অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শেষ প্যারা
১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:১৫ | আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪৪
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শেষ প্যারার কাহিনী অসমাপ্ত রেখেই আত্মজীবনী গ্রন্থের সমাপ্তি হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি আরও কিছু লিখে যেতেন তা কিরূপ হতো তা ইতিহাস, সময় ও পরিস্থিতির আলোকে ভাবার চেষ্টা করা হয়েছে এই নিবন্ধে।
“… শেষ পর্যন্ত সকলেই রাজী হলে আমি ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহবান করলাম। ওয়ার্কিং কমিটির প্রায় সকলেই একমত কেবল সালাম সাহেম এবং হাশিম উদ্দিন সাহেব (ময়মনসিংহ) একমত হতে পারলেন না। তবে এ কথা জানালেন যে তারা ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য। (বিশেষভাবে উল্লেখ্য: আবুল মনসুর আহমেদ, মওলানা ভাসানীরও এতে সায় ছিল না।)
আমি ও আতাউর রহমান সাহেব বের হয়ে পড়লাম এমএলএ-দের স্বাক্ষর নিতে। সতেরো দফা চার্জ করলাম। হক সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে কে অনাস্থা প্রস্তাব প্রথমে পেশ করবে সে প্রশ্ন তোলা হল। অনেকেই আপত্তি করতে লাগল। আমার নিজেরও লজ্জা করতে লাগল। তাকে তো আমিও সম্মান ও ভক্তি করি। কিন্তু এখন কয়েকজন তথাকথিত নেতা তাকে ঘিরে রেখেছে। তাকে তাদের কাছ থেকে শত চেষ্টা করেও বের করে আনতে পারলাম না। এদের অনেকেই নির্বাচনের কয়েকমাস আগে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে এসেই ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাজিত হয়। ঠিক হল, আমিই প্রস্তাব আনব আর জনাব আব্দুল গনি (খুলনা) বার এট’ল তা সমর্থন করবেন। আমরা তার কাছে সভা ডেকে অনাস্থা প্রস্তাব মোকাবিলা করার অনুরোধ করলাম। তিনিও সভা ডাকতে রাজি হলেন। আমরা আওয়ামী লীগের প্রায় ১১৩ (মোট সদস্য ১৪২ জন) জন সদস্যের স্বাক্ষর নিলাম। তাতেই আমাদের মেজরিটি হয়ে গেল। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী সমাপ্ত)”
এরপরের ঘটনাপ্রবাহ আত্মজীবনীর ধাঁচে বললে যা দাঁড়ায়-
“…১১ জানুয়ারী প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জেলখানা মামলার সাক্ষীর জেরা গ্রহনের দিন ছিল। আমি আদালতে হাজিরা দিলাম। আদালতে একজন সাব ইন্সপেক্টরের জেরা গ্রহন করা হয়েছে। আদালত ১৫ তারিখ পর্যন্ত মামলার জেরা গ্রহণ মুলতবি করেছে।
আগেই খবর পেয়েছিলাম, মওলানা ভাসানী কলকাতা উপস্থিত হয়েছেন কিন্তু কোথায় উঠেছেন তা জানতে পারিনি (তিনি টাওয়ার হোটেলে উঠেছিলেন)। শহীদ সাহেবের মন্ত্রীত্ব নেওয়ার পর রাজবন্দীদের অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন এখনও অনেকে মুক্তি পাননি। ভাসানী সাহেবের উপর দেশে ফিরার নিষেধাজ্ঞা এখনও প্রত্যাহার হয়নি। কলকাতা আসার পর এক শ্রেণীর পত্রপত্রিকা তার সাথে শহীদ সাহেবের সম্পর্ক নিয়ে মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশ করেই চলেছে। এ বিষয়ে আমাদের প্রতিবাদ জানাতে হবে। সামনে হক সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থা এবং কেন্দ্রে শহীদ সাহেবের প্রধানমন্ত্রীত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই এ সকল রিপোর্ট আমাদের রাজনীতির ক্ষতি করতে পারে। (১৫ জানুয়ারী) আমি মওলানা ভাসানীর সাথে শহীদ সাহেবের মতবিরোধ নিয়ে স্থানীয় বাংলা দৈনিকে যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে তার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেই।
