কর্ণফুলীর তলদেশ যেভাবে কাটবে দৈত্যাকৃতির টিবিএম
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:৪১
।। সাব্বির আহমেদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প থেকে ফিরে: এই প্রথম টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে বাংলাদেশে। শুধু কি বাংলাদেশে? দক্ষিণ এশিয়াতেই কোনও নদীর তলদেশ দিয়ে সরাসরি সুড়ঙ্গপথ তৈরির বৃহৎ কোনও প্রকল্প এটাই প্রথম। পার্শ্ববর্তী বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা কোথাও নেই, যা বাংলাদেশ এখন বাস্তবায়ন করছে। নদী তলদেশ দিয়ে একটি পাকা সড়ক টেনে নিতে যে সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হচ্ছে তার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ যন্ত্র। নাম তার ‘টিবিএম’ বা টানেল বোরিং মেশিন।
আরও পড়ুন: যেভাবে টানেলের যুগে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশ
মেশিনটি তৈরি হয়ে এসেছে চীন থেকে। এটি কেবল কর্ণফুলীর তলদেশ খননই করবে না একই সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সড়ক পথ তৈরি করে যাবে। মেশিনটি এমন ভাবে কাজ করবে যে একপ্রান্ত থেকে পথ কাট শুরু করে অপরপ্রান্ত দিয়ে বের হবে।
প্রায় তিন তলা সমান উচু দৈত্যাকৃতির এ যন্ত্র এরই মধ্যে বসে গেছে কর্ণফুলীর পতেঙ্গা পয়েন্টে। সেখানে ১২ মিটার গভীরে বসানো হয়েছে মেশিনটি। সেখানে খনন শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৩ মিটার বা ১৪০ ফুট গভীর পর্যন্ত চলে যাবে। যার মধ্য দিয়ে তৈরি হবে সুড়ঙ্গ পথ।
কিভাবে কাজ করবে সে টিবিএম?
মেশিনের ঠিক সামনে আছে ধারালো কাটার যন্ত্র। যা মাটি কাটতে কাটতে এগিয়ে যেতে থাকবে। আর পেছন দিক দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কংক্রিটের সেগমেন্ট ঢুকে চারিদিকে গোলাকারের শক্ত দেয়াল তৈরি করবে। ফলে মেশিন যত এগুবে ততই ধীরে ধীরে আকার পাবে টানেল।
হাজারো ‘কর্মবীরের’ ঘামে-শ্রমে রচিত হচ্ছে কর্ণফুলীর নতুন ইতিহাস
কংক্রিটের সেগমেন্টগুলো একটি রেলট্রাক দিয়ে ঢুকবে। ঢুকে ৮টি ভাগে ভাগ হয়ে রিং আকারে একটির সঙ্গে অন্যটি লেগে যাবে। প্রতি ৮টি সেগমেন্টে দুই মিটারের একটি রিং তৈরি হবে। এভাবে টিবিএমের সামনের অংশ খনন করতে করতে এগুতে থাকবে আর পেছনে স্বয়ক্রিয় ভাবে সেগমেন্ট এসে যুক্ত হতে থাকবে।
এভাবে ২০ হাজার সেগমেন্ট বসলেই পুরো আড়াই কিলোমিটার টানেল তৈরি হয়ে যাবে। টানেল কতৃপক্ষ জানালো প্রতিদিন এভাবে ৪ থেকে ৫ মিটার করে টানেল তৈরির কাজ এগুবে।
যে যজ্ঞ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে চট্টগ্রামের নেভাল একাডেমির পাশে। এখান থেকে টানেলের প্রবেশ পথ। যেখানে টিবিএম মাটির ১২ মিটার নিচে থেকে খোদাই শুরু করেছে। ধীরে ধীরে এটি আরও গভীরে যাচ্ছে। এরপর কিছুদূর সামনেই কর্ণফুলী নদী। নদীর তলদেশে যাওয়ার পর মাটি উপরিভাগ থেকে প্রায় ৪৩ মিটার অর্থাৎ ১৪০ ফুট গভীরে খোদাই করে সড়ক নিয়ে যাবে।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত রয়েছে চায়না কমিউনিকেশন কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)।
সিসিসিসি প্রকৌশলীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ি, টানেল নির্মাণের মূল কাজ নদী তলদেশে। টিবিএম দিয়ে নিখুঁতভাবে সার্বক্ষণিক কম্পিউটারাইজ পদ্ধতিতে এগিয়ে যাবে সে কাজ।
চীনেরজিয়াংসু প্রদেশের জেংজিয়ান শহরে টানেল সেগমেন্ট কাস্টিং প্ল্যান্টে সেগমেন্ট তৈরি করে আনা হচ্ছে। এর মধ্যে দুই হাজার সেগমেন্ট এসে গেছে। যেগুলো পতেঙ্গা পাড়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
সিসিসিসি সূত্র জানায়, টিবিএমের সামনে কাটার মেশিন যখন মাটি কাটবে তখন সব মাটি ও পাথর একটি পাইপের মাধ্যমে আলাদা একটি ট্রিটমেন্ট প্লান্টে চলে যাবে।
নদী জানবেও না তলদেশে নির্মাণযজ্ঞের খবর!
ভেতরে কয়েকটি টিম এই টিবিএম মেশিন পরিচালনা করবে। এর মধ্যে একটি টিম কাটার মেশিন পরিচালনা করবে, একটি টিম সেগমেন্ট বসানো নিয়ন্ত্রণ করবে । আরেকটি টিম সেগমেন্টগুলো রেলট্রাকে আনা মনিটরিং করবে। অন্য টিম সেগমেন্ট ঠিকমতো লেগেছে কি না বা তার পজিশনিং ঠিক হয়েছে কি না তা দেখবে।
টিবিএমের ভেতরেই এভাবে বিভিন্ন ইলেকট্রিকাল এবং মেকানিক্যাল টিম একযোগে কাজ করবে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, শুরুতে মাটি থেকে ২৪ মিটার খনন করা হয়েছে। সামনে এগুনোর পর যা বাড়তে থাকবে। টিউবের ভেতরের আকার ১০ দশমিক ৮ মিটার। বাইরের আকার হবে ১১ দশমিক ৮ মিটার।
এভাবে প্রথম যাত্রায় দুই লেনের একটি টিউব সড়ক হবে। সেটি শেষ হলে টিবিএম আনোয়ার প্রান্ত থেকে নদী তলদেশে ঢুকে আরেকটি দুইলেনের সড়ক খোদাই করে পতেঙ্গা অংশে বের হবে। এভাবে দুটি টিউবে চারলেনের সড়ক পথ হবে কণফুলী নদী তলদেশে।
২০২২ সাল নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ করে টানেল ব্যবহার উপযোগী করে তোলা সম্ভব হবে বলেই মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
সারাবাংলা/এসএ/এমএম