এই বাজেট জনকল্যাণমুখী, সব মানুষের কাজে লাগবে: প্রধানমন্ত্রী
১৪ জুন ২০১৯ ১৯:৩৮
ঢাকা: ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি একটা কথাই বলতে পারি, এটা জনকল্যাণমূলক বাজেট। আমরা বাজেট এমনভাবে করে দিয়েছি, যা সব মানুষেরই কাজে লাগবে। এ বাজেট যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় সে ব্যাপারে সকলে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে। যেন বাংলাদেশকে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি।
শুক্রবার (১৪ জুন) বিকেল ৩টায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি একথা বলেন।
রীতি অনুযায়ী বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে মূল আয়োজক ও বক্তা থাকেন অর্থমন্ত্রী। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবারে আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থিত হতে পারেননি। আগেই জানানো হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সংবাদ সম্মেলন করবেন। তবে সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে মঞ্চে ডেকে নেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর দুইপাশে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুন, এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া মঞ্চে ছিলেন। অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার সংবাদ সম্মেলনটি পরিচালনা করেন।
শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী জানান, অসুস্থতার কারণে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থিত হতে পারেননি। এ সময় দ্রুত অর্থমন্ত্রীর সুস্থতা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
পরে অর্থসচিবও বলেন, অসুস্থতার কারণে অর্থমন্ত্রী গতকাল (বৃহস্পতিবার) বাজেট বক্তৃতা শেষ করতে পারেননি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজেট বক্তৃতা শেষ করেন। এটি বাংলাদেশের সংসদে একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) বিকেলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। মূল বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ দশমিক ১ শতাংশ। এবারের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১ শতাংশ। এনবিআর বর্হিভূত রাজস্ব আয় ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। আর কর বর্হিভূত রাজস্ব আয় ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা । এটি জিডিপির ১ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া আসছে বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা। এছাড়া বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে বাজেট নিয়ে বক্তব্য রাখার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ: প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা কালো টাকা করে ফেলেছেন তাদের টাকাটা তো আগে স্ট্রিমলাইনে আনতে হবে। কোথায় গুঁজেগেজে রেখে দিয়েছে, তার ঠিক নেই, আবার ইঁদুরে খেয়ে না ফেলে? সেটাকে আনার একটা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
‘আর যারা সৎ পথে উপার্জন করে, তাদের এই চিন্তাই নাই ভয়ও নাই। আল্লাহর রহমতে তাদের কোন অসুবিধাও হবে না। তাদের হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। কারণ সৎ পথে থাকলে হতাশ হতে হয় না। সততার অনেক পরীক্ষা-অগ্নিপরীক্ষা আমাকে দিতে হয়েছে। আমি কখনো হতাশ হয়নি। যারা সৎ থাকে তাদের ভেতরে একটা দৃঢ়তা থাকে, একটা আত্মবিশ্বাস থাকে। যে কোনো অবস্থা মোকাবিলা করার মতো একটা শক্তি থাকে। সেই শক্তিটা কিন্তু আমার সবসময় আছে। এটি আমি মনে করি। কাজেই যারা সৎ পথে, তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং তাদের যেন সুবিধা হয় সেটি আমরা দেখব।’
প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মনে হয়, বাজেটের ওপরে খুব একটা বেশি বলার আপনাদের নেই। কারণ আমরা বাজেট এমনভাবে করে দিয়েছি, যা সব মানুষেরই কাজে লাগবে। এই বাজেট যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় সেই ব্যাপারে সকলে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে। যেন বাংলাদেশটাকে আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এটার জন্য কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা আলাদা কমিটি করা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস নিয়ে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সবাই মিলে এটার ওপর একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে এবং এর এখন আন্তর্জাতিক সংস্থা আছে।
কাজেই যেখানেই এই ধরনের টাকা বা অর্থ পাচার হচ্ছে, সেটা ধরা পড়ছে এবং সেটার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আর কালো টাকা মানে এখানে মাঝে মাঝে যেটা হয়, কিছু অপ্রদর্শিত টাকা থেকে যায়, হয়ত কোন কারণে টাকা হাতে এসে যায় কিন্তু কোন কাজে লাগাতে পারে না। তখনই সেই টাকাটা নানাভাবে পাচার করতে চায়, বা অন্যভাবে ব্যবহার হয়। সেটা যাতে আর না হয়, সেটা বন্ধ করার জন্য এদেরকে একটা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আমরা একশোটা অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছি। আমাদের যে আইটি পার্কগুলো সেখানে কেউ যদি বিনিয়োগ করে তাকে কিন্তু সুনির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হবে। কেউ বিনিয়োগ করলে আমরা প্রশ্ন করব না।
