বাঙালির নববর্ষ
১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:২১
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বাঙালির নববর্ষ ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। বিশ্বের অনেক দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বাঙালির এ উৎসব সম্পর্কে জানে এবং আগ্রহভরে প্রবাসী বাঙালিদের অনুষ্ঠানে আসে। বিশেষ করে এর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, অসাম্প্রদায়িক মানবিক বোধ, বাঙালি জাতিসত্তার অন্যতম উপাদান হিসেবে এর শিকড়সন্ধানী প্রেরণা মানুষকে আগ্রহী করে তোলে। বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। দেশজুড়ে এ উৎসবের আয়োজন হয় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায়। মানুষের ঢল নামে রাস্তায়। তার জড়ো হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রাঙ্গণে। নববর্ষের পোশাকের ভিন্নতাও দারুণভাবে দৃষ্টিনন্দন। লাল-সাদা রং স্নিগ্ধতার আবেশ ভরিয়ে তোলে। খাবারের বৈচিত্র্যও নববর্ষ অনুষ্ঠানের একটি দিক। জাতি খুঁজে নেয় যা কিছু তার নিজস্ব, তার সবটুকু। সেই সবটুকুর গৌরব প্রত্যেক মানুষের বুকজুড়ে থাকে বলে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট নেই।
২০১২ সালে নববর্ষ উপলক্ষে প্রথমবার আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এরপর বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে বিশ্বের খ্যাতিমানরা এই উৎসবটিকে স্মরণ করেছেন। এটি বাঙালি সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্ব লাভের নজির। অন্য দেশের সাধারণ মানুষের কাছে শুধু নয়, সরকারি পর্যায়েও বাংলা নববর্ষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
এটি নববর্ষে একটি দিক। এর আরেকটি দিক আছে। গত কয়েক বছর ধরে নববর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার দু’পাশে মিলনমেলা আয়োজিত হয়। দু’দেশে বাস করা আপনজনের সঙ্গে দেখা হয় নববর্ষের এই দিনে। স্বাধীনতার পরের এক দশকের বেশি সময় ধরে মানুষ বিনাবাধায় যাতায়াত করতে পারত। স্বজনের সঙ্গে শুধু দেখাই হতো না; ভালো একটা সময় কাটিয়েও আসা হতো। কয়েকবছর আগে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। ফলে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। গরিব মানুষেরা পাসপোর্ট-ভিসা করে স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে পারে না। তাই নববর্ষে উৎসবের দিনের জন্য তারা অপেক্ষা করে। স্বজনের জন্য পিঠাপুলি, মোয়ামুড়ি বানায়, নতুন কাপড় কেনে। দুপুর ১২টায় সীমান্তরক্ষীরা অনুমতি দিলে বাংলাদেশের মানুষ কাঁটাতারের এপাশে দাঁড়ায়। ভারতীয় নাগরিকরা তাদের সীমান্তে দাঁড়ায়। শুরু হয় হাসি-কান্না, আনন্দ-খুশির বন্যা, উপহার বিনিময়। আবেগের উৎসমুখ খুলে যায়। কথার তুবড়ি ছোটে। মিটে যায় অনেক দিন ধরে স্বজনের না দেখার তৃষ্ণা। কাঁটাতারের ওপর হাত রেখে কিংবা চিবুক ঠেকিয়ে কথা বলে মন ভরে না। বুকের মধ্যে হাহাকার জেগেই থাকে। আবার একটি নববর্ষের উৎসবের দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাদের। এক সময় ফুরোয় সময়। সীমান্তরক্ষীরা নিজ নিজ দেশের লোকদের সরিয়ে দেয় কাঁটাতারের সীমানা থেকে। জেগে থাকে সংস্কৃতির প্রবল শক্তি। কাঁটাতারের বেড়ার সাধ্য নেই সেই শক্তিকে উপেক্ষা করার। কাঁটাতারের গায়ে লেগে থাকে ৮০ বছরের নারী চুনিবালার চোখের জল। একই সঙ্গে আটকে থাকে ইউনেস্কো সনদের প্রথম পঙ্ক্তি- ‘Affirming that cultural diversity in a defining characteristic of humanity’। এভাবেই সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে মানবিকতার মৌলিক শর্ত।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎসব বিষয়ে ‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেই দিন। যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না- যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখদঃখ দ্বারা ক্ষুব্ধ করি, সেদিন না- যেদিন প্রাকৃতিক নিয়মপরম্পরার হস্তে আপনাদিগকে ক্রীড়াপুত্তলির মতো ক্ষুদ্র ও জড়ভাবে অনুভব করি, সেদিন আমাদের উৎসবের দিন নহে; সেদিন তো আমরা জড়ের মতো উদ্ভিদের মতো সাধারণ জন্তুর মতো- সেদিন তো আমরা আমাদের নিজের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করি না- সেদিন আমাদের আনন্দ কিসের? সেদিন আমরা গৃহে অবরুদ্ধ, সেদিন আমরা কর্মে ক্লিষ্ট- সেদিন আমরা উজ্জ্বলভাবে আপনাকে ভূষিত করি না- সেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহ্বান করি না- সেদিন আমাদের ঘরে সংসারচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু সঙ্গীত শোনা যায় না। প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’
উৎসবকে নিজে রবীন্দ্রনাথের এই মহৎ ব্যাখ্যার উদাহরণ বাংলা নববর্ষ। বাঙালির আত্মশক্তির উৎসব। মানুষ্যত্বের জাগরণের উৎসব। গ্রামীণ অর্থনীতি হালখাতার উৎসব। মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন।
১৪৩০ বঙ্গাব্দের নববর্ষ বাঙালির জীবনে শুভ বার্তা বয়ে আনুক, যেন এই জাতি মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করে মহৎ হয়।
লেখক: কথাশিল্পী
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা নিবন্ধ বাঙালির নববর্ষ বৈশাখী আয়োজন ১৪৩১ সেলিনা হোসেন