হক সাহেব দু’মাস পশ্চিম পাকিস্তান অবস্থান করে ২১ জানুয়ারী পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসেছেন। দু’মাস তিনি শুধু মন্ত্রীত্বই করেননি। পূর্ববঙ্গে সরকার গঠনের প্রশ্নে কেন্দ্রে বোঝাপড়া করে রেখেছেন। গভর্নর গোলাম মোহাম্মদ কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী হক সাহেবের পক্ষ নিয়েছেন। মোহাম্মদ আলী সাহেবও চাচ্ছেন প্রদেশে হক সাহেবকে ক্ষমতা দিয়ে কেন্দ্রে তিনি হক সাহেবের সমর্থনে সরকার চালিয়ে যাবেন। এখন মোহাম্মদ আলী বগুড়া অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী।
আমাদের দলে বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে নেতাদের মধ্যে নানারকম উপদলীয় কোন্দল বিরাজমান। শহর কমিটিতেও এর প্রভাব পড়েছিল। এ পরিস্থিতিতে (২২ জানুয়ারী) দলের শহর কমিটির ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডাকা হয়। শহর আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আমি এবং ইয়ার মোহাম্মদ খান অংশ নেই। বৈঠকে দলের নেতা শহীদ সাহেব এবং ভাসানী সাহেবের প্রতি আস্থা ভোট নেওয়া হয়। বৈঠকে শহর আওয়ামী লীগ নেতা শওকত আলীকে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে ৫ বছরের জন্য বহিস্কার করা হয়।
শহীদ সাহেব কেন্দ্রে আইনমন্ত্রী হলেও প্রদেশে এখনও ‘৯২ ক ধারা’ চলমান। প্রদেশের গভর্নর খাজা মো. সাহাবুদ্দিন কেন্দ্রের কথায় উঠবস করেন। আমাদের প্রতি দমননীতি এখনও কমেনি। গভর্নর ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে প্রদেশে সকল প্রকার জনসভা মিছিল নিষিদ্ধ করেছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ডিসি তো সকল পত্রিকা মারফত তাদের জেলায় ১৪৪ ধারা জারী করেছেন। মাইক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, কালো ব্যাজ পরিধান নিষিদ্ধ করেছেন।
(২৮ জানুয়ারী) আমি এবং দলের সহ সভাপতি আতাউর রহমান এক বিবৃতিতে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রদেশে সকল প্রকার জনসভা এবং মিছিল নিষিদ্ধের প্রতিবাদ জানাই। বিবৃতিতে আমরা জনগন এবং দলের নেতা কর্মীদের যথাযথ মর্যাদায় শহীদ দিবস পালনের আহবান জানিয়েছি। আমাদের সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক মোমিন তালুকদার, ছাত্রলীগ সাধারন সম্পাদক আব্দুল আওয়াল বিবৃতি দিয়েছেন। যুক্তফ্রন্ট অফিসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সভা করেছে।
এদিকে গভর্নর গোলাম মোহাম্মদ এবং পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী খান সাহেব ভারত সফরে এবং প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য কানাডা অবস্থান করছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইস্কান্দার মীর্জা সাহেব বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি তার সরকারকে মার্কিনী ধাঁচে দেশে সংবিধান প্রনয়নের সুপারিশ করেছেন।
আমরা হক সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রস্তুতি নিচ্ছি। অনাস্থার নোটিশ দ্রুতই দিতে হবে। সালাম খানেরা এখন প্রকাশ্যই হক সাহেবের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সালাম খান আজ ২৯ জানুয়ারী পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান প্রকাশ করেছেন। তিনি তার বিবৃতিতে জানান তাদের সাথে দলের সভাপতি ভাসানীও একমত আছেন। তার সাথে ২৬ জন আছেন বলে বিবৃতিতে জানানো হয়। এ বিবৃতিতে ২৬ জন কারা কারা বোঝা যাচ্ছে না।
২ ফেব্রুয়ারি তারিখে যুক্তফ্রন্ট সংসদীয় দলে যথারীতি অনাস্থা প্রস্তাব নোটিশ দাখিল করলাম। যথারীতি খুলনার ব্যারিস্টার আব্দুল গনি তা সমর্থন করলেন। হক সাহেবও ১৭ তারিখ সভার তারিখ ধার্য করেছেন। প্রদেশে জরুরী অবস্থা থাকায় অন্যস্থানে সভার অনুমতি মিলতে নাও পারে। তিনি পরিষদের সভাকক্ষ চাইলেন স্পীকার বলেন, সভাকক্ষ দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি দিলেন, পরিষদের বিশ্রাম কক্ষ। তিনি এ-ও জানান এখানে স্থান সংকুলান হবে না। হক সাহেব সভার জন্য সকল সদস্যকে নোটিশ দিলেন এবং পাশাপাশি পত্রিকার মাধ্যমেও জানালেন।
