরীর। কপিলার আনতদৃষ্টি, একেবারে মাটিতে মিশে গিয়ে নিশ্চুপ-নির্বাক কারও কাছে কোনো জিজ্ঞাসা নেই, কৈফিয়ত বা দাবি নেই, আত্মমগ্ন দংশনে শুধু বিশুষ্ক মরে যেতে থাকে; মা…মা গো!
শিশুটির চোখ কিছু খুলে গেছে। সেই পলকহীন তীর্যক স্থির দৃষ্টি পৃথিবীর এই আলোছায়ায় ইটপাথরের উঁচু ভবন শেষবার দেখতে দেখতে এও দেখে নেয়, কতগুলো উৎসুক আদ্র-অনাদ্র চোখের মানুষ এবং তাদের দৃষ্টি, তীব্র রোদের মধ্যভাগ চিরে অনিচ্ছুক আর শ্লথ-ক্লান্ত মায়ের হেঁটে যাওয়া, আর সে পেছনে পেছনে এইসব আশপাশ দেখতে দেখতে হেঁটে চলেছিল, কোথায় যাবে, কেন যাবে, কোনো গন্তব্য নেই; এবং তখন কতগুলো কুকুর হামলে পড়ে। কপিলার শুকিয়ে যাওয়া উদাস দৃষ্টিও কিছু দেখে না, কে জানে হয়তো দেখে, দেখে যা দেখার নয়, বড় অসময়ে দেখেছিল একটি পরিবার, একজন মা, তার অসহায় জীবনছকের আড়ালে বেঁচে থাকার আকুতি, দুপুরের সূর্য, স্টেশন আর রোদের ছায়া নেমে যাওয়া একটুকরো আঁচলের মতো আশা-প্রত্যাশা-বিশ্বাস; এবং সন্ধে গভীর হতে হতে কতিপয় কুকুর চেপে ধরে। কপিলার বুকে খাঁ-খাঁ হাহাকারে তেপান্তর জেগে ওঠে। পৃথিবী-ঈশ্বর আর মানুষের প্রতি কোন্ বিশ্বাস চিনিয়ে দেয় সেই দীর্ঘশ্বাস? কেন অচেনা অভিমান মুর্হুমুর্হু গুমরে ওঠে আর বেজে যায় বুঝতে পারে না। সে পুনরায় আঙুলের টানে মেয়ের চোখ বুজিয়ে দেয়। কোত্থেকে কতগুলো মাছি ভনভন উড়তে উড়তে এসে বসে। সেগুলো শিশুটির চোখ-নাক আর খোলা মুখে অস্থির ওঠানামা শুরু করে। বাতাসে খুব মিহি করে ভেসে যায় মৃত্যুর গন্ধ।
এদিকে একচিলতে আঁচলের উপর একটি-দুটি করে টাকা পড়তে থাকে।
সারাবাংলা/এসবিডিই