ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। তেহরানে একটি আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলায় অন্তত ৬০ জন নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে ২০ শিশুও রয়েছে। পরে ইরানের পালটা হামলায় ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব ও জেরুজালেমে কমপক্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়াও, দেড় শতাধিক ইসরায়েলি আহত হয়েছেন বলে স্বীকার করেছে তেল আবিব। হামলার পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘যতদিন প্রয়োজন’ তারা হামলা চালিয়ে যাবেন।
এদিকে, বিশেজ্ঞরা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মিত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে পরিচিত ইরানের বিরুদ্ধে হামলা ইসরায়েলের জন্য চূড়ান্তভাবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করছেন। তাহলে, ঝুঁকির মুখে কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করবে? অথবা হঠাৎ এই সময়ে আক্রমণ কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে।
আলজাজিরা প্রতিবেদনে বলা হয়, শুক্রবার ভোরে শুরু হওয়া হামলাকে পরিকল্পিত বলে মনে হচ্ছে। ইরানে সামরিক ও সরকারি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা হয়েছে এবং ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডবাহিনী (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরিসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সামরিক নেতা নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে বিশিষ্ট ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীরাও রয়েছেন।
তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে ইরান ও ইসরায়েলের প্রধান মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান আলোচনার পরও এই হামলা চালানো হলো। তাই অনেকেই মনে করছেন, ইসরায়েরের এই ভয়াবহ হামলা ও হুমকি ইরানের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির জন্য একটি সমন্বিত চক্রান্ত।
প্রতিবেদন আরও বলা হয়, ইসরায়েলের জন্য মার্কিন সমর্থন এখনো গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির প্রধান অস্ত্র জোগান দাতার পাশাপাশি ওয়াশিংটন জাতিসংঘে ইসরায়েলের সমালোচনার বিরুদ্ধে স্থায়ী ঢাল হিসেবেও কাজ করে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বারবার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো আনুষ্ঠানিক নিন্দা বন্ধে প্রায়ই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইরান কি তাহলে ইসরায়েলের জন্য আসন্ন পারমাণবিক হুমকি তৈরি করেছে?
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তার প্রচলিত অস্ত্রাগার বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রও। দেশটি পারমাণবিক শক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে বেশ এগিয়েই এবং এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। যদিও এটি কখনো প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি ইসরায়েল।
এখন ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে সেই আধিপত্য কেড়ে নেবে। তাই এটিকে ইসরায়েল হুমকি হিসেবে দেখছে। বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েল, বিশেষ করে নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলে আসছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। এদিকে, তেহরানও জোর দিয়ে বলে আসছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে।
ইসরায়েলি হামলার ন্যায্যতা প্রমাণ করতে নেতানিয়াহু বলেন, ‘ইরান খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারত; এটি একবছর বা কয়েক মাসও হতে পারে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরায়েলি এক সামরিক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ইরানের কাছে ১৫টি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত উপাদান রয়েছে।
ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা ইসরায়েল বাদে অন্যান্য দেশ ও সংস্থা কী বলছে
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) সম্প্রতি জানিয়েছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তির অংশ হিসেবে সই করা বাধ্যবাধকতাগুলো পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তবে দেশটি তাৎক্ষিণিকভাবে তাদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। আইএইএ আরও অভিযোগ করেছে, ইরান এবং তার পরিদর্শকদের মধ্যে চুক্তিতে অসহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তবে তারা এটি বলেনি যে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যান্য পশ্চিমা দেশ, চীন এবং রাশিয়ার সঙ্গে ২০১৫ সালের একটি চুক্তির অংশ হিসাবে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে এবং আইএইএকে নিয়মিতভাবে তার স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছিল। ফলে ইরানের ওপর যে কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল তা থেকে মুক্তি পায়। তবে, ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে একতরফাভাবে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। একইসঙ্গে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞাগুলো ফের আরোপ করেন।
এদিকে, গত মার্চে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড বলেছিলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহতভাবে মনিটরিং করছে। দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না। তিনি আরও বলেন, দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ২০০৩ সালে স্থগিত করা পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি অনুমোদন করেননি।
তাহলে কেন ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ করবে?