তিন কোটি কর্মসংস্থানের লক্ষ্য: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্মসংস্থান বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘শুধু কি চাকরির মধ্যদিয়ে কর্মসংস্থান হয়? কর্মসংস্থানের কথা আমরা বলেছি, চাকরি দেওয়ার কথা বলিনি।
কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে আমরা একশ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছি। এই বরাদ্দ শিক্ষা, প্রযুক্তি, কারিগরি ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণে ব্যয় হবে। আমরা চাই প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যেন নিজের কাজ নিজে করতে পারে। কাজেই তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন ধান কাটার লোক পাওয়া যায় না। এত বেশি বেকার যদি থাকে, তাহলে তো ধান কাটলেও ৪/৫ শ টাকা পাওয়া যাবে। প্লাস দুই বেলা খাবার বাড়িতে। সেই লোক কেন পাওয়া যাচ্ছে না, বিবেচনা করেছেন। কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে বলেই ধান কাটার লোক নেই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মানুষ যেন পেটভরে খেতে পারে, সেই সুযোগ তৈরি করা। আমরা একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। একেকটি প্রকল্প হলে কত মানুষের কাজ হবে, চাকরি হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘পত্রিকার মাধ্যমে দেখেছি, ধান কাটার লোক পাওয়া যায় না। শ্রমিকরা আরও বেশি টাকা চায়। এই যে শ্রমের মূল্য বেড়েছে, চাহিদা বেড়েছে। বেকার লোকের অভাব আছে বলেই তো।’
তিনি আরও বলেন, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছি। প্রতিনিয়ত প্রজেক্টগুলো হচ্ছে। এক একটা প্রজেক্টগুলো সম্পন্ন হলে কত মানুষের কাজ হবে, চাকরি হবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে।
প্রধানমন্ত্রী আত্ম-উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘নিজে কর্ম সৃষ্টি করতে হবে। সেই সঙ্গে নিজেরও কাজ হবে ওই সঙ্গে যেন আরও কয়েকজন কাজ করতে পারে। সেটাই আমরা বলতে চাইছি সে কারণেই এটি সম্ভব।’
বাজেটে উল্লেখ্য করা ‘সোনালী যুদ্ধ’ শব্দ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সোনালী যুদ্ধ ব্যবহার করা হয়েছে দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধশালী করার জন্য, মঙ্গলের জন্য। যেন জনগণ একটা সোনালী দিন দেখতে পায়। এটি অকল্যাণের যুদ্ধ নয়, ধ্বংসের যুদ্ধ নয়। এটি সৃষ্টির যুদ্ধ।’
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে কিছু লোক থাকে, যাদের একটা মানসিক অসুস্থতা থাকে, তাদের কিছুই ভালো লাগে না। আপনি যত ভালো কাজই করেন, তারা কোনো কিছু ভালো খুঁজে পায় না। যখন দেশে একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি থাকে, যখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়, সাধারণ মানুষের উন্নতি হয়, তখন তারা কোনোকিছুই ভালো দেখে না। সবকিছুতেই কিন্তু খোঁজে।’
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)’র দিকে আঙুল তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা গবেষণা করে এবং তারা দেশের জন্য কী আনতে পেরেছে? তারপরও তাদের একটা কিছু বলতে হবে। তো সেটা ভালো। এত সমালোচনা করেও আবার বলবে, আমরা কথা বলতে পারি না। এ রোগটাও আছে। এটা অনেকটা অসুস্থতার মতো।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কথা হচ্ছে, আমার সাধারণ জনগণ খুশি কি না। সাধারণ মানুষ খুশি কি না? সাধারণ মানুষগুলোকে ভালো করতে পারছি কি না। এটি হচ্ছে বড় কথা। আমরা যা করছি তার সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে। আর এই ভালো না লাগা পার্টি যারা, তাদের কোনো কিছুতেই ভালো লাগবে না’
সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘যারা সমালোচনা করার তারা করে যাক। ভালো কথা বললে আমরা গ্রহণ করব, মন্দ কথা বললে আমরা ধর্তব্যে নেব না। পরিষ্কার কথা।’
পরিশেষে সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে, শুক্রবার সকালে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ- সিপিডির ‘বাজেট পর্যালোচনা’ অনুষ্ঠানে বলা হয়, দেশের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের মানুষ নয়, যারা ধনী এবং অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী, তারাই নতুন অর্থবছরের বাজেট থেকে সুবিধা পাবে।
সারাবাংলা/জিএস/এনআর/একে
আরও পড়ুন
কালো টাকা যেন ইদুরে না খায়: প্রধানমন্ত্রী
অর্থমন্ত্রীর জন্য দোয়া চাইলেন প্রধানমন্ত্রী
অপ্রদর্শিত অর্থপাচার না করে বিনিয়োগ করুন, প্রশ্ন করব না
ব্যবসায়ীরা খুশি মনে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করবে, আশা প্রধানমন্ত্রীর
মিডিয়া মালিকদের খেলাপি ঋণের হিসাব কষতে বললেন প্রধানমন্ত্রী
সুদের হার নিয়ে বাজেটের সিদ্ধান্ত মানতে হবে: প্রধানমন্ত্রী