চুক্তির ২১ বছরেও ‘শান্তি ফেরেনি’ পাহাড়ে
২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:২৮
।। প্রান্ত রনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
রাঙামাটি: আজ ২ ডিসেম্বর। ১৯৯৭ সালের এই দিনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষর করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। পাহাড়ের মানুষের কাছে এ চুক্তি ‘শান্তি চুক্তি’ হিসেবেই পরিচিতি পায়।
সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) চুক্তিতে বছর খানেক পাহাড়ে শান্তির সুবাতাস বইলেও এর পরের বছর চুক্তি বিরোধীতাকারী একটি পক্ষের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ইউনাইটেড পিপলস ডোমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। এরপর থেকেই পাহাড়ে শুরু হয় দুই আঞ্চলিক সংগঠনের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত।
পরবর্তীতে বিরোধ আরও চরম আকার নেয়। ২০০৭ সালে অন্তঃকোন্দল দেখা দেয় জনসংহতি সমিতির মধ্যেই। ২০১০ সালের দিকে জনসংহতি সমিতি থেকে বেড়িয়ে এসে তাতিন্দ্র লাল চাকমা (পেলে), সুধাসিন্ধু চাকমার নেতৃত্বে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)।
পরে ২০১৫ সালের দিকে চুক্তিবিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফের মধ্যেও অন্তঃকোন্দল সৃষ্টি হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে তপন জ্যোতি চাকমাসহ আরও কয়েকজনের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে আরেকটি আঞ্চলিক সংগঠন। এই তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাই ছিলেন একসময়ে ইউপিডিএফের সশস্ত্র শাখার (সামরিক শাখা) প্রধান।
চুক্তি স্বাক্ষরের ২১ বছরে পাহাড়ে সৃষ্ট তিন আঞ্চলিকসহ চার সংগঠনের আধিপত্য বিস্তার রয়েছে। চুক্তির ফলে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সামরিক শাখা শান্তি বাহিনীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর যুদ্ধবিরতি হলেও গত ২১ বছর ধরে পাহাড়ে চলছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। শুরুর দিকে এ সংঘাত দুর্গম জঙ্গলে চললেও এখন অনেকটা প্রকাশ্যেই তা হচ্ছে।
আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে- এ বছরের ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনেই উপজেলা চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে হত্যার ঘটনা। আলোচিত এই হত্যার ঘটনার রেষ না কাটতেই পরের দিন একই উপজেলার কেংড়াছড়ি এলাকায় দুর্বৃত্তের ব্রাশফ্রায়ারে নিহত হন সর্বশেষ গঠিত আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা।
অন্যদিকে, এ বছরের ১৯ আগস্ট খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর বাজারে ইউপিডিএফ কার্যালয়ের সামনে তাদের দলীয় সমাবেশের আগ মুহূর্তে প্রতিপক্ষের গুলিতে ইউপিডিএফের তিন কর্মীসহ ৬ জন নিহত হন। একই দিন দুপুরের দিকে হত্যার প্রতিবাদে ইউপিডিএফ মিছিল বের করলে ওই মিছিলে দুর্বৃত্তের হামলায় নিহত হন আরও ১জন। সবুজ পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি বেড়েছে আধিপত্য বিস্তার, এলাকা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র করে অপহরণ, চাঁদাবাজি।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তারে প্রয়োজন অস্ত্র। আর এই অস্ত্র কিনতেই অপহরণ, চাঁদাবাজি করে সংগঠনগুলো। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে সাধারণ পাহাড়িদের অপহরণ করে মুক্তিপণ নিয়েই ছেড়ে দেয় এরা।
এসব বিষয়ে জনসংহতি সমিতির অভিযোগ, চুক্তির ২১ বছরের মাথায়ও চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়াতে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বেড়েই চলছে। অন্যদিকে, একটি স্বার্থানেষী মহলের মদদে পাহাড়ে সৃষ্ট আঞ্চলিক সংগঠনগুলো এসব কাজ করছে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, ‘চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়াতেই পাহাড়ে দিনদিন সংঘাত, খুন, গুম, অপহরণ বেড়েই চলছে। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে, সামগ্রিক দিক দিয়ে পাহাড়ের আন্দোলনরত দলগুলোর সঙ্গেও সরকারের আলোচনায় বসা দরকার।’
রাঙামাটি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সংরক্ষিত সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, ‘শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ের অশান্ত পরিবেশ শান্ত হয়ে আসে। চুক্তির সিংহভাগই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি ধারাগুলোও সরকার বাস্তবায়ন করবে। ইতোমধ্যে ভূমি কমিশনের কার্যক্রমও ত্বরান্বিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ চুক্তি করেছে, আওয়ামী লীগই চুক্তি বাস্তবায়ন করবে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক প্রশান্ত চাকমা বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে কাজ করছি। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে জুম্মদের অধিকার প্রতিষ্ঠাতা হবে বলে আমি মনে করি। তবে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। আমরা চুক্তির বাস্তবায়নে সরকারের ভূমিকা দেখছি না।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সহ-সভাপতি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২১ বছরেই আমাদের চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে। সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন না করে পাহাড়ে সংঘাত জিইয়ে রেখেছে। চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে পায়দা লুটছে। আমরা তো চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা দেখছি না।’
ঊষাতন আরও বলেন, ‘চুক্তির যে ধারাগুলো বাস্তবায়ন করলে সরকারের লাভ; সেগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে। জুম্মদের আশা-আকাঙ্ক্ষার চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি।’
সারাবাংলা/এমও