চিকিৎসার খরচের বোঝা মাথায় নিয়ে রাত কাটে স্টেশনে
৮ মে ২০১৯ ১৩:৪৩
ঢাকা: ঢাকায় কাছের কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই যার বাসায় গিয়ে রাতটি থাকা যায়। আবার দুঃসম্পর্কীয় যারা আছেন, তাদের বাসাও কমলাপুর স্টেশন (রেলওয়ে স্টেশন) থেকে অনেক দূরে। অত দূরের বাসায় যাওয়ার মতো ভাড়া আমার কাছে থাকে না। তাই পুরো রাতটা কাটিয়ে দিই স্টেশনে। সঙ্গে থাকে বাড়ি থেকে আনা আটার রুটি, সবজি না হয় গুড়। শুকনো এই খাবারে রাত পার হয়ে যায়। সকাল হলেই চলে যাই রক্ত নিতে। তারপর শরীরে রক্ত নিয়ে আবার ফিরে যাই গ্রামে। এভাবেই চলছে গত দশবছর ধরে বলছিলেন সোলাইমান হোসেন।
মঙ্গলবার (৭ মে) বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনে গেলে কথা হয় সোলাইমান হোসেনের সঙ্গে। ৩৪ বছরের সোলাইমানের বাড়ি জামালপুরে। তিনি থ্যালাসেমিয়াতে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য তাকে প্রতিমাসেই ঢাকায় আসতে হয়। আর যেদিন ঢাকায় আসেন সে রাত কাটান কমলাপুর রেলস্টেশনে।
সোলাইমান হোসেন বলেন, ‘জামালপুর থেকে দুপুর দেড়টার ট্রেনে রওনা দেই, রাত ৯টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে যাই। তারপর কিছু খেয়ে রক্তের জন্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে আসি। রক্ত সংগ্রহ করে আবার গ্রামে ফিরে যাই।’
কীভাবে অসুখের কথা জানতে পারলেন প্রশ্ন করলে সোলাইমান বলেন, ‘২৫ বছর যখন বয়স, একদিন শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো, জ্বর আর কমে না। ডাক্তারের কাছে গেলে জানতে পারি, শরীরে রক্ত কমে গেছে।
বারডেম হাসপাতালের একজন ডাক্তার আব্দুল রউফ, তিনি জামালপুরে গিয়ে রোগী দেখতেন। ওই চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি জানান, আমার থ্যালাসেমিয়া, নিয়মিত রক্ত দিতে হবে। এই কথা জানার পর চিন্তায় পড়ে গেলাম, এত রক্ত কোথায় পাব আর কোথা থেকেই বা দেব?
রউফ স্যারই পরামর্শ দিলেন ঢাকায় আসার। এরপরই থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের খোঁজ পাই। তখন থেকেই এখানে আসছি। আজ দশ বছর যাবত এখান থেকে চিকিৎসা নিচ্ছি। এখান থেকে সব ধরনের ওষুধ পাচ্ছি, পরীক্ষাও করাতে পারছি বলেন সোলাইমান।
সংসারজীবনে সোলাইমান দুই সন্তানের জনক। একটি আট বছরের ছেলে আর সাড়ে তিন বছরের মেয়ে। দুই সন্তান বাবার মতো এ অসুখে আক্রান্ত কি না জানতে চাইলে হাসি দিয়ে সোলাইমান বলেন, ‘তাদের ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তাররা বলেছে, তারা থ্যালাসেমিয়ামুক্ত।’
ছেলেমেয়ের কথা বলতে বলতে বলেন, ‘অনেক কষ্টের জীবনে এটাই আমার শান্তি ছেলেমেয়ে দুইটাকে আমার মতো কষ্ট করতে হবে না। তারা ভালো আছে।’
সোলাইমান বলেন, ‘এখন জমি চাষ করে কোনোরকম সংসার চালাচ্ছি। কোনোদিন সকালে খেলে রাতে আর কিছু জোটে না। চিকিৎসা না চালাইতে পারলে সুস্থ থাকব কেমনে। আমি মারা গেলে আমার দুই সন্তানকে দেখার কেউ থাকবে না। ছোটকালে আমার মা মারা গেছেন। বাপ-মা না থাকলে সেই সংসারের কী হয় সেটা তো আমি জানি বলেন তিনি।
প্রতিমাসে রক্ত নিতে হয় জানিয়ে সোলাইমান হোসেন বলেন, ‘চিকিৎসা খরচ এখন কিছুটা কমে এসেছে। খরচ কমে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি।’
সেটা কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গত ৮ থেকে ৯ মাস চিকিৎসার সব খরচ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডশেন বহন করছে। এর আগে তিন থেকে চার হাজার টাকা বাড়ি থেকে নিয়ে আসতাম। এই টাকা যখন যোগাড় করতে হতো তখন মনে হতো এ জীবনের চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। মরে গেলে নিজে শান্তি পাইতাম, পরিবাররেও শান্তি দিতাম। কিন্তু তা তো আর চাইলেই পারি না।’
তিনভাই বোন রেখে মা যখন মারা যান তখন সোলাইমান হোসেনের বয়স ছিল ছয় বছর, ছোট দুই-বোনের বয়স যথাক্রমে সাড়ে চার আরেক বোনের বয়স দেড় বছর। নানা বাড়ি কাছাকাছি থাকাতে সেখানেই বড় হয়েছেন।
এখন নিজেদের জমি চাষ করে কোনোরকম সংসার করে যাচ্ছেন তিনি। কোনোদিন সকালে খেলে রাতে আর কিছু জোটে না। কিন্তু চিকিৎসা না চালাইতে পারলে আমি সুস্থ থাকুম ক্যামনে, আমি মারা গেলে তো আমার সন্তান দুইটারে দেখার কেউ থাকব না।
ছোটকালে আমার মা মারা গেছে। বাপ-মা না থাকলে সেই সংসারের কী হয় সেটাতো আমি জানি।
কিন্তু এই রোগের চিকিৎসা খরচ এত বেশি-আমিতো সেই খরচ করতে পারি নাই। ওষুধ লিখে দিত ডাক্তারা, সেটা তো নিতে পারতাম না। আমাদের জন্য এটা অনেক কঠিন।
এবার হাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলেন সোলাইমান। এই হাতের তালুতে যেন ভাগ্যরেখা খুঁজে পেয়েছেন।
সারাবাংলা/জেএ/একে
আরও পড়ুন
দেশে প্রতি ১৪ জনে একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক!
বিয়ের আগে বর-কনের রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক কেন নয়: হাইকোর্ট
বছরে ৭ হাজার শিশু জন্মায় থ্যালাসেমিয়া নিয়ে
নীরব ঘাতক থ্যালাসেমিয়া, প্রয়োজন বিয়ের আগে সচেতনতা