নেতানিয়াহু আগে থেকেই ইরানকে ‘অক্টোপাসের মাথা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন- যার চারপাশে হুথি থেকে হিজবুল্লাহ ও হামাস রয়েছে। তিনি মনে করেন, ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ নামে পরিচিত অঞ্চল জুড়ে ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর একটি নেটওয়ার্কের প্রধান ইরান।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল হামাস এবং হিজবুল্লাহ উভয়কেই মারাত্মকভাবে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ইসরায়েলে আক্রমণ করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। উভয় সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের প্রায় সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা হয়েছে, যার মধ্যে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এবং হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং ইসমাইল হানিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও রয়েছেন।
তবে হিজবুল্লাহর ওপর আক্রমণগুলো সেই ধরনের আঘাতের মুখোমুখি হয়নি, যা ইসরায়েলের অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন। ফলে ইসরায়েলের বাজপাখিরা যুক্তি দিতে শুরু করেছে, তাদের দেশের কাছে ইরানসহ তার শত্রুদের লক্ষ্যবস্তু করার এবং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে পুনর্গঠন করার এক অভূতপূর্ব সুযোগ রয়েছে। কেউ কেউ ভাবতে পারেন ইরানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্যও সুযোগ রয়েছে। যদিও এর জন্য ইসরায়েলের যতটা ক্ষমতা আছে তার চেয়ে অনেক বেশি যুদ্ধের প্রয়োজন হবে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা।
গতবছর থেকে গত শুক্রবারের হামলার আগে ইসরায়েল, ইরান বা তাদের কোনো মিত্রের মধ্যে সরাসরি কোনো সংঘর্ষ হয়নি। ইসরায়েল আক্রমণ করলে পালটা হামলা ছাড়া অন্য কোনো পদক্ষেপের হুমকি কারও কাছেই ছিল না।
ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার পেছনে কি কোনো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উপাদান ছিল?
ইসরায়েলের অনেকেই নেতানিয়াহুকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক বিবেচনার ভিত্তিতে সামরিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগ করেন। এর মধ্যে রয়েছে গাজার যুদ্ধ, যেখানে ইসরায়েল ৫৫ হাজারের এরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। সমালোচকদের দৃষ্টিতে, নেতানিয়াহু তার জোট বজায় রাখার জন্য ইরান এবং গাজা উভয় ক্ষেত্রেই সংঘাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘নেতানিয়াহুর জন্য বিদেশি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য আলাদা করা যায় না। ইসরায়েলের জন্য কোনো আসন্ন হুমকি ছিল না। এটি অনিবার্য ছিল না। আইএইএ রিপোর্টে এমন কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যেখানে ইরান ইসরায়েলের জন্য অস্তিত্বের হুমকি তৈরি করেছে।’
অপরদিকে, ইরানের ওপর হামলার পর থেকে ইসরায়েলের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মিছিল করেছেন। এমনকি ইসরায়েলিবিরোধী নেতা ইয়ার ল্যাপিড ইরানের ওপর হামলার প্রশংসা করেছেন এবং বামপন্থী রাজনীতিবিদ ইয়ার গোলানও হামলাকে সমর্থন করেছেন।
বামপন্থী ইসরায়েলি সংসদ সদস্য ওফার কাসিফ আল জাজিরাকে বলেন, ইরানে হামলার নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্ত তার রাজনৈতিক অবস্থানের ‘চাপ’ ও বলপ্রয়োগের প্রতি তার আসক্তির কারণেই হয়েছিল।’ তবে কাসিফের দুঃখের বিষয় হলো, এই পদক্ষেপটি সংসদীয়বিরোধী দলের সমর্থন পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
ইরানে হামলা চালিয়ে কি ইসরায়েল আবারও আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে?
কিছু আইন বিশেষজ্ঞের মতে, হ্যাঁ। গাজায় ২০ মাস ধরে চলা যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অসংখ্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক মাইকেল বেকার আল জাজিরাকে বলেন, ‘এবার ইরানের ওপর হামলা দেশটির আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের আক্রমণ আসন্ন ছিল এমন কোনো ইঙ্গিত নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ইসরায়েলের পক্ষে তাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে আক্রমণকে ন্যায্যতা দেওয়া যথেষ্ট নয় যে, ইরান শিগগিরই পারমাণবিক ক্ষমতা অর্জন করবে।’