আগেই বলেছি আমরা হক সাহেবের বিরুদ্ধে ১৭ দফা অভিযোগ এনেছি। হক সাহেব ১৭ তারিখ বৈঠক এবং প্রদেশে সরকার গঠন নিয়ে পত্রিকা বিবৃতি প্রকাশ করেন। এতে তিনি জানান, তিনি দুই সপ্তাহে ৫০ জন নেতার সাথে বৈঠকে বসেছিলেন। নেতারা তাকে জানিয়েছিল ভাসানী না ফেরা পর্যন্ত ১৭ তারিখের সভা না করতে তিনি বলেন তিনি সে অনুরোধ রক্ষা করতে পারেননি। তিনি বলেন, প্রতিকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে গত ৬ মাস তিনি যুক্তফ্রন্টের বৈঠক ডাকতে পারেননি। তিনি বলেন, তিনি ১১ ডিসেম্বর বৈঠক ডেকেছিলেন কিন্তু শহীদ সাহেব বিদেশ থাকায় অনেকেই আমাকে সভা স্থগিত করতে বললে সে অনুযায়ী আমি ১১ ডিসেম্বরের সভা স্থগিত করেছি। সভা না করার ব্যাপারে তাই আমাকে দোষ দেওয়া যায় না।
(১৪ তারিখ) কিছুদিন পরে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনে মওলানা আকরাম খান সভাপতি নির্বাচিত হন। তারা প্রদেশে সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পরদিন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া তিন সপ্তাহের বিদেশ সফর শেষে সরাসরি ঢাকা পৌঁছেই সাংবাদিকদের জানান এখনই প্রদেশে সংসদীয় শাসন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। তাদের মধ্যে সমঝোতা হলেই কেবল সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। এদিকে কেন্দ্র বলছে গণপরিষদ সম্পর্কে সিন্ধু হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তা তারা মেনে চলবেন। আমাদের নেতা শহীদ সাহেব আজ হায়দ্রাবাদে এক জনসভায় পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন। আমাদের দলের অনেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট সমর্থন করে না।
গত কয়েকদিনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের ধরপাকড় হয়েছে। (১৫ ফেব্রুয়ারি) তারিখে আমি এবং দলের সহ-সভাপতি আতাউর রহমান ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগ নেতাদের ব্যাপক ধরপাকড়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতি দেই। বিবৃতিতে আমরা সকল ছাত্র রাজবন্দীদের জেলে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দেওয়ার আহবান জানিয়েছি। ঢাকা ত্যাগকালে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া বলেছেন প্রদেশে সংসদীয় সরকার গঠনে কেন্দ্র তিন সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত দিবে। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া ঢাকা থেকে (১৬ ফেব্রুয়ারি) করাচী পৌঁছে মন্ত্রীসভার বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি পরিষদ ভবনের বিশ্রাম কক্ষে যুক্তফ্রন্টের সভায় ফজলুল হক/ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে সভার শুরুতে পাবনার আকবর আলীর প্রস্তাবে অনাস্থা প্রস্তাবের উপর কার্যক্রম শুরু হলে হক সাহেবের পক্ষে তার অনুসারী ব্যারিস্টার এ হামিদ তার পক্ষে স্বাক্ষর নেওয়া শুরু করেন। এ সময় আমি হক সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনলে খুলনার ব্যারিস্টার গনি তা সমর্থন করেন। প্রস্তাব ভোটে দিলে তা ১০৬-৭৯ ভোটে গৃহীত হয়। এরপর আমি দলের নেতা হিসেবে আতাউর রহমান খানের নাম প্রস্তাব করলে একই ভোটে তা গৃহীত হয়। এরপর অন্যান্য বিষয়ের উপর আলোচনা হয় এবং প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিকেলে সভা মুলতবী ঘোষণার পর হক সাহেব আর ফিরে আসেননি। হক সাহেবের প্রতিনিধিরা দাবী করে তাদের পক্ষে ১৩৬ জনের স্বাক্ষর হয়েছে। তাই আস্থা ভোটে তারাই জিতেছে। সভায় উপস্থিত ছিল ১৯৬ জন সদস্য।”
সারাবাংলা/এসবিডিই
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শেষ প্যারা ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা নিবন্ধ বৈশাখী আয়োজন ১৪৩১ সালাহউদ্দিন দুলক