ঢাকা: দেশে কালো টাকার পরিমাণ কত- এর কোনো সঠিক ও হাল নাগাদ পরিসংখ্যান নেই। তবে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের আমলেই কালো টাকার পরিমাণ বেড়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন সরকারের আমলে মোট ২২ দফায় প্রায় ৪০ বছর ধরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাড়া অতি সামান্য।
তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর মতে, ‘কালো’ টাকা বলে কিছু নেই। যেটা আছে, সেটা হচ্ছে- ‘অপ্রদর্শিত আয়’। আর ‘অপ্রদর্শিত আয়’ বলতে করের আওতায় আনা হয়নি, কিন্তু বৈধভাবে অর্জন করা হয়েছে- এমন অর্থের কথাই বলা হয়। অবৈধভাবে (যেমন কালোবাজারি, চোরাচালান, ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি) অর্জিত আয় এর আওতার বাইরে।
কালো টাকার আকার
অর্থনীতিবিদের মতে, প্রতিবছর দেশের অর্থনীতিতে ৭০ হাজার কোটি কালো টাকা যুক্ত হচ্ছে।
বেশ কয়েক বছর আগে একটি বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপি’র ৩৭ শতাংশ।
গত ২০২৩ সালের এপ্রিলে কর্পোরেট খাতে কর স্বচ্ছতা নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র এক সংলাপে দেশে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপি’র ৩১ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়। সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, কর ব্যবস্থার বাইরে দেশে ইনফরমাল অর্থনীতির পরিমাণ প্রায় ৮৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে। সে হিসাবে বিশেষজ্ঞদের মতে, কালোর টাকার পরিমাণ ৪০ শতাংশও যদি হয়, তাহলে এর পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ১০ লাখ কোটি থেকে ১২ লাখ কোটি টাকার মতো।
সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বিকল্প বাজেট উপস্থাপনকালে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সৃষ্ট মোট পুঞ্জিভূত কালো টাকার পরিমাণ আনুমানিক ১৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। এছাড়া একই সময়ে পাচারকৃত মোট অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয়।
কালো টাকা সাদা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ বিভাগ সূত্রমতে, গত ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করা হয়েছে। এরপর ২০২২-২৩ ও সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেউ কালো টাকা সাদা করেন নি বলে জানা যায়। আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের মধ্যে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে।
তথ্য মতে, ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা (রাজস্ব আদায় ১৯ লাখ টাকা); ১৯৭৬-১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা (রাজস্ব আদায় ৮১ লাখ টাকা); ১৯৮১-১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৪৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা (রাজস্ব আদায় ৫৯ লাখ টাকা); ১৯৯১-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১৫০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা (রাজস্ব আদায় ১৫ কোটি টাকা); ১৯৯৭-২০০০ সাল পর্যন্ত ৯৫০ কোটি ৪১ লাখ টাকা (রাজস্ব আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকা); ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত ৮২৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০০৭-২০০৮ সালে ৯ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা; ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা (রাজস্ব আদায় ২৩০ কোটি টাকা); ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা (রাজস্ব আদায় ১০৭৩ কোটি টাকা) সাদা করা হয়েছে।
তথ্য মতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৮৫৯ ব্যক্তি কালো টাকা সাদা করেন। অর্থের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। আলোচ্য অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত নগদ অর্থ ও ব্যাংক আমানত প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বর্গমিটারপ্রতি নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে প্লট-ফ্ল্যাট প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তখন ১১ হাজার ৮৫৯ জন করদাতা কালো টাকা সাদা করেন। এর মধ্যে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেন ২৮৬ জন, জমি ক্রয়ে ১ হাজার ৬৪৫ জন, ফ্ল্যাট ক্রয়ে ২ হাজার ৮৭৩ জন এবং নগদ অর্থ প্রদর্শন করেন ৭ হাজার ৫৫ জন। এছাড়া করোনাজনিত কারণে বাইরে টাকা পাচার করতে না পারার কারণেও ওই অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করার পরিমাণ বেড়েছিল বলে অনেকের ধারণা।
পরবর্তী ২০২১-২২ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করেন ২ হাজার ৩১১ জন। অর্থের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এক সময় ব্যাংকিং খাতে কালো টাকা জমা রাখার জন্য ‘বিয়ারা সার্টিফিকেট অব ডিপোজিট’ (বিসিডি) নামে এক ধরনের সঞ্চয়ী হিসাব চালু ছিল। এই একাউন্টে টাকা রাখতে আমানতকারীদের নাম-ঠিকানার কোনো প্রয়োজন হতো না। কেবল একটি নম্বরের মাধ্যমে টাকা জমা রাখা এবং মুনাফাসহ আসল টাকা তোলা যেতো।
কিন্তু ২০০২ সালে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে ব্যাংকিং খাতে কালো টাকা রাখার আর কোনো সুযোগ নেই। কারণ এখন ব্যাংকে কোনো একাউন্ট খুলতে গেলে বা টাকা জমা রাখতে গেলে টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাংককে অবহিত করতে হয়।